দুজন সোনার মানুষ ও সমকালীন বুদ্ধিজীবীর দায়

মানুষের সাধনা যতটা নিজেকে নিয়ে তার চেয়ে বেশি অপরকে নিয়ে অপরের কল্যাণে। এটা কেবল মানুষের ক্ষেত্রে নয় সকল প্রাণের ক্ষেত্রে সমভাবে প্রযোজ্য। মানুষ যেহেতু প্রাণের ভরকেন্দ্রে অবস্থিত এবং অন্যকে নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার অধিকারী ও জীবনের প্রতিযোগিতায় এগিয়ে, ফলে তাকে ঘিরেই আবর্তিত হয় জাগতিক পৃথিবীর কল্যাণ, প্রগতি, সভ্যতার অগ্রগতি ও মানুষের মুক্তি—যা নিশ্চিত করতে পারে সোনার মানুষেরা—দেশ ও জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীরা। লালনের সোনার মানুষেরা সোনার রাংতায় মোড়ানো নয়, তারা জীবনের ব্রতে, কর্মের সাধনায় বুদ্ধিজীবীর দায়ে সংশপ্তকের ভূমিকায় উত্তীর্ণ-অবতীর্ণ-জারি রাখা মহত্তর এক মানুষ।

মানুষের সাধনা যতটা নিজেকে নিয়ে তার চেয়ে বেশি অপরকে নিয়ে অপরের কল্যাণে। এটা কেবল মানুষের ক্ষেত্রে নয় সকল প্রাণের ক্ষেত্রে সমভাবে প্রযোজ্য। মানুষ যেহেতু প্রাণের ভরকেন্দ্রে অবস্থিত এবং অন্যকে নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার অধিকারী ও জীবনের প্রতিযোগিতায় এগিয়ে, ফলে তাকে ঘিরেই আবর্তিত হয় জাগতিক পৃথিবীর কল্যাণ, প্রগতি, সভ্যতার অগ্রগতি ও মানুষের মুক্তি—যা নিশ্চিত করতে পারে সোনার মানুষেরা—দেশ ও জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীরা। লালনের সোনার মানুষেরা সোনার রাংতায় মোড়ানো নয়, তারা জীবনের ব্রতে, কর্মের সাধনায় বুদ্ধিজীবীর দায়ে সংশপ্তকের ভূমিকায় উত্তীর্ণ-অবতীর্ণ-জারি রাখা মহত্তর এক মানুষ।

'মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি/ মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপারে তুই মূল হারাবি।' মানুষকে ভালবাসা এবং মানুষের কল্যাণ সাধনের মধ্যেই নিহিত রয়েছে মানুষের মুক্তি। লালনের ভাষায় যা 'মানুষ ভজা'।

আর এখন কে সোনার মানুষ আর কে নয়, তার প্রমাণ বিশেষভাবে মেলে বিশেষ কিছু মুহূর্তে—দেশ ও জাতির সংকটে—সংগ্রামে। বাঙালির জীবনে সেই সময় এসেছিল ১৯৭১ এর স্বাধীনতার যুদ্ধ ও মুক্তিসংগ্রামের দিনগুলোতে। সেইসময় রাজনীতিবিদরা তাদের লড়াই সংগ্রাম দিয়ে জাতিকে দিক নির্দেশনা দিয়ে যুদ্ধের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছিল ঠিকই। কিন্তু জাতিকে উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত করার কাজটি করেছিল বুদ্ধিজীবীরা—বুদ্ধিজীবীদের ধর্ম এটাই। তারা চিন্তা দিয়ে, লেখালেখি দিয়ে, কর্ম দিয়ে মানুষকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে। তারা শুধু অন্যদের মধ্যে স্বাধীনতার বীজমন্ত্র রোপণ করে না, অন্যদেরকে কেবল মানসিকভাবে তৈরি করে না, নিজেরাও সেটা ধারণ করে প্রকৃত সোনার মানুষের ভূমিকা পালন করেন, বুদ্ধিজীবীর দায় সম্পন্ন করেন। ১৯৭১ এদেশের বুদ্ধিজীবীরা নিজের জীবন বিসর্জন দিয়ে আমাদের স্বাধীনতাকে গৌরবান্বিত করেছেন। আমাদের শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস সেই গৌরবের দিন এবং বেদনার ক্ষণ। কারণ আমরা এই দিনে হারিয়েছি এ জাতির বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার সোনার মানুষদেরকে, যাদেরকে নির্মমভাবে হত্যার শুরুটা হয়েছিল ২৫ মার্চ থেকেই।

আমাদের শহীদ বুদ্ধিজীবীরা কীভাবে বুদ্ধিজীবীর দায় পূরণ করে সোনার মানুষের ভূমিকা পালন করেছেন, দুইজন শহীদ বুদ্ধিজীবীর জীবন, কর্ম, অপ্রকাশিত ডায়েরি, কবিতা অন্যান্য লেখালেখি এবং স্বজনদের অবলোকনের আলোকে এই লেখা।

শহীদ বুদ্ধিজীবী আনোয়ার পাশা এবং শহীদ বুদ্ধিজীবী রাশীদুল হাসান ছিলেন ঘনিষ্ঠ বন্ধু। প্রাত্যহিক কাজের বাইরে বেশিরভাগ সময় তারা একসঙ্গে কাটিয়েছেন এবং একইভাবে মানবতা প্রগতি এবং দেশপ্রেমে নিজেদেরকে নিবেদন করেছেন মৃত্যুবধি।

'অনেক রাতে সুদীপ্ত শুতে গেলেন। মেঝেতে ঢালাও বিছানা। সারি সারি তারা শুয়েছেন। সাতজনের শোয়া সম্ভব। আর তাদের একজনকেও তিনি চেনেন না… নব পরিচয়ের সূত্রপাত হয়েছে।

পুরনো জীবনটা সেই পঁচিশের রাতেই লয় পেয়েছে। আজ তা-ই যাই … হোক। নতুন মানুষ, নতুন পরিচয় এবং নতুন একটি প্রত্যয়। যে আর কত দূরে। বেশি দূরে হতে পারে না। মাত্র এই রাতটুকু তো। মাভৈঃ কেটে যাবে।'

রাইফেল রোটি আওরাত–এর নায়ক সুদীপ্ত শাহীনের জীবনে সত্যি সত্যি রাতটুকু মাভৈঃ কেটে গেছে। কিন্তু দ্রষ্টা আনোয়ার পাশার জীবনে রাতটুকু কাটেনি। রাত শেষে সূর্যের আলো ওঠার আগেই একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর তিনি শহীদ হয়েছেন। ১৬ ডিসেম্বরের বিজয়ের আলোয় উজ্জীবিত স্বদেশে আমরা তার নামের সঙ্গে শহীদের তকমা লাগিয়েছি। 'শহীদ'- পবিত্র এই শব্দের প্রতি তাদের স্মৃতির প্রতি আমরা কতোটা শ্রদ্ধা জানাতে পেরেছি সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ। আনোয়ার পাশা জীবনভর যোদ্ধা ছিলেন। মানবতা, প্রগতি আর দেশপ্রেমের প্রতি তারা ছিলেন জীবনভর উৎসর্গীকৃত এক প্রাণ। মানুষের কল্যাণে এবং শিল্পের সৃজন, সমৃদ্ধিতে তিনি ছিলেন অনন্য এক দৃষ্টান্ত। যার বিরল ব্যতিক্রমী উদাহরণ যুদ্ধদিনে রচিত আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার অমর সাক্ষ্য 'রাইফেল রোটি আওরাত'। একাত্তরের যুদ্ধবিধ্বস্ত সময়ে ভূলুণ্ঠিত মানবতার মর্মন্তুদ মুহূর্তেও তার কলম থামেনি। লেখালেখি ও মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য-সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন যোদ্ধার ধর্ম পালনের মতো। একাত্তরের দিনগুলোতে যখন রাজধানী ঢাকা পশ্চিম পাকিস্তানি হন্তারক ও এদেশীয় দালালদের অভয়ারণ্য তখনও তিনি ভয়কে থোড়াই কেয়ার করে শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত করেছেন দেশেপ্রেমের মহামন্ত্রে।

অন্যদিকে, ১৯৭১ সালের ১২ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী রাশীদুল হাসান লিখেছেন: 'আমাদের রাত্রিগুলো/ আমাদের রাত্রিগুলো মাছের পেটের মতন/ সারা রাত আমরা সব জান-নূন হয়ে আছি/ আমাদের প্রার্থনার ধ্বনি/ তোমার প্রাণে কী পৌঁছাবে?/ আমরা সবাই আজ প্রার্থনার মতো/ আমরা সবাই আজ প্রতীক্ষার বিগলিত মুহূর্তের ধারা/ আমাদের রাত্রিগুলো/ ইস্রাফীলের শিঙ্গ হয়ে ঝরে/ আমাদের রাত্রিগুলো/ ভয়ঙ্কর ঝড়ের মতন/ হলুদ পাতার মতো আমরা সব ঘুরপাক খাই/ আমাদের প্রার্থনার ধ্বনি/ তোমার প্রাণে কি পৌঁছেনি?'

১৯৭১ সালের অপ্রকাশিত ডায়েরির একুশে ফেব্রুয়ারি তারিখে তিনি লিখেছেন: 'আটই ফাল্গুন বা একুশে ফেবরুয়ারীর নানা তাৎপর্য আজ আবিষ্কৃত এবং এখনো চলমানমান।

প্রথমত এ ছিল বাঙলাদেশের বা পূর্ব পাকিস্তানের পাঁচ কোটি বাঙালীর মাতৃভাষা বাঙলার রাষ্ট্রভাষা রূপে স্বীকৃতির আন্দোলন। পরে এই আন্দোলন বাঙলাদেশের সর্বক্ষেত্রে সর্বাত্মক মুক্তির প্রতীকে উন্নীত হলো।

আমার কাছে এই আন্দোলনের যে চেহারা আজ প্রকাশিত, তার দুটি দিক সব থেকে তাৎপর্যময়। প্রথম, এর সবল ও সপ্রাণ সৃষ্টিশীলতা- সাহিত্য, শিল্প, সংস্কৃতি এবং রাজনীতি ও সমাজনীতির সর্বক্ষেত্রে- একটা সনিষ্ঠ ও বেগবান আত্মজিজ্ঞাসা- এক পবিত্র এ নির্মল আত্মআবিষ্কার। দ্বিতীয়, এর সর্বজনীনতা , ধর্ম বর্ণ সমাজ ও বিশ্বাস নির্বিশেষে এই প্রথম সবার আপন উৎসব বাঙালীরা পেল। ঈদোৎসব যেমন মুসলমানের পুজোৎসব যেমন হিন্দুর, একুশে ফেবরুয়ারি বা আটই ফাল্গুনোৎসব তেমন নয়,- এ উৎসব বাঙলা ভাষাভাষী হিন্দু- মুসলিম নির্বিশেষে সকলের- একান্ত আপনার মহোৎসব।'

মানুষকে ভালবাসা-মানুষের কল্যাণ সাধনে তারা কতোটা নিবেদিত ছিল আনোয়ার পাশার জীবনের একটা ঘটনায় সেটা স্পষ্ট হয়। এখানেই বুদ্ধিজীবী হিসেবে তারা অনন্য। লেখক-কলামিস্ট রণেশ মৈত্র একটা ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন, যা সবিশেষ তাৎপর্যময় এবং আনোয়ার পাশাকে বোঝার জন্য অতীব গুরুত্ববহ। ঘটনাটি ১৯৬২ সালের ২৮ এপ্রিলের। আনোয়ার পাশা তখন পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের বাংলার শিক্ষক। ওই দিন রাতে পাবনা শহরের সংঘটিত হয় ভয়াবহ এক দাঙ্গা। আনোয়ার পাশা ওই রাতে পালন করেছিলেন মানবধর্মের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব-সম্মুখসমরে দেশপ্রেমিক একজন যোদ্ধা যেমন দেশের তরে নিজ প্রাণ বিসর্জনে কুণ্ঠিত হন না বিন্দুমাত্র। দাঙ্গার ওই রাতে কলেজের হিন্দু ছাত্ররা ছিল শঙ্কিত এবং প্রাণ হারানোর ভয়ে ভীত ও বিপন্ন। কলেজ অধ্যক্ষের কাছে তারা আবেদন করেছিলেন তাদের পাশে দাঁড়িয়ে যেকোনো মূল্যে দাঙ্গার হাত থেকে তাদের জীবন রক্ষার জন্য। কিন্তু অধ্যক্ষ মহোদয় শিক্ষার্থীদের আহবানে সাড়া দেননি, পাশে দাঁড়াননি, কোনো প্রকার খোঁজ খবরও নেননি।

এই অবস্থায় ওই রাতে সংশপ্তকের মতো নিজের জীবনের ঝুঁকি আছে জেনেও বিপন্ন-বিপদগ্রস্ত শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন শহীদ বুদ্ধিজীবী আনোয়ার পাশা। নিজে নাইটগার্ডের বাসায় গিয়ে ডেকে আনেন এবং ক্লাসরুম খুলে দিয়ে শিক্ষার্থীদের ভেতরে রেখে বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে দেন। নিজের পকেটের টাকা দিয়ে রুটি কলা কিনে নিয়ে এসে রাতের খাওয়ার ব্যবস্থা করেন। এবং সারারাত শ্রেণিকক্ষের বাইরে নির্ঘুম কাটান। ওই রাতে দাঙ্গাকারীরা হিন্দু হোস্টেলে আসে এবং শিক্ষার্থীদের না পেয়ে ভাঙচুর করে চলে যান। এই ঘটনার কথা আনোয়ার পাশার কাছের কয়েকজন মানুষ ব্যতীত কেউই জানেন না-কেউকে তিনি বলার প্রয়োজনবোধ করেননি। আত্মপ্রচারণা কিংবা আত্মঅহমিকার তো প্রশ্নই আসে না। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন, শিক্ষক-ছাত্রের সম্পর্ক পিতা-পুত্রের বন্ধনেরই একটা রূপ। পুত্ররূপী শিক্ষার্থীদের রক্ষায় দাঙ্গার ওই রাতে তিনি কেবল পিতার ভূমিকা পালন করেছেন।

'হে আমার দেশ' নামক একটা কবিতায় রাশীদুল হাসান লিখেছেন: হে আমার দেশ/ আমি তোমার সঙ্গে আছি/ সুখে শোকে অজস্র সংকটে/ যে তোমাকে ছেড়ে যাবে যাক/ আমি যাবো নাকো/ চিরকাল র'বো আমি/ তোমার আত্মার আত্মীয় হয়ে/ তোমার নিঃস্বতা দিয়ে/ তোমার হৃদয়ে আজ/ আমার হৃদয়/ কথা কয়।/হে আমার দেশ/ তুমি আমি আজ/ এমন গভীর কাছাকাছি!!

১৯৭১ সালের ৭ মার্চের কথা ডায়েরির পাতায় লিখেছিলেন এভাবে: 'এতো লোক রমনার মাঠে কখনো দেখে নি। পনর লক্ষাধিক হবে। অসংখ্য স্বেচ্ছাসেবক বাঁশের লাঠি হাতে এসেছেন। স্বাধীনতা ও সংগ্রামে শপথ-স্লোগানে মুখরিত সভা। কোথাও পাকিস্তানী পতাকা নেই। স্বাধীন বাঙলার সুন্দর পতাকায় সভা শোভিত। এমন কখনো দেখেনি।!'

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ২০ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গ্রেপ্তার করে রাশীদুল হাসানকে। ওই সময় তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নিচ্ছিলেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি শিক্ষার্থীদের মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার কথা বলেন, দেশপ্রেমের কথা বলেন। চিরদিনের শান্ত, সৌম্য মানুষটি হানাদার বাহিনীর কাছেও এই সত্য স্বীকার করেছিলেন। মৃত্যু-শঙ্কা আছে জেনেও তিনি বলেছিলেন, 'একজন শিক্ষক হিসেবে তিনি যা বলেছেন, ঠিক বলেছেন। এটাকে তিনি তার কর্তব্য বলে মনে করেন। দেশের এই সংকটে একজন শিক্ষক হিসেবে এটাকে তার অবশ্য পালনীয় দায়িত্ব বলে মনে করেন।'

এরপর ১২ দিন নাজিমউদ্দিন রোডের জেলখানায় আটক রাখা হয় রাশীদুল হাসানকে। নানা প্রকার শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো হয়, পশ্চিম পাকিস্তানিদের অন্যায়-অত্যাচারের সাফাই গাওয়ার জন্য ও তাদের পক্ষে মিথ্যে বিবৃতি দেওয়ার জন্য। কিন্তু দেশপ্রেমের প্রশ্নে আপসহীন আর সত্যের পথে অবিচল রাশীদুল হাসানকে দিয়ে এই কাজটি করানো সম্ভব হয়নি। তাকে কাফের, মুরতাদ, নাস্তিক নানা ফতোয়া দেওয়া হয়। দেশদ্রোহীর তকমা লাগিয়ে দেওয়া হয় তার নামের সঙ্গে। কিন্তু তার সুললিত কণ্ঠে কোরআন শরিফের সুরা রাহমান-এর পাঠ শুনে মুগ্ধ ও বিস্মিত হয়ে পাকিস্তানি এক মেজর জেলখানা থেকে ছেড়ে দেন তাকে।

১৯৭১ এর দিনগুলোতে নিজেদের জীবন বাঁচানোই যেখানে দায়, সেখানে কীভাবে রক্ষা করা হয়েছিল রাইফেল রোটি আওরাতের পাণ্ডুলিপি- তা বিস্ময়কর বৈকি। আনোয়ার পাশার স্ত্রী মদিনা খাতুন এই লেখককে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, 'যুদ্ধের দিনগুলোতে জান বাঁচানোর মতো করেই রাইফেল রোটি আওরাত এর পাণ্ডুলিপি রক্ষা করেছি। বাসা তল্লাশি হতে পারে এই ভয় সবসময়ই ছিল। এ কারণে সারাক্ষণই কেবলই ভয় হতো, যদি পাণ্ডুলিপিটা খুঁজে পায়। এ কারণে টয়লেটের ফ্লাশের মতো কাঠ দিয়ে চাপা দিয়ে রেখেছি, কখনোবা আবার আলমারীর পায়ের নিচে পেপার দিয়ে জড়িয়ে রেখেছি। তখন নিজেদের প্রতি যতোটা খেয়াল ছিল, তার চেয়ে বেশি মনোযোগ ছিল পাণ্ডুলিপিটা রক্ষা করার। এভাবে পাণ্ডুলিপিটা রক্ষা করতে পেরেছি ঠিকই কিন্তু পাণ্ডুলিপির স্রষ্টাকে রক্ষা করা সম্ভব হয়নি।'

রবীন্দ্রনাথের জন্মশত বার্ষিকীর অনুষ্ঠান আয়োজনে সক্রিয়ভাবে যুক্ত থাকার 'অপরাধে' পূর্ব পাকিস্তান সরকারের স্বরাষ্ট্র বিভাগের নির্দেশে তার পাসপোর্ট ছয় বছরের জন্য স্থগিত রাখা হয়েছিল।

আনোয়ার পাশার মনে প্রশ্ন ছিল, হিন্দুর দেশ যদি হয় হিন্দুস্তান (ভারত)। মুসলমানের দেশ যদি হয় পাকিস্তান। তাহলে মানুষের দেশ কোনটি? এ কারণে আমৃত্যু তার যুদ্ধ ছিল মানুষের দেশ অন্বেষণ ও বাস্তবায়নে-বাঙালি হওয়ার গৌরব অর্জনে।

আনোয়ার পাশা ও রাশীদুল হাসানকে একসঙ্গে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়-রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে একইসঙ্গে লাশ মেলে এবং আরও কয়েকজন শহীদ বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে তাদেরকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদ প্রাঙ্গণে কবর দেওয়া হয়।

বুদ্ধিজীবীর দায় কেমন হওয়া উচিত, জাতির সংকটে-দেশপ্রেমের প্রশ্নে বুদ্ধিজীবীরা রাখতে পারে কতোটা ভূমিকা তার মহোত্তর দৃষ্টান্ত আমাদের শহীদ বুদ্ধিজীবীরা। আনোয়ার পাশা ও রাশীদুল হাসানের জীবন ডায়েরি কিছু চুম্বক অংশ থেকে আমরা অনুভব করতে পারি বুদ্ধিজীবীতার প্রশ্নে কতোটা সোনার মানুষ ছিলেন এবং মানুষ ভজা'য় তারা কতোটা উৎসর্গীকৃত প্রাণ ছিলেন। সময়ের ব্যবধানে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে দাঁড়িয়ে এই প্রশ্ন কি সঙ্গত নয়, স্বাধীন বাংলাদেশে সোনার মানুষের সংখ্যা ক্ষীণ হয়ে আসছে-বুদ্ধিজীবীর দায়-দায়িত্ব-কর্তব্যবোধ ফিকে হয়ে আসছে।

দোহাই
১. শহীদ বুদ্ধিজীবী আনোয়ার পাশার পরিবার
২. আনোয়ার পাশা: ভূঁইয়া ইকবাল
৩. আনোয়ার পাশার জীবন কথা: ওয়াকিল আহমেদ
৪. শহীদ বুদ্ধিজীবী রাশীদুল হাসানের কন্যা-বিশিষ্ট রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী রোকাইয়া হাসিনা নীলি ও পরিবারের বৃন্দ
৫. জাতীয় জাদুঘর কর্তৃপক্ষ
৬. ড. এম এম শহিদুল হাসান

Comments

The Daily Star  | English

Rooppur Nuclear Power Plant: First unit to start production in Dec

One of the two units of the Rooppur Nuclear Power Plant will be commissioned this December if transmission lines are ready although the deadline for the project’s completion has been extended to 2027.

7h ago