পাঠকের আপনজন বুদ্ধদেব গুহ

বুদ্ধদেব গুহ। ছবি: সংগৃহীত

স্বজন হারানোর মতোই লেখককে হারিয়ে আবেগী হয়ে পড়েন পাঠক। বুদ্ধদেব গুহ তেমনই একজন। কারণ তিনি লেখার মাধ্যমে পাঠকের আপনজন হয়ে উঠেছিলেন।

রবিবার মধ্যরাতে কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হওয়ার পর মৃত্যুবরণ করেন বরেণ্য এই লেখক। বাংলা ভাষায় পরিবেশ, বন-আরণ্যকের রচয়িতা এই জাদুকর। যদিও বলা হয় অরণ্য দর্শন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের দখলে। তবু, পাঠকরা দু'জনকে একই ভুবনের বাসিন্দা বলেন। কিন্তু, বিভূতিভূষণ থেকে বুদ্ধদেব গুহ আলাদা। বিভূতিভূষণ প্রকৃতিকে ঐশী মহিমায় দেখতেন, আর বুদ্ধদেব দেখতেন প্রেমিকার মহিমায়।

একবার তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল- অনেকে আপনাকে বিভূতিভূষণের উত্তরসূরি বলেন, কিন্তু আপনি কী ভাবেন? জবাবে বুদ্ধদেব বলেছিলেন, বিভূতিভূষণ ওয়াজ আ সেন্টলি পার্সন। উনি ঈশ্বর হলে আমি বাঁদর! তবে, একটা কথা কী জানো, জীবন আর প্রকৃতি এদের আমি উল্টেপাল্টে দেখেছি।

কারণ, হিসেবে অন্যে এক জায়গায় বলেছিলেন, আসলে আমি খুব ভাগ্যবান। আমার মতো সাহসী ও শিকারি লাইফ খুব কম বাঙালি লেখকের ছিল বলে মনে করি। কারণ, আমি কলকাতায় জন্মালেও যেহেতু বাবা কলকাতায় থিতু ছিলেন সরকারি কাজের সূত্রে তাই শৈশবের কিছুটা কলকাতায় কাটলেও পরে আমি দেশের বাড়িতে ছিলাম। সেখানেই পাঠশালাতে পড়েছি। আমাদের বাড়ি ছিল রাজশাহীর কাছাকাছি রংপুরে। বোমা পড়ার সময় বাবা দেশের বাড়িতে পাঠালেন সেখানেই প্রকৃতির অভিঘাত আমার ওপর পড়তে থাকে, ফলে পাঠশালায় পড়া, জেলা স্কুলে পড়া। তারপর আমার এক পিসি ছিলেন, তার বাড়ি ছিল আসামে। রংপুর থেকে সেখানে যেতাম। আমার লেখাতেও এর উল্লেখ রয়েছে। নাগরিক লেখকরা মনে হয় না সেভাবে কেউ পাঠশালায় পড়েছেন আর কলকাতায় তো সেই প্রকৃতির অভিঘাতটা পাওয়া যায় না। তারপর আবার কলকাতায় আসা পরে বাবা বদলি হয়ে বরিশালে গেলেন, সেখানেও জেলা স্কুলে পড়েছি। বাবা বিভিন্ন সময়ে শিকারে যেতেন, পাখি শিকারে সঙ্গে যেতাম প্রায় ১০ বছর বয়স থেকেই।

এভাবে তার মানস তৈরি হয়। দেখে ঠেকে এগিয়েছে তার জীবন। তবু হাজারো মানুষের ভিড়ে নিঃসঙ্গ বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় এই লেখক। 'নিঃসঙ্গ' এই অর্থে যে তার সঙ্গে বাংলা সাহিত্যের আর কারো সুর তেমন মেলে না। বুদ্ধদেব গুহ পেশায় ছিলেন চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট। এছাড়া ধ্রুপদী সঙ্গীত ও ছবি আঁকায় দক্ষতা ছিল তার। তিনি সরকারি চাকরি ছেড়েছিলেন লেখালেখির জন্যে। তিনি মনে করতেন, লেখালেখিটা ফুলটাইমের কাজ।

এই ভাবনা ও অসামান্য কাজ তাকে সফলতা এনে দিয়েছে। প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ 'জঙ্গল মহল'। এরপর 'মাধুকরী', 'কোজাগর'র মতো একের পর এক উপন্যাস উপহার দিয়েছেন পাঠকদের। কলমে প্রাণ পেয়েছে 'ঋজু দ ঋভু'র মতো একাধিক চরিত্র। ক্রমান্বয়ে এক অন্য আরণ্যক রচনা করেছেন। তারপর পাঠক বুদ্ধদেবকে চিনেছেন শিকার কাহিনী বা অরণ্যপ্রেমিক হিসেবে। কিন্তু, শিকার বা অরণ্যকে ছাপিয়ে তার লেখায় ধরে রাখের এক বিশেষ সত্ত্বাকে, যার নাম 'প্রেমিক'। একই সঙ্গে প্রকৃতি ও নারীর প্রতি মোহ। তা মিলেমিশে একাকার। তিনি বিশ্বাস করতেন নারীকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না প্রকৃতি থেকে। আসলেই তাই...

বুদ্ধদেব গুহ ১৯৩৬ সালের ২৯ জুন কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। কিন্তু, শৈশব কেটেছে বাংলাদেশের বরিশাল ও রংপুরে। শৈশবের নানা অভিজ্ঞতা পরবর্তীতে তার লেখালেখিতে উঠে আসে। বাংলা ভাষায় বন, অরণ্য ও প্রকৃতিবিষয়ক লেখার জন্য পরিচিত। নারী ও বন বিষয়ে তার লেখা উপন্যাস ও ছোটগল্পগুলো ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। সমালোচকরা বলেন, বুদ্ধদেব 'ভালবাসাকে পুঁজি করে সাধারণ পাঠকের মন ছুঁতে চেয়েছিলেন। যৌনতার গা থেকে খুলে দিতে পেরেছিলেন ট্যাবুর পোশাক। শরীরী প্রেমে মিশিয়ে দিয়েছিলেন পবিত্রতার সুবাস।'

লেখকদের জীবন ও যাপিত জীবনের দর্শন নিয়ে কী ভাবেন তা নিয়ে এক প্রশ্নের উত্তর বলেছিলেন, আসলে লেখকদের বিয়ে করা উচিত নয় কারণ, উল্টোদিকের সাধারণ চাহিদারা বঞ্চিত হয়। ঋতু (তার স্ত্রী প্রখ্যাত রবীন্দ্রসংগীত গায়িকা ঋতু গুহ) নিজে খুব দৃঢ়চেতা মেয়ে, শিল্পী হিসেবে আদর্শ। একটু অন্যরকম হলে হয়তো অনেক কিছু করতে পারত কিন্তু কারও কাছে সে মাথা নত করেনি। আমি প্রচুর টাকা উপার্জন করেছি কিন্তু সময় দিতে পারিনি। আর তার মধ্যে আমি তো শুধু লেখক ছিলাম না; আমাকে অফিসের কাজ করতে হতো তারপর এসব মানুষদের মধ্যে লিখে সারভাইভ করা। ঋতুর নিজস্ব জায়গা ছিল আর অদ্ভুত দক্ষ ছিল তাই হয়তো সংসার ভাঙতে পারেনি। তবে এই সম্পর্ক, প্রকৃতি এরা না থাকলে আমি লেখক হতে পারতাম না। কিন্তু, তবুও আমার পা বাস্তবের মাটিতে ছিলো। তবে লেখক হওয়ার জন্য আমাকে অনেক শত্রুতা সহ্য করতে হয়েছে, যুদ্ধ করতে হয়েছে।

'বাসানাকুসুম', 'একটু উষ্ণতার জন্য', 'মাধুকরী' ছাড়াও পাঠকপ্রিয় উপন্যাসের মধ্যে আছে 'কোয়েলের কাছে' ও 'সবিনয় নিবেদন'। তার 'বাবা হওয়া' এবং 'স্বামী হওয়া'র ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে পুরস্কারজয়ী বাংলা চলচ্চিত্র 'ডিকশনারি'। শিশু সাহিত্যিক হিসেবেও জনপ্রিয় ছিলেন- তার জনপ্রিয় কাল্পনিক চরিত্র ঋজু'দা এবং তার সহযোগী রুদ্র। ১৯৭৭ সালে 'হলুদ বসন্ত' উপন্যাসের জন্য পান আনন্দ পুরস্কার।

জীবনের পাওয়া না পাওয়া নিয়ে বুদ্ধদেব গুহ বলেছিলেন, জীবনের প্রতি মুহূর্তকে আমি উপভোগ করেছি। আমার কোনো আক্ষেপ নেই। তবে দুঃখ আছে, গানটা যদি ভালো করে গাইতে পারতাম! সময় পাইনি মূলত। আর এক জীবনে কতো আর করা যায়, জীবনটা ছোট সেই অর্থে। তবে ভালো করে টেনিস খেললে, আমি হয়তো লিয়েন্ডার পেজই হতে পারতাম!

মৃত্যু ভাবনা নিয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে বুদ্ধদেব বলেছিলেন, 'মরণ রে তুহু মম শ্যাম সমান'! অনেক দৌড়েছি। সারা পৃথিবী ঘুরেছি, অনেক পেয়েছি, অনেক কাজ করেছি। এখন বিশ্রাম, শান্তির ঘুম পেতে ইচ্ছে করে। আমার আর কিছু চাইবার নেই, কোনো অভিযোগ নেই। তবে আমার লেখক জীবনে যারা আমার সঙ্গে অন্যায় করেছে সে লেখক হোক বা খবরের কাগজের সম্পাদক-মালিক যারাই হোক তাদের যেন ঈশ্বর ক্ষমা করেন। এখন যদি মৃত্যুর পর জানা যায় ঈশ্বর কে বা কী!

Comments

The Daily Star  | English

Vehicle sales plunged in 2024

This marked the steepest decline since the Covid-19 pandemic, when roughly 3.8 lakh vehicles were registered with the BRTA

12h ago