বাংলা কবিতার এক নিঃসঙ্গ শেরপা শামসুর রাহমান

শামসুর রাহমান। ছবি: সংগৃহীত

বাংলা কবিতাকে যিনি দিয়েছেন নাগরিক সত্ত্বা, এক ইচ্ছে, নতুন স্বপ্নের ও জাগরণের গল্প। বাংলা কবিতায় যিনি সৃষ্টি করলেন এক ভিন্ন জাতিসত্তার অভিধা। যার সুর আমরা পাই তার কবিতায়। বাংলাদেশ জন্মের পেছনে যার কবিতার জন্ম, সমস্ত গণআন্দোলনে যার কবিতা হয়ে উঠেছিল জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরির মতো। তার কবিতার মধ্য দিয়ে যেন বাঙালি ও বাংলাদেশ তার আত্মাকে খুঁজে পায় বারবার।
আইয়ুব খানকে বিদ্রুপ করে সমকাল পত্রিকায় 'হাতির শুঁড়' কবিতার মধ্য দিয়ে যে যাত্রার সূচনা। আইয়ুব শাসনামলে কারাগারে থাকা বঙ্গবন্ধুকে উদ্দেশ্য করে লেখা 'টেলেমেকাস'। ১৯৬৮ সালে যখন পাকিস্তানের সব ভাষার জন্য অভিন্ন রোমান হরফ চালু করার প্রস্তাব করেছিলেন আইয়ুব খান তার প্রতিবাদে এগিয়ে এলেন শামসুর রাহমানই। সৃষ্টি হলো 'বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা'।
পুলিশের গুলিতে আসাদের শহীদ হওয়ার পর রচিত 'আসাদের শার্ট'। সেই আসাদ বারবার পুনর্জীবিত হয়ে ফিরে এলো শামসুর রাহমানের কবিতার মধ্য দিয়ে। ১৯৭০ এর দুর্ভিক্ষে ঘূর্ণিদুর্গত দক্ষিণাঞ্চলের লাখ লাখ মানুষের দুঃখ-দুর্দশায় ও মৃত্যুতে কাতর তিনিই লেখেন 'আসুন আমরা আজ ও একজন জেলে'। মুক্তিযুদ্ধে যখন তিনি পিতৃভিটেতে বন্দিদশার মতো, ঠিক তখন রচিত হয় তার হাতে 'স্বাধীনতা তুমি' বা 'তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা'। এরশাদের স্বৈরশাসনের প্রতিবাদে দৈনিক বাংলার প্রধান সম্পাদকের পদ থেকে পদত্যাগ অতঃপর সৃষ্টি 'শৃঙ্খল মুক্তির কবিতা', 'স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে কবিতা', 'সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কবিতা' বা 'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কবিতা যেন এক প্রতিধ্বনির চিত্র। বাংলাদেশের জন্ম, বাংলাদেশের বেড়ে ওঠা, বাংলাদেশের দাঁড়ানো আর একই সঙ্গে শামসুর রাহমান যেন এক অভিন্ন সত্ত্বা। এ এক অনন্য বন্ধন। বাংলাদেশের স্বাধীনতায়, স্বাধিকারে শামসুর রাহমান ছিলেন এক নিঃসঙ্গ শেরপা। তার কবিতা আঘাত করেছে বুলেটের মতো। কবিতা হয়ে উঠেছিল মানুষের মিছিলে উদ্দীপ্ত মশালের মতো।
শামসুর রাহমান জানতেন বাংলাদেশ একদিন স্বাধীন হবে, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক নিপীড়ন থেকে মানুষ মুক্ত হবে এ স্বপ্ন একদিন বাস্তব হয়েছে। কতো ত্যাগের পর দেশ স্বাধীন হয়েছে, হয়েছে মুক্ত। শামসুর রাহমান জানতেন এই বন্দিদশা চূড়ান্ত নয়। শামসুর রাহমানের কবিতায় ছিল তারই আগমন ধ্বনি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাইতো বলেছিলেন, 'শামসুর রাহমানের সব রচনা বিশ্ব সাহিত্যের অন্তর্গত, কিন্তু তাঁর পা সব সময় গাঁথা থেকেছে স্বদেশের মাটিতে।'
সাপ্তাহিক সোনার বাংলা পত্রিকায় প্রথম তার কবিতার প্রকাশ। তারপর একে একে কবিতার তাগিদেই সিন্দবাদ, চক্ষুষ্মান, লিপিকার, নেপথ্যে, জনান্তিকে, মৈনাকসহ নানা ছদ্মনাম গ্রহণ। ১৯৬০ সালে 'প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে' কাব্যগ্রন্থ দিয়ে সূচনা প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের। গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকের শুরুতে শামসুর রাহমান যখন কাব্যচর্চা শুরু করেন তখন বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির ওপর নানা ধরনের রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন-নিষ্পেষণ চলছে। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে খণ্ডিতকরণ, ভাষার বিকৃতিসাধন , রবীন্দ্রনাথ তথা গোটা রবীন্দ্র সাহিত্যকে বর্জন করা থেকে নজরুল সাহিত্যকে সংশোধন, এমনকি বাঙলা বর্ণমালা বদলে ফেলার কদর্য তৎপরতা চলছিল। যেমন- 'সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি, সারাদিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি' কবিতাটি 'অগত্য নাম্নী পত্রিকায় তমুদ্দনি বাঙলা ভাষায় ছাপা হলো 'ফজরে উঠিয়া আমি দিলে দিলে বলি, হররোজ আমি যেন আচ্ছা হয়ে চলি।' 
বাঙালিরা তখন তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে এর প্রতিবাদ এবং সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। আর এই সাংস্কৃতিক-সাম্প্রদায়িক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ছিলেন শামসুর রাহমান। সমস্ত কূপমণ্ডূকতার বিরুদ্ধে যিনি দাঁড়িয়েছিলেন বিরুদ্ধ স্রোত উপেক্ষা করে।
শামসুর রাহমানের জন্ম ঢাকার মাহুতটুলির নানাবাড়িতে হলেও তিনি শৈশবের কিছুটা সময় কাটিয়েছিলেন তার পৈতৃক ভিটে নরসিংদীর পাড়াতলী গ্রামে। কিন্তু তার বাকি জীবন কেটেছে ঢাকায়, তার সমস্ত সাহিত্য যাত্রা, সমস্ত জীবন, স্বপ্ন, উচ্ছ্বাস, সংগ্রাম সবকিছুই পালাবদল হয়েছে ঢাকাকে ঘিরে। যে ঢাকাকে শামসুর রাহমান বলেছিলেন আমার ঢাকা, আমার নগর। সেই ঢাকাও তাকে আপন করে নিয়েছিল। সেই শহর ঢাকার বৃষ্টি, জল হাওয়া, পল্টনের ময়দান, রেসকোর্সের মাঠ, বিউটি বোর্ডিং, পুরান ঢাকার দালান, অলিগলি রাজপথ, মিছিল, দুহাতে কাঁপুনি তোলা চির সংগ্রাম যেন আঁকড়ে রেখেছিল তাকে।
জীবনে তিনি আপোষ করেননি অন্যায়ের সঙ্গে। টলেননি, বিচ্যুত হননি এক ইঞ্চিও নিজের আদর্শ থেকে। তার লেখা 'সাহিত্য সাধনার পঁচিশ বছর' পড়তে গিয়ে বোঝা যায় তিনি কতোটা আত্মসম্মানবোধ ও অটল প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। শামসুর রাহমান লিখেছিলেন তেমনই এক আক্ষেপের কথা।
'আমি লেখার জন্য প্রথম পাঁচ টাকা পাই। তা-ও বেশ জোরাজুরি করে। দিলরুবা বলে একটা পত্রিকা ছিল। তাতে আমার কবিতাটি ছাপা হয়েছিল। আমি একদিন সকালে দিলরুবার সম্পাদকের বাসায় গেলাম। তিনি তখন উচ্চস্বরে কোরআন শরীফ পাঠ করছেন। কোরআন শরীফ পাঠের পর আমি বললাম যে, ওনাকে খবর দিন আমি এসেছি। খবর পেয়ে তিনি এসে বললেন, কী চান? আমি বললাম যে আমি আমার লেখার টাকা নিতে এসেছি। 
লেখার জন্য টাকা?
এটা শুনে তিনি খুব বিস্মিত এবং যেন একটু ক্রুদ্ধও হলেন। আমি বললাম যে হ্যাঁ টাকা তো দিতে হবে। আমি এটাও বললাম, আমি যদিও তখন খুব বেশি কথা বলতে পারতাম না, তোতলালাম এবং খুবই ইতস্তত করতাম কী বলতে কী বলে ফেলবো, ভয় থাকত সবসময়।
তবুও কে যেন আমার ভিতর থেকে বলে দিল যে আপনি পত্রিকা বের করছেন, কাগজ কিনছেন, কাগজ ছাপাচ্ছেন, সেটা বাজারে বিক্রি হচ্ছে, টাকা খরচ করছেন, আমি লিখছি- আমার লেখা নিয়ে বই বেরুচ্ছে, আমাকে টাকা দেবেন না? তো তিনি বোধহয় আমার যুক্তিতে একটু টললেন। বললেন, পাঁচ টাকার বেশি আমি দেবো না। আমি বললাম ঠিক আছে, আমি তা-ই নেব। সে যা-ই হোক পাঁচ টাকা নিয়ে আমি বাসায় ফিরলাম।
আমি তো কোনো চ্যারিটেবল ডিসপেনসারি খুলে বসিনি। আমাকে শ্রম দিতে হচ্ছে। আমাকে কষ্ট করে লিখতে হচ্ছে। আমাকে কাগজ কিনতে হচ্ছে। একটা কলম কিনতে হচ্ছে। যদি ফাউন্টেন পেন না থাকে দোয়াত–কলম কিনতে হচ্ছে, তা আমাকে খরচ তো কিছু করতে হচ্ছে। তার বিনিময়ে আমি সম্মানী পাব না কেন?'
নিজের প্রথম কবিতার সম্মানীর কথা এভাবেই ক্ষোভের সঙ্গেই বলেছিলেন তিনি। সেই কৈশোর থেকেই ছিলেন আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন। প্রাপ্যে কখনো ছাড় দিতে বলতেন না। লেখকের পারিশ্রমিকের বিষয়ে ছিলেন আজীবন সোচ্চার।
শামসুর রাহমান কেবল কবিতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেননি। তিনি পথে নেমেছেন, দাঁড়িয়েছেন সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনে, লেখকের স্বাধীনতার পক্ষে, ধর্মান্ধতা আর উগ্রবাদের বিরুদ্ধে। এজন্য কম ঝক্কি আসেনি তার জীবনে। ঢাকার শ্যামলীর বাড়িতে ঢুকে তাকে হত্যাচেষ্টাও হয়েছিল। তবু শামসুর রাহমান দমেননি। তিনি তো দমার পাত্র নন।
হুমায়ুন আজাদ যেন যথার্থই লিখেছিলেন 'নিঃসঙ্গ শেরপা: শামসুর রাহমান' এ, 'শামসুর রাহমান বাহ্যজগত ও সমকাল ও অব্যবহিত প্রতিবেশকে শুষে নেন আপন অভ্যন্তরে, এবং তাঁর কবিতা ধ্যান বা স্তব বা গান বা শাশ্বত শ্লোকের বদলে হয়ে ওঠে সমকালীন জীবনসৃষ্টি। ওই কবিতা হঠাৎ আলোর ঝলক, শান্ত স্নিগ্ধতা, প্রশান্তির বদলে সঞ্চার করে বিশশতকের দ্বিতীয়াংশে বসবাসের তাপ-জ্বালা-দাহ।'
আজ বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি শামসুর রাহমানের প্রয়াণ দিবস। বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই বাংলা কবিতার এই কিংবদন্তি কবির প্রতি।
সূত্র- 
সাহিত্য সাধনার পঁচিশ বছর/ শামসুর রাহমান 
নিঃসঙ্গ শেরপা: শামসুর রাহমান/ হুমায়ুন আজাদ
শামসুর রাহমানের শ্রেষ্ঠ কবিতা

আহমাদ ইশতিয়াক [email protected]
 

Comments