অক্সিজেন বিষয়ে তৎপর হয়েছে সরকার

সরকার অক্সিজেন সরবরাহকারীদের সরবরাহ বাড়াতে বলেছে এবং একইসঙ্গে  হাসপাতালগুলোতে জীবন রক্ষাকারী অক্সিজেনের অপচয় কমানোর পরিকল্পনা করছে। কোনো কেন্দ্রীয় অক্সিজেন ব্যবস্থা নেই এমন হাসপাতালগুলোতে প্রেসার সুইং অ্যাডজর্পসন অক্সিজেন জেনারেটর স্থাপনেরও পরিকল্পনা করা হচ্ছে। 
স্পেশাল অক্সিজেন ট্রেন থেকে ট্যাংকারে অক্সিজেন ভরা হচ্ছে। গতকাল সিরাজগঞ্জে বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিমপাড় থেকে তোলা ছবি। ভারত থেকে প্রথমবারের মতো ট্রেনে করে অক্সিজেন আমদানি করা হয়। ছবি: স্টার

সরকার অক্সিজেন সরবরাহকারীদের সরবরাহ বাড়াতে বলেছে এবং একইসঙ্গে  হাসপাতালগুলোতে জীবন রক্ষাকারী অক্সিজেনের অপচয় কমানোর পরিকল্পনা করছে। কোনো কেন্দ্রীয় অক্সিজেন ব্যবস্থা নেই এমন হাসপাতালগুলোতে প্রেসার সুইং অ্যাডজর্পসন অক্সিজেন জেনারেটর স্থাপনেরও পরিকল্পনা করা হচ্ছে। 
এ ছাড়া, সারাদেশে অক্সিজেন সরবরাহের অবস্থা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করার লক্ষ্যে কর্মকর্তাদের জন্য একটি কেন্দ্রীয় ড্যাশবোর্ড খুলেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
এসব ব্যবস্থা এমন একটি সময়ে নেওয়া হচ্ছে, যখন কোভিড-১৯ সংক্রমণ ও সংক্রমিতদের হাসপাতালে ভর্তির সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। সঙ্গে হাসপাতালগুলোতে অক্সিজেনের চাহিদাও বাড়ছে। 
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, গত শনিবার হাসপাতালগুলোতে তরল অক্সিজেনের চাহিদা ছিল ২৩০ টন। ঈদের ছুটির আগে এ চাহিদা দৈনিক গড়ে ২১০ টন থেকে ২২০ টনের মধ্যে ছিল। 
বর্তমানের বাড়তি চাহিদা ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, ঈদে বিধিনিষেধ শিথিল করার কারণে সংক্রমণ ও মেডিকেল অক্সিজেনের চাহিদা বাড়ার যে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞরা করেছিলেন, তা ঠিক ছিল। 
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ বি এম খুরশীদ আলম গতকাল রোববার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সংক্রমণ বাড়ার আশঙ্কা থেকে আমরা অক্সিজেন উৎপাদক ও সরবরাহকারীদের বলেছিলাম, সঠিকভাবে অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য তাদের প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়া হবে।' 
ঈদের আগে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা অক্সিজেন সরবরাহকারীদের সঙ্গে বৈঠক করেন এবং তাদেরকে উৎপাদন ও সরবরাহ বাড়ানোর অনুরোধ করেন। 
পাশাপাশি, সরকারি ও বেসরকারি কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালে অক্সিজেন সরবরাহ সমন্বয় করতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক সামিউল ইসলামের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক জানিয়েছেন, সদ্য চালু হওয়া ড্যাশবোর্ডে কর্মকর্তারা হাসপাতালের পরিস্থিতি সম্পর্কে লাইভ আপডেট পাবেন এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারবেন। 
সামিউল ইসলাম জানিয়েছেন, সারাদেশের ৮৫টি হাসপাতালে তরল অক্সিজেন ট্যাঙ্ক ব্যবহারকারী কেন্দ্রীয় সরবরাহ ব্যবস্থা ব্যবহার করা হচ্ছে। আরও ২৫টি হাসপাতালে এ ব্যবস্থা চালু করার কাজ চলছে। উপজেলা পর্যায়ের ৩৫৩টি হাসপাতালে অক্সিজেন সিলিন্ডার সরবরাহ করা হচ্ছে।
স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের দেওয় তথ্য অনুসারে, দেশে বর্তমানে তরল অক্সিজেন সরবরাহের দৈনিক সক্ষমতা ২৪৫  টন, যার ৭০ শতাংশই স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হয়।
সরকার অক্সিজেন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান লিন্ডেকে রেলপথে প্রতিদিন ২৪০ টন অক্সিজেন আমদানি করতে সহায়তা করছে। এ ছাড়া, সিঙ্গাপুর থেকে জাহাজে অক্সিজেন আমদানি করতে স্পেকট্রাকে সহায়তা করা হচ্ছে। 
'তবে, আমাদের ফোকাস স্থানীয় উৎপাদনের দিকে। দেশে নিজস্ব অক্সিজেন প্ল্যান্ট স্থাপনে শিল্পপতিদের উৎসাহিত করার চেষ্টা করছি আমরা', সামিউল বলেন।
এ ছাড়া, অক্সিজেন সরবরাহকারীদের প্রতিটি জেলার সরকারি হাসপাতালগুলোর কাছাকাছি স্থানে অক্সিজেন রিফিলিং স্টেশন স্থাপন করার নির্দেশনা দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। 
দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে মূল অক্সিজেন সরবরাহকারী লিন্ডে বাংলাদেশ গতকাল প্রথমবারের মতো ভারত থেকে রেলপথে ২০০ টন মেডিকেল অক্সিজেন আমদানি করেছে। ভারতের জমশেদপুর থেকে বেনাপোল হয়ে লিন্ডে ভারত ও ভারত সরকারের উদ্যোগ 'অক্সিজেন এক্সপ্রেসে' করে অক্সিজেনের দশটি ট্যাঙ্কার দেশে পৌঁছেছে।  
সাধারণত ভারত থেকে অক্সিজেন আমদানি করা হয় সড়কপথে। লিন্ডে ভারতের এক মুখপাত্র জানিয়েছেন, বাংলাদেশের চাহিদা মেটাতে লিন্ডে রেলপথে অক্সিজেন আমদানি অব্যাহত রাখবে। 
লিন্ডের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তাদের কোম্পানি বাংলাদেশে অবস্থিত দুটি প্ল্যান্টে প্রতিদিন প্রায় ৯০ টন তরল অক্সিজেন উৎপাদন করে থাকে। 
স্পেকট্রাও সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে প্রতিদিন প্রায় ৯০ টন অক্সিজেন সরবরাহ করে। ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে তারা জাহাজে করে সিঙ্গাপুর থেকে অক্সিজেন আনবে বলে সরকারকে জানিয়েছে। 
চট্টগ্রামভিত্তিক ইস্পাত উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান আবুল খায়ের গ্রুপ ও জিপিএইচ ইস্পাতও গত বছর থেকে তরল মেডিকেল অক্সিজেন উৎপাদন করে আসছে।
আবুল খায়ের গ্রুপের প্ল্যান্টের জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক ইমরুল কাদের ভূঁইয়া গতকাল দ্য ডেইলি স্টারকে বলেছেন, 'আমরা এখন দিনে প্রায় ৩০ টন মেডিকেল অক্সিজেন উৎপাদন করছি। দুই মাসের মধ্যে এ প্ল্যান্টের দৈনিক উৎপাদন বেড়ে ৫০ টন হতে পারে।' 
অন্যদিকে জিপিএইচ ইস্পাত বর্তমানে দিনে ২৫ থেকে ৩০ টন অক্সিজেন উৎপাদন করছে। 
জিপিএইচ ইস্পাতের অক্সিজেন প্ল্যান্টের প্রধান নাজমুল ইসলাম বলেন, 'দৈনিক উৎপাদন ক্ষমতা বাড়িয়ে  ৪০ টন করা যেতে পারে। '
দুটি কোম্পানির কর্মকর্তারাই জানিয়েছেন, তারা এখনো সরকারি হাসপাতালে সরাসরি অক্সিজেন বিক্রি করছেন না।
এদিকে, আরেকটি ইস্পাত উৎপাদক সংস্থা কেএসআরএম গত ১৮ জুলাই সিলিন্ডারে ব্যবহারের জন্য প্রায় ২৪ হাজার ঘনমিটার অক্সিজেন উৎপাদনে সক্ষম একটি প্ল্যান্ট চালু করেছে।
অক্সিজেনের অপচয় 
সামিউল ইসলাম বলেন, 'এক্ষেত্রে মূল বিষয় হচ্ছে অক্সিজেনের যথাযথ ব্যবহারের অভাব। হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলাতে অনেক অক্সিজেন নষ্ট হয়।'
অক্সিজেন অপচয় কমিয়ে আনতে সরকার কন্টিনিউয়াস পজিটিভ এয়ারওয়ে প্রেসার (সিপিএপি) ব্যবহারের কথা বিবেচনা করছে। 
'আমরা যদি যুক্তিযুক্তভাবে অক্সিজেন ব্যবহার করি, তবে অক্সিজেন রিজার্ভের ওপর চাপ কম হবে এবং সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন হবে। অপচয় কমাতে সরকার ব্রিদিং মাস্কের ব্যবহারকেও উৎসাহিত করছে' উল্লেখ করেন সামিউল। 
'পাশাপাশি, ঘরের বাতাসে ছড়ানো অক্সিজেন আগুনের কারণ হতে পারে। আমরা ঢাকা ও টাঙ্গাইলে এমন দুর্ঘটনা দেখেছি', তিনি যোগ করেন। 
সম্প্রতি স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, সিপিএপি ব্যবহারে দিনে ১০০ টন পর্যন্ত তরল অক্সিজেন বাঁচানো যায়। তিনি চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া অক্সিজেন ব্যবহার না করারও আহ্বান জানিয়েছেন সবার প্রতি। কারণ, বাড়িতে অক্সিজেন সিলিন্ডার রাখা ঝুঁকিপূর্ণ।
সিপিএপি ব্যবহারের বিষয়ে কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালের ক্রিটিক্যাল কেয়ার বিভাগের প্রধান মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান বলেন, 'চিকিৎসক ও নার্সদের এসব যন্ত্রপাতি চালানোর প্রশিক্ষণ দিতে হবে। রোগীর শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল না হলে যন্ত্রগুলো কিছুক্ষণ পরপর অ্যাডজাস্ট করতে হয়। সিপিএপি ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে, প্রশিক্ষণের বিকল্প নেই।' 
যেসব হাসপাতালে কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা নেই, সেসব হাসপাতালে  সরকার অক্সিজেন জেনারেটর স্থাপন করবে। 
সামিউল বলেন 'আমরা গ্লোবাল হেলথ ফান্ড থেকে ২৯টি মেশিন পাচ্ছি। কর্তৃপক্ষ কিনছে আরও ৪০টি । তবে মেশিনগুলো স্থাপনে সময় লাগবে।'
অবশ্য স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা বলছেন, মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চললে এসব প্রচেষ্টায় তেমন ফলাফল পাওয়া যাবে না। 
ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন জারীন তাসনিম। 

 

Comments

The Daily Star  | English

Taka to trade more freely by next month

Bangladesh will introduce a crawling peg system by next month to make the exchange rate more flexible and improve the foreign currency reserves, a key prescription from the International Monetary Fund.

3h ago