সাধারণের টিকা প্রাপ্তি ও ‘কেন বুস্টার ডোজ’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুসারে, গত ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে করোনাভাইরাসের টিকার প্রথম ডোজ পেয়েছেন ৬ কোটি ৯৯ লাখ ৪২ হাজার ৮৭৪ জন। যা লক্ষ্যমাত্রার ৫০ দশমিক ৫৯ শতাংশ। ২ ডোজ টিকা পেয়েছেন ৪ কোটি ৮১ লাখ ৬১ হাজার ৬১০ জন। যা লক্ষ্যমাত্রার ৩৪ দশমিক ৮৪ শতাংশ।

গত ১৪ ডিসেম্বর প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) এশিয়ার ৪৪টি দেশ-অঞ্চলে টিকাদানের হিসাব তুলে ধরে বলেছে, এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান ৩৫তম।

এ ছাড়া শুরুতে করোনার টিকা পাওয়ার অগ্রাধিকারের তালিকায় করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে থাকা সম্মুখ সারির কর্মীদের পাশাপাশি ছিলেন ষাটোর্ধ বয়সী মানুষ। দেশে এই বয়সী মানুষ আছেন ১ কোটি ৩১ লাখ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ১৬ ডিসেম্বরের তথ্য বলছে, দেশে এই বয়সীদের ৩৭ শতাংশ মানুষ এখনো টিকার প্রথম ডোজই পাননি। অথচ করোনায় মৃত্যু ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি ৬০ বছর ও তার বেশি বয়সী মানুষের।

এ অবস্থায় গত ১৯ ডিসেম্বর থেকে পূর্ণ ২ ডোজ টিকা পাওয়া এই বয়সী ও সম্মুখ সারির কর্মীদের তৃতীয় বা বুস্টার ডোজ দিতে শুরু করেছে সরকার।

বিষয়টি নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে কোভিড-১৯ সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ এবং পরামর্শক কমিটির সদস্য ও স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সভাপতি অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলানের সঙ্গে।

এ ক্ষেত্রে বুস্টার ডোজ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন এই বিশেষজ্ঞরা। কেউ বলেছেন, দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষকে যেখানে টিকার আওতায় আনা যায়নি, সেখানে বুস্টার ডোজ চালুর ব্যাপারটি অযৌক্তিক। এটি নিয়মিত টিকা কার্যক্রমকে ব্যাহত করবে। আবার কেউ বলছেন, বুস্টার ডোজের দরকার আছে। তবে ঝুঁকিতে থাকা বেশির ভাগ মানুষকে টিকার আওতায় আনার প্রচেষ্টায় জোর দিতে হবে।

এ বিষয়ে অধ্যাপক নজরুল ইসলামের বক্তব্য, ৬০ বছরের ঊর্ধ্বে যারা আছেন তাদের অনেকেই এখনো টিকার প্রথম ডোজই পাননি। এটা আমাদের বিরাট একটা ঘাটতি। কিন্তু যাদের বুস্টারের সময় হয়েছে তাদের এটি দেওয়া হোক।

এই অধ্যাপক বলেন, 'আমরা সবাই জানি, আমাদের দেশের জনসংখ্যা অনেক বেশি। সে অনুসারে ব্যবস্থাপনার স্ট্রেন্থ কম। হেলথ সার্ভিস সেভাবে অ্যাকুরেট না, কোনো সার্ভিসই না। সব জায়গাতেই আমাদের ঘাটতি আছে।'

'ঘাটতি আছে বলেই সব বন্ধ থাকবে বিষয়টা এ রকম না। যতটুকু সার্ভিস আমরা দিতে পারি তা দিয়ে যাব।'

তিনি বিষয়টি 'ইতিবাচকভাবেই' দেখেছেন জানিয়ে আরও বলেন, 'এক জায়গায় ঘাটতি আছে বলে অন্যরা সেটা অ্যাভেইল করবে না, এটা ঠিক না। তবে এর পাশাপাশি নিয়মিত টিকা কার্যক্রমকেও জোরদার রাখতে হবে। ওখানে বাঁধ ভেঙেছে বলে এখানে সারাবো না বিষয়টা এমন না। যেখানে যতটুকু আছে আমরা করে যাব।'

অবশ্য এ ব্যাপারে একেবারেই ভিন্নমত পোষণ করেন অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ। তিনি বলেন, 'এটা (বুস্টার ডোজ চালু) ঠিক হলো না। আমাদের মূল অ্যাটেনশনটা ডাইভার্ট হয়ে গেল।'

এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের অভিমত, 'আমাদের ৮০ ভাগ লক্ষ্যমাত্রা যখন পূরণ হবে তখন বুস্টার ডোজ শুরু করা উচিত। এখন আমাদের ৮০ ভাগ পূরণ হওয়া তো দূরের কথা, মাত্র ২৫ থেকে ২৬ ভাগ মানুষ ২ ডোজ টিকা পেয়েছেন। সেক্ষেত্রে ২ ডোজ শেষ করার পরে দরকার ছিল বুস্টার ডোজ শুরু করা।'

এর কারণ হিসেবে এই অধ্যাপক বলেন, 'আমরা যখন বুস্টার ডোজ শুরু করলাম, তখন যারা ১ ডোজ টিকাও পায়নি কিংবা বয়স্ক মানুষ- তাদের প্রতি যতটুকু মনোযোগে দেওয়া উচিত সেটা আমরা দিতে পারব না। কেননা আমাদের তো একই লোক। যারা পরিকল্পনা করবে (অধিদপ্তর), সেই একই লোকেরা মাঠে টিকা দেবে, আবার একই লোক হেলথ ম্যানেজার (সিভিল সার্জন)। তারা যখন অন্যদিকে বেশি মনোযোগ দেবে তখন আসল জায়গার মনোযোগটা কমে যাবে।'

বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি আরও বলেন, 'বুস্টার ডোজ দিয়ে আমাদের বেনিফিট হবে ৫ থেকে ১০ শতাংশ, ১ ডোজ দিয়ে বেনিফিট হবে ৪০ শতাংশ, ২ ডোজ দিলে বেনিফিট হবে ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ। তাহলে কোনটা গ্রহণ করা উচিত?'

টিকাদান প্রক্রিয়া যেভাবে এগোচ্ছে তাতে আগামী মার্চের দিকে যদি অন্য ২ বারের মতো সংক্রমণ ব্যাপকভাবে বাড়তে শুরু করে, তখন অনেক মানুষ অরক্ষিত থেকে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন বে-নজির আহমেদ। বলছেন, 'এ ক্ষেত্রে বুস্টারের দিকে যাওয়াটা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে গেল।'

এ ছাড়া তার পর্যবেক্ষণ হলো, 'কেবল অন্য দেশেরটা দেখেই কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত না। ইসরায়েল এখন চতুর্থ ডোজে যাবে। আমরাও যদি এখন বুস্টারের পর চতুর্থ ডোজ চিন্তা করি তাহলে তো সেটা ঠিক হবে না। কেননা ইসরায়েলের সিচুয়েশনটা আলাদা। কারণ তারা বুস্টার শেষ করেছে।'

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক এই পরিচালক বলেন, 'আমরা যেখানে প্রথম ডোজই দিতে পারলাম না, সেখানে বুস্টার ডোজের চিন্তাটাই অলীক। এটা আদৌ ঠিক হচ্ছে না। সবাইকে বেশি ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিলাম আমরা।'

দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে আলাপকালে দেশে বুস্টার ডোজ চালুর বিষয়ে কিছু ব্যাখ্যা দেন স্বাচিপ সভাপতি অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান। তার ভাষ্য, ২টি প্রেক্ষাপটে সরকার এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

তিনি বলেন, 'কিছু মানুষ সরকারি সিদ্ধান্ত আসার আগেই ব্যক্তিগত যোগাযোগের মাধ্যমে সরকারি-বেসরকারি পর্যায় থেকে বুস্টার ডোজ নেওয়া শুরু করেছিল। দ্বিতীয় প্রেক্ষাপট হচ্ছে, আমাদের সরকার যে টিকা আমদানি করছে বা পাচ্ছে তার তো একটা মেয়াদ আছে।'

'দেখা যাচ্ছে যে পরিমাণ টিকা আসছে, সে অনুপাতে মানুষ টিকা নিচ্ছে না। টিকা থাকলেও নেওয়ার মানুষ পাওয়া যাচ্ছে না। এখন টিকার মেয়াদ যদি পার হয়ে যায় তাহলে তা নষ্ট হবে। রাষ্ট্রের টাকা, অনুদানের টাকা কিংবা ঋণের টাকা নষ্ট হবে।'

এসব কারণেই জাতীয় পরামর্শক কমিটির পক্ষ থেকে স্বাভাবিক টিকাদান কার্যক্রম অব্যাহত রেখে সম্মুখ সারির যোদ্ধাদের পাশাপাশি ঝুঁকিপূর্ণ বয়সী ও আগ্রহীদের বুস্টার ডোজ দেওয়া যেতে পারে বলে সুপারিশ করা হয়েছিল বলে জানান তিনি।

তিনি আরও বলেন, 'সরকারকে অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে, বুস্টার ডোজ দিতে গিয়ে স্বাভাবিক কার্যক্রম যেন কোনো অবস্থাতেই ব্যাহত না হয়।'

Comments

The Daily Star  | English
rohingya-migration

Rohingyas fleeing Arakan Army persecution

Amid escalating violence in Myanmar’s Rakhine State, Rohingyas are trespassing into Bangladesh every day, crossing the border allegedly to escape the brutality of Myanmar’s rebel group, the Arakan Army (AA).

7h ago