নিউইয়র্কে প্রথমবারের মতো লালন উৎসব

যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে প্রথমবারের মতো লালন উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র লালন পরিষদ আয়োজিত টানা প্রায় ১১ ঘণ্টার এই বর্ণাঢ্য উৎসবে ছিল লালনপ্রেমী প্রবাসী বাংলাদেশিদের উপড়েপড়া ভিড়।
উপস্থিতদের মতে, জাঁকজমকপূর্ণ এই আয়োজনের মধ্য দিয়ে উত্তর আমেরিকায় লালনচর্চার এক নতুন মাত্রা যোগ হলো।
উৎসবের পরিবেশনা এমনভাবে সাজানো হয়েছিল যেন সব বয়সী দর্শক-শ্রোতার লালনের গান এবং তাঁর জীবন ও দর্শনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে পরিচিত হতে পারেন।
নিউইয়র্ক ও আশপাশের প্রবাসী বাংলাদেশি বাউল সংগীতশিল্পীরা উৎসবে যোগ দেন।
গত রোববার বেলা ৩টায় জ্যামাইকা পারফরমিং আর্টস সেন্টারে খোলা আকাশের নিচে মঙ্গল প্রদীপ জ্বালিয়ে ও বেলুন উড়িয়ে নিউইয়র্কে প্রথমবারের মতো লালন উৎসবের উদ্বোধন করেন লালন সংগীতের কিংবদন্তী শিল্পী ফরিদা পারভীন, সঙ্গে ছিলেন বরেণ্য বংশীবাদক গাজী আবদুল হাকিম।

ভারতীয় চিত্রনির্মাতা ও নাট্য ব্যক্তিত্ব সুমন মুখোপাধ্যায় পরিচালিত ও সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায় অভিনীত 'ম্যান অব দ্য হার্ট' মঞ্চ নাটকের ভিজ্যুয়াল স্ক্রিনিংয়ের মাধ্যমে মূল অনুষ্ঠান শুরু হয়।
এতে ঊনবিংশ শতকের সুফি সাধক লালনের জীবন ও কর্মকথা, গান ও অভিনয়ের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়। অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন নাট্য ব্যক্তিত্ব রেখা আহমেদ ও গার্গী মুখার্জী।
এছাড়া ড. জিয়াউদ্দিন আহমদ পরিচালিত একটি সংক্ষিপ্ত তথ্যচিত্রে লালনের পরিচিতি তুলে ধরা হয়। লালনের জীবন ও দর্শন নিয়ে সেমিনারে বিশেষজ্ঞরা 'সমকালীন বিশ্বে লালন কেন গুরুত্বপূর্ণ' তা তুলে ধরেন।
হাসান ফেরদৌসের সঞ্চালনায় মূল বক্তা ছিলেন ফরিদা পারভীন, গাজী আবদুল হাকিম ও গোলাম সারোয়ার হারুন।
বক্তারা বলেন, লালন ছিলেন অতি সাধারণ মানুষ। সারা জীবন সাধারণ একজন মানুষের মতো জীবনযাপন করেছেন। তাঁকে নিয়ে যে বাড়াবাড়ি, 'সাঁইজি বেঁচে থাকলে তা কখনোই পছন্দ করতেন না।
অনুষ্ঠানে দ্বিতীয় একটি সেমিনারে ক্যাথলিক পাদরি ফাদার মারিনো রিগনের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়। দীর্ঘদিন বাংলাদেশে অবস্থানের সময় তিনি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক লালনগীতি ইতালীয় ভাষায় অনুবাদ করেন । শুভ রায়ের সঞ্চালনায় সেমিনারে আলোচনা করেন রথীন্দ্রনাথ রায়, বেলাল বেগ, ডা. জিয়া উদ্দীন আহমেদ ও ফাহিম রেজা নূর।

অনুষ্ঠানে সবার দৃষ্টি কেড়ে নেয় নতুন প্রজন্মের ছয় প্রতিনিধির অংশগ্রহণে শেষ সেমিনার । সায়ান নিবিড় শারমিনের সঞ্চালনায় সেমিনারটিতে আলোচক ছিলেন জারিন মাইশা, আলভান চৌধুরী, সাগ্নিক মজুমদার, জনম সাহা ও সামিয়া ইসলাম।
নিজের শিকড়ে ফিরে যেতে লালন তাঁদের ব্যাপকভাবে সাহায্য করেছেন বলে জানান তারা।
উৎসবটিতে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে বাংলাদেশি আমেরিকান আর্টিস্ট ফোরামের আয়োজনে ২১ প্রবাসী শিল্পীর ছবি দিয়ে সাজানো চিত্র প্রদর্শনী 'অচিন পাখির খোঁজে। এটি উদ্বোধন করেন বরেণ্য সাংবাদিক সৈয়দ মোহাম্মদ উল্লাহ। বিশেষ অতিথি ছিলেন আজকালের প্রধান সম্পাদক মনজুর আহমদ, ঠিকানার প্রধান সম্পাদক মুহম্মদ ফজলুর রহমান ও বাঙালী সম্পাদক কৌশিক আহমেদ, কানাডার দেশে-বিদেশে পত্রিকার সম্পাদক নজরুল মিন্টো। এতে উপস্থিত ছিলেন ফোরামের সভাপতি আর্থার আজাদ ও সাধারণ সম্পাদক বিশ্বজিৎ চৌধুরী।
প্রবাসে যে লালনের গানের চর্চা অব্যাহত রয়েছে তার প্রমাণ ছিল বিশিষ্ট গায়ক শাহ মাহবুবের গ্রন্থনা ও নির্দেশনায় সংগীতানুষ্ঠান 'সাঁইর বারামখানা'। হাসানুজ্জামান সাকীর পরিকল্পনায় আশাজাগানিয়া এ অনুষ্ঠানে অবিকৃত লালনকে আবিষ্কারে নতুন ও প্রবীণ শিল্পীদের আগ্রহ সবাইকে মুগ্ধ করে।
সাঁইর বারামখানায় সংগীতে কণ্ঠ দেন মেলাল শাহ, করিম হাওলাদার, চন্দন চৌধুরী, লিমন চৌধুরী, শাহ মাহবুব, কৃষ্ণা তিথি, রিপন রহমান, রবিন খান, কানিজ দীপ্তি, জারিন মাইশা, আলভান চৌধুরী, সাগ্নিক মজুমদার ও সামিয়া ইসলাম। যন্ত্র সংগীতে ছিলেন শহীদ উদ্দিন, তপন মোদক, সাইফুল মিঠু, শফিক মিয়া, জহির উদ্দিন লিটন ও সজীব মোদক। ধারা বর্ণনা করেন সাদিয়া খন্দকার, শামসুন্নাহার নিম্মি ও স্বাধীন মজুমদার।
প্রবাসের খ্যাতিমান শিল্পী তাজুল ইমামের লালনের নির্বাচিত গানের পরিবেশনা এবং পশ্চিমবঙ্গের শিল্পী পার্থসারথি মুখোপাধ্যায় রচনা ও সুর সংযোজন এবং অনিন্দিতা মুখোপাধ্যায় নৃত্য নির্দেশনায় ভারতীয় কলাকেন্দ্রের পরিবেশনা 'বুকের মাঝে লালন' গীতিনৃত্য আলোখ্য সবাইকে মুগ্ধ করে। অবন্তিকা মুখার্জীর ধারা বর্ণনায় নৃত্যশিল্পীরা হলেন দেবদীপা ঘোষ, ইন্দ্রানী বসু, মৌমিতা ধর ও অনিন্দিতা মুখোপাধ্যায়। মঞ্চে সহযোগিতা করেন সুদীপ্তা ঘোষ।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পারফরমিং আর্টস-বিপার পরিবেশনা 'সহজ মানুষ' এর নির্দেশনা দেন সেলিমা আশরাফ
ও অ্যানি ফেরদৌস। নিলুফার জেরিনের উপস্থাপনায় সংগীতে ছিলেন জারিন মাইশা, আলভান চৌধুরী, সামিয়া ইসলাম, কামিলা সুফী আলম, আরিয়ান কবীর ও ফাহমিন ইসলাম।
অনুষ্ঠানের একটি পর্বে যুক্তরাষ্ট্রের প্রবীণ বাঙালি ব্যক্তিত্বরা তাদের উত্তরাধিকার হিসেবে নবীনদের সম্মাননা জানিয়ে উত্তরীয় পরিয়ে দেন।
উৎসবের মূল আকর্ষণ ছিলেন ফরিদা পারভীন ও গাজী আবদুল হাকিম। তাঁদের পরিবেশনা শুনতে দূরদূরান্ত থেকে বিপুলসংখ্যক দর্শক এসে সমবেত হয়েছিলেন অনুষ্ঠান কেন্দ্রে। ছিল মানুষের উপচেপড়া ভিড়।
ভূপালী রাগের ভিত্তিতে একটি পরিবেশনা দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু করেন বাঁশুরিয়া গাজী আবদুল হাকিম। এরপর নিজের পছন্দের একগুচ্ছ গান গেয়ে শোনান ফরিদা পারভীন। সঙ্গে ছিল লালনের গান ও দর্শন নিয়ে এই প্রবীণ শিল্পীর নিজস্ব পর্যবেক্ষণ।
উৎসবের বিভিন্ন পর্বে বিশেষ অতিথি ছিলেন, নিউইয়র্কের কনসাল জেনারেল ড. মো. মনিরুল ইসলাম, কমিউনিটি ব্যক্তিত্ব ড. সিদ্দিকুর রহমান, তাজুল ইমাম, ডা. চৌধুরী সারোয়ারুল হাসান, এটর্নি মঈন চৌধুরী, মোহাম্মদ এন. মজুমদার, রোকেয়া রফিক বেবী, আহকাম উল্লাহ, অ্যানি ফেরদৌস, লুতফুন নাহার লতা, মিথুন আহমেদ, নূরুল আমিন বাবু, টাইটেল স্পন্সর নূরুল আজিম, ফকরুল ইসলাম দেলোয়ার, খলিলুর রহমান, আহসান হাবীব ও হেলাল মিয়া।
প্রায় মধ্যরাতে শেষ হয় নিউইয়র্কে প্রথম লালন উৎসব। যুক্তরাষ্ট্র লালন পরিষদ ইউএস'র প্রতিষ্ঠাতা ও লালন উৎসবের আহ্বায়ক মো. আবদুল হামিদ জানিয়েছেন, প্রতিবছর তাদের এই উৎসবের আয়োজনের প্রচেষ্টা থাকবে। তবে সবার পরামর্শ অনুযায়ী এটি দ্বিবার্ষিক উৎসবও হতে পারে।
লেখক: নিউইয়র্কপ্রবাসী চারুশিল্পী
Comments