এপ্রিলজুড়ে বর্ষবরণ
বিশ্বের নানা দেশেই এপ্রিলে নববর্ষ পালিত হয়। প্রায় সবই এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে। আবহাওয়া আর দেশের সংস্কৃতির সঙ্গে মিলিয়েই ঠিক হয় আচার ও পর্ব। আমাদের পাশের দেশ ভারতেই এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে কত ফারাক। নানা দেশের নববর্ষকে ডাকা হয় নানা নামে। সব মিলিয়ে নানা দেশের নববর্ষের এক ঝলক দেখে নিতে পারেন এখানে।
লাওসের সংক্রান
লাওস শহরে খুব পরিচ্ছন্ন আর গোছানো নববর্ষের আয়োজন হয় মধ্য এপ্রিলে। উৎসবের উপকরণ হিসেবে পানি, বালি, ফুলের মতো উপকরণের ব্যবহার লক্ষণীয়। পানি ছিটানোর খেলা তো আছেই। অনেকে সমুদ্রতট থেকে বালি তুলে সুগন্ধি পানিতে ভিজিয়ে স্তূপ বানান। তার ওপর পবিত্র পতাকা, ফুল আর উপহার সাজিয়ে নিয়ে যান মন্দিরে। কেউ এই দিনে পশুপাখি মুক্ত করে দেন বা ফুলে ফুলে সাজিয়ে দেন ভগবান বুদ্ধের মূর্তি। সবচেয়ে আকর্ষণীয় উৎসবটি সম্ভবত লুয়াঙ প্রবঙ। এই উৎসবে বছরের প্রথম দিনের সেরা সুন্দরী নির্বাচন করা হয়।
থাইল্যান্ডের সংক্রান
থাইল্যান্ডের নববর্ষ উদযাপিত হয় এপ্রিলের ১৩ তারিখে। তবে উৎসব চলে ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত। সকালে মন্দিরে পূজা দিয়ে শুরু হয় উৎসব। তারা জল খেলা করে। উৎসবের কারণে রাস্তাঘাট বন্ধ হয়ে যায়। থাইরা এদিন ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে। তাদের উদযাপনের অন্যতম অনুষ্ঠান হলো সুন্দরী প্রতিযোগিতা। বিভিন্ন এলাকায় এ প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে মিস সংক্রান নির্বাচন করা হয়।
রঙ্গালি বিহু
১৪ এপ্রিল হলো অসমিয়াদের নববর্ষ। এই দিনটিকে তারা ‘রঙ্গালি বিহু’ বলে। একে অনেকে ‘বোহাগ বিহু’ও বলে। অসমীয় ক্যালেন্ডারের প্রথম মাস হলো ‘বোহাগ’। ‘বোহাগ’ মাসের প্রথম দিনে এই উৎসব হয় বলে একে ‘বোহাগ বিহু’ বলে।
পুথাণ্ডু
তামিলরা তাদের নববর্ষকে ‘পুথাণ্ডু’ বলে। তামিল ক্যালেন্ডারের ‘চিথিরাই’ মাসের প্রথম দিনটি, যেটা কিনা ১৪ এপ্রিল- সেই দিনটিকে তামিলরা তাদের নববর্ষ হিসেবে পালন করে। একে ‘ভারুদা পিরাপ্পু’ নামেও ডাকা হয়। এদিন মেয়েরা আলপনা দেয়, যাকে ‘কোলাম’ বলে। এই আলপনার ঠিক মাঝখানটায় একটি প্রদীপ বসানো হয়, যেটিকে ‘কুত্তুভিলাকু’ বলে। এই প্রদীপটি সব কলুষতা দূর করে বলে তামিলরা বিশ্বাস করে। ‘কান্নি’ নামের একটি আচার পালন করা হয় তামিলদের এই দিন। ‘কান্নি’ মানে ‘শুভদৃষ্টি’। তামিলরা এদিন অলঙ্কার, ফুল, ফল, সবজি ইত্যাদির দিকে তাকিয়ে থাকে। তারা মনে করে তাদের এই ‘শুভদৃষ্টি’ তাদের জীবনে সুখ আনবে।
নেপালি নববর্ষ
নেপালের নববর্ষ বাঙালিদের মতোই এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে ১২-১৫ তারিখের মধ্যে পালন করা হয়। নেপালিরা বলে ‘নববর্ষ’। নেপালিদের বছরের প্রথম মাস বৈশাখ। ওদের নববর্ষের গানের নাম ‘নয়া বর্ষা গীত’। নেপালিদের ভাষার সঙ্গে বাংলা ভাষার অনেকটাই মিল লক্ষণীয়। তারা সবাই মিলে নববর্ষের গান গায়-
‘শুভ কামনা শুভ কামনা
উদয়ো সুরিয়া তেজলে
সজর সাগমা নালিমা
উগরি উগরি নববর্ষ কো
নেপালি লাই শুভ কামনা’।
অলুথ অবরুদ্ধ
বাংলাদেশের খুব কম মানুষই সার্কভুক্ত দেশ শ্রীলঙ্কার এই উৎসবটির কথা জানে। অন্য দেশ যেখানে চাষবাসের সূচনার দিন গোনা শুরু করে বছরের প্রথম দিন, সেখানে সিংহলের এই অধিবাসীরা ১৪ এপ্রিলকে মানে চাষাবাদের শেষদিন হিসেবে। সূর্য যখন মধ্য আকাশে, তখনই তারা কিছু ঐতিহ্যবাহী আচার শুরু করে। যেমন গরুর গাড়ি দৌড়ানো। এই দিনে সিংহলী গিন্নিরা ছোট ছোট তেলের পিঠা বানায় আর সদরের দরজা খুলে দেয় সবার জন্য। স্বজন, বন্ধু-বান্ধব তো বটেই, অপরিচিত মানুষকেও অলুথের দিন তারা সাদরে অতিথি হিসেবে বরণ করে নেয়।
থিংয়ান
মিয়ানমারের নববর্ষ উৎসবও এপ্রিলে হয়, বেশ কয়েকদিন ধরে চলে এই উৎসব। প্রধান আয়োজন থাকে পানি ছোড়ার খেলা। পরিচিত তো বটেই, অপরিচিতদেরও। মোট কথা, যাকে যেখানে পাওয়া যায়। আজকাল মিয়ানমারের সরকার রাজধানীতে কিছু জায়গা ফাঁকা করে দেয় উৎসব উপলক্ষে। আরেকটি বিশেষ লক্ষণীয় আয়োজন হলো আঠালো ভাতের ভেতরে গুড়পোরা বিশেষ পিঠা। তবে গুড়ের বদলে পাখির চোখ পেলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। নববর্ষে একে অন্যকে বোকা বানিয়ে কৌতুক সৃষ্টিও ওদের আচারেরই অংশ।
উগাড়ি
কর্ণাটক, অন্ধ্রপ্রদেশ ও তেলেঙ্গানাতে পহেলা বৈশাখ পালন করা হয় এপ্রিলের ৮ তারিখে। উগাড়ি বলেই ডাকা হয় এই উৎসবকে। উগাড়ি কথাটা এসেছে যুগ আর আদি মিলিয়ে। চৈত্র শুক্লান্তিও বলে অনেকে। কর্ণাটকে এই উৎসবের জন্য একটি বিশেষ পদ তৈরি হয়, তার নাম ওবত্তু বা পুরন পোলি। ডাল, গুড় আর তার সঙ্গে ঘি বা দুধ মিশিয়ে রুটির মতো করে গড়া হয় একে। অন্ধ্রপ্রদেশ ও তেলেঙ্গানাতেও পুরন পোলি বা পোলেলু এই অনুষ্ঠানের একটি অঙ্গ। আর একটি অদ্ভুত মিশ্রণ তৈরি হয়, তার নাম উগাড়ি পচ্ঠড়ি। এতে ছ’রকমের স্বাদ থাকে: তেতো নিম, মিষ্টি গুড় কিংবা পাকা কলা, ঝাল কাঁচালঙ্কা বা মরিচ, নুন, টক তেঁতুল আর কটুস্বাদের কাঁচা আম। খেতে কেমন হয় এই খাবার? একদম ওষুধের মতো! বসন্ত কেবল আনন্দ আর দখিনা বাতাস আসে তা তো নয়, দুঃখও আসে বিস্তর, কারণ এটা হলো মারাত্মক সব ভাইরাস এবং অসুখের কাল। উৎসবের খাবার তৈরিতেও সেই বিপদের মোকাবেলার একটা চেষ্টা চলে এসেছে। বিশ্বাস করা হয়, এই খাবার সারাবছর তাদের সুস্থ রাখতে মহৌষধের কাজ করবে।
বৈশাখী
এপ্রিল মাসের ১৪ তারিখ, যা কিনা নানকশাহি ক্যালেন্ডারের দ্বিতীয় মাসের প্রথম দিন; পাঞ্জাব এবং হরিয়ানাতে এই দিনটিকে শিখরা তাদের নববর্ষ হিসেবে পালন করে। এই দিনটি শিখরা তাদের দশম গুরু ‘গুরু গোবিন্দ সিং’-এর স্মরণে পালন করে, কারণ ১৬৯৯ সালের এই দিনে ‘গুরু গোবিন্দ সিং’ ‘খালসা পন্থ’র প্রবর্তন করেন। ভক্ত শিখরা কাকভোরে গুরুদুয়ারায় ফুল হাতে উপস্থিত হয় এবং সেখানে পুষ্প অর্পণ করে। তাদের এই অনুষ্ঠানে নানা ধরনের গান-বাজনা, ভক্তিমূলক আচার-অনুষ্ঠান ও বর্ণাঢ্য মিছিলের ব্যবস্থা থাকে।
Comments