জ্যঁ-লুক গদার: বিশ্ব চলচ্চিত্রকে বদলে দিয়েছেন যিনি

ঠোঁটে সিগারেট, কালো চশমার নিচে একজোড়া চোখ ঘন দৃষ্টিতে পরখ করছে হাতে উঁচিয়ে ধরা ফিল্মরিল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে শুরু করে পত্রিকা, ম্যাগাজিনের পাতায় জ্যঁ লুক গদারের এমন একটি আইকনিক ছবি হরহামেশাই ঘুরে বেড়ায়। তিনি এমন এক মায়েস্ত্রো, যিনি চলচ্চিত্র নির্মাণের সংজ্ঞাই পরিবর্তন করে ফেলেছিলেন। সিনেমা জগতকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করা এই নির্মাতাকে ফ্রেঞ্চ ওয়েভের অন্যতম জনক বলা হয়ে থাকে।
জ্যঁ-লুক গদার: বিশ্ব চলচ্চিত্রকে বদলে দিয়েছেন যিনি
জ্যঁ-লুক গদার। ছবি: রয়টার্স

ঠোঁটে সিগারেট, কালো চশমার নিচে একজোড়া চোখ ঘন দৃষ্টিতে পরখ করছে হাতে উঁচিয়ে ধরা ফিল্মরিল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে শুরু করে পত্রিকা, ম্যাগাজিনের পাতায় জ্যঁ লুক গদারের এমন একটি আইকনিক ছবি হরহামেশাই ঘুরে বেড়ায়। তিনি এমন এক মায়েস্ত্রো, যিনি চলচ্চিত্র নির্মাণের সংজ্ঞাই পরিবর্তন করে ফেলেছিলেন। সিনেমা জগতকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করা এই নির্মাতাকে ফ্রেঞ্চ নিউ ওয়েভের অন্যতম জনক বলা হয়ে থাকে।

গদার চলচ্চিত্রের বাধা ধরা নিয়ম ভেঙে অনন্য সব সিনেমা নির্মাণ করেছিলেন। পাগলাটে কাজের স্বভাবের কারণে তিনি তার পুরো ক্যারিয়ার জুড়েই আলোচিত-সমালোচিত হয়েছেন। তার কাজ অনুপ্রাণিত করেছে মার্টিন স্করসেসি, কোয়েন্টিন তারান্তিনো, স্টিফেন স্পিলবার্গের মতন বাঘা বাঘা হলিউড নির্মাতাদের।

বিশ্ব চলচ্চিত্রের ইতিহাসে অন্যতম প্রভাবশালী পরিচালক গত মঙ্গলবার রাতে ৯১ বছর বয়সে স্বেচ্ছামৃত্যু বেছে নেন।

এক পাগলাটে ফ্রেঞ্চ নির্মাতা

তিনি মূলত ছিলেন চলচ্চিত্র সমালোচক, তার আগে একজন সিনেমাপ্রেমী। 'ক্যাহিরে দু সিনেমা' পত্রিকায় সমালোচক হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। সেখান থেকেই সিনেমা নিয়ে ভাবনা, সিনেমা কেমন হওয়া উচিত সে বিষয়ে নিজস্ব তত্ত্ব আর দর্শন নিয়ে চর্চা করতে গিয়ে হয়ে উঠলেন নির্মাতা।

তার সম্পর্কে পিটার ব্রাডশ' বলেছিলেন, 'গদার যেন ব্যাকরণ বইকে ছিড়েখুঁড়ে ফেললেন, ব্যাকরণ না পড়েই।' চলচ্চিত্রের দুনিয়া যখন মসৃণ এডিটিং আর সিনেমায় সময়ের বহমানতায় অভ্যস্ত, গদার তখন সিনেমায় জাম্প-কাট দিয়ে যেন সময়কে ছাঁপিয়ে চলে গেলেন।

ওয়াইল্ড ডিগ্রেশন, অফবিট সংলাপ, অন লোকেশন শ্যুটিং, লং টেইক শট, ডিপ ফোকাস আর সিগনেচার জাম্প-কাট নিয়েই তিনি হয়ে উঠলেন ফ্রেঞ্চ নিউ ওয়েভ এর গডফাদার।

জ্যঁ লুক গদার তার প্রথম চলচ্চিত্র নিমার্ণ করেছিলেন ধার করা ক্যামেরা নিয়ে। ১৯৫৪ সালে সুইজারল্যান্ডে তিনি তৈরি করেন শর্টফিল্ম 'অপারেশন কনক্রিট'।

তৎকালীন ফ্রান্সের বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে বামপন্থার যে হাওয়া, তাতে ভেসেছিলেন গদারও। ১৯৬০ সালে নির্মাণ করেন প্রথম সিনেমা 'ব্রেথলেস' (১৯৬০)। 'ব্রেথলেস' এর মাধ্যমেই তিনি চলচ্চিত্রের ভাষাকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন, সিনেমার নতুন সম্ভাবনা নিয়ে বিশ্ব চলচ্চিত্রের দরবারে আলোড়ন তুলেছিলেন।

সমসাময়িক স্টুডিও বেজড সিনেমা যখন টাইট স্ক্রিপ্ট, স্টোরিবোর্ড আর বিশাল ক্রু এর ওপর নির্ভরশীল, গদার তখন 'ব্রেথলেস' নিমার্ণ করলেন হ্যান্ডহেল্ড ক্যামেরায়, স্ক্রিপ্ট লিখতেন শুটিংয়ের দিন আর অভিনেতাদের অন-লোকেশন অ্যাকশন, ডায়লগ বুঝিয়ে দিতেন।

এই প্রামাণ্যচিত্রের মতন নির্মাণশৈলী, ল্যুরিড ক্যাপশন, অভিনয়ের তরিকা দিয়ে তিনি বারবার অভিনেতা ও দর্শকের মধ্যে থাকা 'ইম্যাজিনারি ফোর্থ ওয়াল' ভেঙেছেন।

ষাটের দশক ছিল গদারের সফলতায় ভরপুর। তার ক্যারিয়ারের ঝুলিতে রয়েছে একের পর এক এক্সপেরিমেন্টাল সিনেমা। এর মাধ্যমেই সময়কে ছাঁপিয়ে যান তিনি, পাকাপাকিভাবে জায়গা করে নেন চলচ্চিত্র দুনিয়ার অসীমতায়।

১৯৬০ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত তিনি একের পর এক তৈরি করে গেছেন একান্ত নিজস্ব তরিকায় এক্সপেরিমেন্টাল সিনেমা।

যার মধ্যে আছে 'অ্য উম্যান ইজ অ্য উম্যান' (১৯৬১) যাকে তিনি অভিহিত করেছেন একটি 'নিওরিয়ালিস্ট মিউজিক্যাল' হিসেবে। ১৯৬৫ সালের গদার নির্মাণ করেছেন নিও-নোয়ার সায়েন্সফিকশন 'আলফাভিল'। ভোগবাদ আর বুর্জোয়া সমাজকে তীব্রভাবে আক্রমণ করে নির্মাণ করেছিলেন 'উইকেন্ড' (১৯৬৭)।

গদার নিজের রাজনৈতিক মতাদর্শ তুলে ধরেন 'অল'স ওয়েল' (১৯৭২) চলচ্চিত্রে। এটি  তার মার্কসপন্থী কাজের স্বাক্ষর। পরের দশকগুলোতে 'হেইল মেরি' বা 'কিং লিয়ার' অথবা চলচ্চিত্রের ইতিহাস নিয়ে সিনেমা নির্মাণ করে খ্যাতি ও বিতর্ক সৃষ্টি করে গেছেন তিনি।

২০১৪ সালে, ৮০ বছর বয়সে মুক্তি দেন নিরীক্ষাধর্মী থ্রিডি সিনেমা 'গুডবাই টু ল্যাংগুয়েজ'। এই সিনেমায় তার কুকুর রক্সি ছিল মূল ভূমিকায়।

গদার একের পর এক সিনেমা নির্মাণ করে গেছেন যেখানে যৌনতা, যৌনতার নৈতিকতা, প্রেম ও পুঁজিবাদের সমালোচনা, সেইসঙ্গে মার্ক্সবাদী দর্শনের মিশেল ফিরে এসেছে বারবার।

তার সিনেমাজুড়ে থাকতো দীর্ঘ সংলাপ, ব্যক্তিগত আবেগ থেকে শুরু করে সমাজের রাজনৈতিক উত্তাল অবস্থা নিয়ে বুদ্ধিজীবীদের বিতর্কও।

গদারের বেশিরভাগ সিনেমায় অভিনেতারা যেন নিজেদের চরিত্রের আড়ালে তার কথাই বলে। ১৯৬৩ সালে নির্মিত 'কনটেম্পট' সিনেমায় একজন ফ্রেঞ্চ চিত্রনাট্য লেখককে দেখা যায়। এই সিনেমায় দেখানো কমার্শিয়ালিজম আর ক্রিয়েটিভিটির মধ্যে ঘন হওয়া টেনশন, বিবাহ-বিচ্ছেদ যেন গদারেরই জীবন- ফ্রেঞ্চ অভিনেত্রী আন্না কারিনার সঙ্গে তার সম্পর্ককে তুলে ধরে।

ম্যাটেরিয়ালিজম আর ইম্পেরিয়ালিজম, যুদ্ধপরবর্তী ফ্রেঞ্চ অপরাধবোধ, ডেথ ক্যাম্পের ভয়াবহতা, ভিয়েতনাম যুদ্ধ এবং  ষাটের দশকের রাজনৈতিক পরিস্থিতি গদারকে বামপন্থা, মাওবাদ এর প্রতি আরো আকৃষ্ট করে তুললেও তার সিনেমা অনেক ক্ষেত্রেই মাওবাদীদের সন্তুষ্ট করতে পারেনি।

৫৪ তম আন্তর্জাতিক কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে অভিনেত্রী সিসিলি ক্যাম্পের সঙ্গে গদার। ছবি: রয়টার্স

আলোচিত-সমালোচিত

পেশাগত ও ব্যক্তিজীবনে গদার ছিলেন বরাবরই সমালোচিত। আন্না কারিনা এবং আনে ভিয়াসেমস্কির সঙ্গে গদারের দাম্পত্য জীবন ছিল ঝঞ্ঝাময়, যার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে তার সিনেমাগুলোতেও।

১৯৬৮ সালে রোলিং স্টোন ব্যান্ডের ওপর তথ্যচিত্র 'সিমপ্যাথি ফর দ্য ডেভিল' রি-কাট করায় লন্ডনে প্রদর্শনী চলাকালীন প্রযোজককে ঘুষি মেরে বসেন গদার। বন্ধু, সহযাত্রী ও ফ্রেঞ্চ নিউ ওয়েভের আরেক নির্মাতা ফ্রাঁসোয়া ত্রুফোর সঙ্গেও একসময় বিবাদে জড়ান তিনি। ১৯৭৩ সালে ত্রুফোর সিনেমার কঠোর সমালোচনা করে একটি আর্টিকেল লেখেন গদার। জবাবে ত্রুফোও আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠেন। দুই বন্ধুর সম্পর্ক এরপর আর সহজ হয়নি।

বামধারার চিন্তক জঁ-পিরে গোরিন ও চিত্রগ্রাহক রাউল কুতার্দের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল গদারের। গদার সম্পর্কে চিত্রগ্রাহক রাউল কুতার্দ বলেছিলেন- 'তিনি যা-তা হতে পারেন... কিন্তু তিনি একজন জিনিয়াস' ('He can be a shit... but he's a genius')।

অতুলনীয় অনুপ্রেরণার নাম

সিনেমার ভাষা, সিনেমার ভবিষ্যৎ নিয়ে গদার বলতেন 'সিনেমা ইজ ডেড' (সিনেমা মারা গেছে)। সিনেমায় যা দেখানো হচ্ছে, দর্শক যা দেখছে আর যা দেখানো হচ্ছে না, সেসব লুকিয়ে থাকা বিষয়বস্তুই  খুঁজে নিতে বলেছেন তিনি।

গদারের কাজ - সেটা 'ব্যক্তি গদার-নির্ভর', অথবা নিরীক্ষাধর্মী, বা রাজনৈতিক, কিংবা সবই - বিশ্বজুড়ে চলচ্চিত্র নির্মাতাদের মধ্যে দারুণ প্রভাব বিস্তার করে আছে। যুক্তরাষ্ট্রের চলচ্চিত্র নির্মাতা কুয়েটিন তারান্তিনো নিজের প্রযোজনা কোম্পানির নাম রেখেছেন 'অ্যা ব্যান্ড অ্যাপার্ট', যা গদারের ১৯৬৩ সালে নির্মিত সিনেমা 'বান্ড আ পার্ট'থেকে অনুপ্রাণিত। ইতালির পরিচালক বের্নার্দো বের্তোলুচ্চি তার 'দ্য ড্রিমারস' সিনেমায় গদারকে সম্মান জানিয়েছেন। ইরানি নির্মাতা আব্বাস কিয়ারোস্তামি অথবা ডেনমার্কের লারস ফন ত্রিয়েরের ওপরেও গদারের প্রভাবের ছোঁয়া পাওয়া যায়।

ভারতীয় কালজয়ী পরিচালক মৃণাল সেন ও সত্যজিৎ রায়কেও অনুপ্রাণিত করেছেন গদার। তার ফিল্ম টেকনিক, ক্যামেরার ব্যবহারে মুগ্ধ হয়েছিলেন তারা। গদারকে নিয়ে লেখা বইতে  মৃণাল সেন এ বিষয়ে উল্লেখ করেছেন।

কিংবদন্তী এই চলচ্চিত্রকার এখনো তরুণ নির্মাতাদের অনুপ্রেরণা যোগায়। স্বপ্ন দেখায় সিনেমার দুনিয়ায়  শেকল ভাঙার, সিনেমার ভাষায় নতুন ছন্দ দেওয়ার। দিন শেষে গদার ছিলেন কেবলই একজন পাগলাটে সিনেমাপ্রেমী, সিনেমায় যার বাস, সিনেমাতেই যার বাড়ি।

তামীম স্রোত: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী

Comments

The Daily Star  | English

Teesta floods bury arable land in sand, leaving farmers devastated

40 unions across 13 upazilas in Lalmonirhat, Kurigram, Rangpur, Gaibandha, and Nilphamari are part of the Teesta shoal region

1h ago