শিক্ষার্থী অবস্থায় বিয়ে: ভালো-মন্দ, ভূত-ভবিষ্যৎ

স্টার ফাইল ফটো

বলা হয়ে থাকে, বিয়ে নামের প্রতিষ্ঠানটি আধুনিক রাষ্ট্রের চেয়েও অনেক প্রাচীন। সমাজের ক্ষুদ্রতম একক পরিবার গঠনের স্বীকৃত পদ্ধতি হচ্ছে এই বিয়ে। দেশ-সমাজ নির্বিশেষে প্রাচীন এ প্রথাই এখনো পরিবার গঠনের মূল ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত।

বিয়ে বলতে সাধারণত যে বিষয়গুলো মাথায় আসে তা হলো—বাতাসে সুখাদ্যের সুঘ্রাণ, আলোকসজ্জা, সুশোভন সাজে আগত নিমন্ত্রিতদের সানন্দ আপ্যায়ন, সৌজন্য বিনিময়, আনন্দভোজ, সবাইকে সন্তুষ্ট করে আমন্ত্রণকর্তার পরিতৃপ্তির সন্ধান—এমন অনেককিছু।

মানুষের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলোর একটি হলো এই বিয়ে। সাধারণত বিয়ের আগে পূর্বশর্ত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পাশাপাশি থাকে অনেক পরিকল্পনা, নানা মানসিক প্রস্তুতি ও বিবিধ আয়োজন।

তবে সবকিছুতেই কিছু ব্যতিক্রম থাকে। তাই কঠিন বাস্তবতার জমিনে দাঁড়িয়েও পরস্পরের প্রতি প্রেম-ভালোবাসায় মগ্ন কাউকে কাউকে শিক্ষার্থী অবস্থাতেই বিয়ে করে ফেলতে দেখা যায়। এতে কেউ কেউ বিয়ের পরের ধাক্কাটা সামলে নিয়ে যেমন চমৎকার দাম্পত্যের উদাহরণ তৈরি করতে পারেন, তেমন মোহভঙ্গের বেদনায় বিদীর্ণ হতেও দেখা যায় অনেককে।

উদাহরণ হিসেবে এখানে সাদিয়া ও মারুফের (ছদ্ম নাম) অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। নতুন জীবন শুরু করতে দুজনের মধ্যে প্রেম-ভালোবাসার চেয়ে বেশি আর কী দরকার—ঠিক এই ভাবনা থেকেই শিক্ষার্থী অবস্থায় বিয়ে করেছিলেন তারা। উচ্চশিক্ষার জন্য তারা একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে একই বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন। এরপর গ্রুপ স্টাডি, অ্যাসাইনমেন্ট, ক্লাস শেষে চায়ের আড্ডা, দল বেঁধে ঘোরঘুরির একপর্যায়ে দুজনের মনে হয় বন্ধুর চেয়ে সম্পর্কে খানিকটা তারা এগিয়েই গেছেন।

স্টার ফাইল ফটো

পরে দ্বিতীয় বর্ষে এই সম্পর্ককে শক্ত ভিত দিতে দুই পরিবারের মৌন সম্মতিতে বিয়েটা সেরে ফেলেন সাদিয়া-মারুফ। তবে সংসার করা শুরু হয় না তখনো। কিছুদিনের মধ্যে টিউশনির টাকায় 'সাবলেট' বাসায় সংসার শুরু করলেও আর্থিক টানাপোড়েনের পাশাপাশি পড়াশোনাসহ বিভিন্ন মানসিক চাপের কারণে পারিবারিক দ্বন্দ্ব শুরু হয় তাদের মধ্যে।

এর উল্টো চিত্রও আছে। এক্ষেত্রে তন্বী ও সজলের গল্পটা ভিন্ন। বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষে থাকা অবস্থায় পারিবারিক সম্মতিতে বিয়ে হয় তাদের। এরমধ্যে তারা সংসার জীবনের ১৪টি বছর কাটিয়ে ফেলেছেন।

বর্তমানে একটি বেসরকারি ব্যাংকে কর্মরত আছেন তন্বী। তিনি বলেন, 'বাবা-মায়ের যতই সামর্থ্য থাকুক না কেন, আমাদের শখ-আহ্লাদ মেটানোর দায়িত্ব নিতে তারা বাধ্য নন—এ বিষয়টি শুরু থেকেই আমাদের মাথায় ছিল। তাই নিজেদের শখের লাগাম নিজেরাই টেনে ধরেছিলাম আমরা। এভাবে শখ আর সাধ্য মিলিয়ে নিলে, সঙ্গে লোক দেখানো ব্যাপারটা নিয়ে খুব একটা মাথাব্যথা না থাকলে অল্পতেই সন্তুষ্ট থাকা খুব সম্ভব বলে আমাদের মনে হয়। এটা আমরা জীবন থেকেই শিখেছি।'

সময় পরিক্রমায় আমাদের সমাজ এখন প্রেমের বিষয়টি মেনে নেওয়ার মতো পোক্ততা অনেকটা অর্জন করেছে। কিন্তু শিক্ষার্থী অবস্থায় বিয়ের বিষয়ে এখনো সেটা হয়নি। অনেকের ধারণা, প্রেম করলে কেবল লেখাপড়ার ক্ষতি হয়। আর বিয়েতে ক্যারিয়ারের সর্বনাশ ঘটে যায়। একজন মেয়ে পড়াশোনা চলাকালীন ২০-২১ বছরে বিয়ে করলে এই সমাজ আড়চোখে না তাকালেও ছেলেদের রীতিমতো তোপের মুখে পড়তে হয়। সেটা সামাজিক ও পারিবারিক—দুই পর্যায়েই।

শিক্ষার্থী অবস্থায় বিয়ের ভালো-মন্দ নিয়ে কথা হয় জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদের সঙ্গে।

এই চিকিৎসকের ভাষ্য, '(শিক্ষার্থী থাকাকালীন) যেহেতু আর্থিক সংগতি থাকে না, পড়াশোনার চাপ থাকে, মানসিক পোক্ততা ঠিকঠাক আসে না, সেহেতু তখনকার বিয়ে সঙ্গীদের মধ্যে একটা বাড়তি চাপ তৈরি করে। বিয়ে হলো স্বামী-স্ত্রীর বোঝাপড়া ও এক ধরনের টিমওয়ার্ক, যেখানে চিন্তাভাবনা বা একসঙ্গে কাজ করার পারদর্শিতার দরকার হয়। এ কারণে আবেগের বশবর্তী হয়ে বিয়ে করলেও পরবর্তীতে মতের মিল হবে কিনা, বোঝাপড়া থাকবে কিনা—এ বিষয়গুলোও বিবেচনায় রাখতে হবে।'

শিক্ষার্থী অবস্থায় মূল কাজ হচ্ছে পড়াশোনা করা। নিজেকে ভবিষ্যতের জন্য তৈরি করা। এক্ষেত্রে পরিবার থেকে পূর্ণ সহেযোগিতা না পেলে বিয়েটা যে কারুর জন্য বাড়তি চাপ হয়ে দাঁড়াতে বাধ্য। বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে সাধারণত এ ধরনের বিয়েতে পরিবারের সম্মতি কমই থাকে। তবে বিশেষ পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া একটি ছেলে কিংবা একটি মেয়েকে হয়তো সময়ের আগেই বিয়ে করতে হয়। এতে দেখা যায়, অতিরিক্ত মানসিক চাপের কারণে দাম্পত্য জীবনের শুরুতে যে ধরনের বোঝাপড়া তৈরি হওয়া দরকার সেটা হয় না। পাশাপাশি নিজেরা কর্মজীবনে উন্নতি করতে না পারলে পারস্পরিক সম্পর্কেও তার প্রভাব পড়ে।

এর বিপরীতে এ ধরনের বিয়ের কিছু ভালো দিকও চোখে পড়ে। বিয়ের মাধ্যমে যেহেতু সম্পর্কের সামাজিক স্বীকৃতি ও সমর্থনটা পাওয়া যায় তাই অনেক ক্ষেত্রে মানসিক চাপ অনেকটা কমে আসে। এছাড়া দুজনই শিক্ষাজীবন অতিবাহিত করেন বলে 'অ্যাকাডেমিক' পড়াশোনায় একে অপরকে উৎসাহ দিতে পারেন। একই বিভাগের শিক্ষার্থী হলে পরস্পরের সহযোগী হয়ে উঠে সহপাঠীদের চেয়ে খানিকটা এগিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও তৈরি হয়।

পরিবারের করণীয়

আবার পড়তে পড়তে বিয়েতে পারিবারিক সম্মতি যেমন সব সময় পাওয়া যায় না, তেমনি এখানে আস্থার জায়গাটাও থাকে নড়বড়ে। পরিবারের অন্য সদস্যদের মনে রাখতে হবে, একটা সময় পর্যন্ত এই দম্পতিদের একটু সুযোগ দিলে বা সহযোগিতা করলে তারাও সফল দম্পতি হিসেবে অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারেন। আবার একটুখানি অসহযোগিতা তাদের জীবনকে থমকে দিতে পারে। এমনকি সংসার শুরুর আগেই হয়ে যেতে পারে বিচ্ছেদ। তাই নিজেদের সন্তানের কথা ভেবে হলেও তাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়া উচিত। তা না হলে সন্তানের আরও ভুল পথে পা বাড়ানোর সম্ভাবনা থেকে যায়।

সর্বোপরি যারা শিক্ষার্থী অবস্থায় বিয়ে করতে চান তাদের অবশ্যই মনে রাখা উচিত—বিয়ে মানে কোনোভাবেই বিনোদন কিংবা ক্ষণিকের আবেগ নয়; বরং বিয়ে শব্দটি অনেকটা দায়িত্বশীলতারই সমার্থক।

Comments

The Daily Star  | English

Tribute to July uprising: Drone show lights up Dhaka's sky

In 12 vivid motifs, the July uprising came alive, tracing the heroism of Abu Sayed and the stirring role of women in the movement

12h ago