নির্জনতম গবেষক খোন্দকার সিরাজুল হক
মুসলিম-সমাজে যদি কখনো সত্যিকারের রিনেসাঁসের আবির্ভাব হয়, তবে উপলব্ধ হবে যে তার প্রাথমিক ভিত্তি রচনা করেছিল 'মুসলিম সাহিত্য-সমাজ' —মোতাহের হোসেন চৌধুরী
খোন্দকার সিরাজুল হক ছিলেন একজন নির্জনতম গবষক। কিভাবে? প্রশ্নটা বুঝে নেবার আগে খুব সংক্ষেপে তার গবেষণার পটভূমিটা বলে নেওয়া দরকার। মুসলিম সমাজ কিংবা মুসলিম মানস-এর পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ ছিল বিশ শতকের ষাট-সত্তর ও আশির দশকের বাংলাদেশের সংস্কৃতির একটা বিশেষ ঝোঁক। রাজনৈতিকভাবে এটা স্বীকার করে নেওয়া ভালো যে, 'পাকিস্তান রাষ্ট্র'-এর প্রতিষ্ঠা প্রথমে এই ঝোঁকের সূচনা করে। পঞ্চাশের দশকে 'স্বাধিকার আন্দোলন'-এর গোপন ও প্রকাশ্য মনোভাব থেকে উল্লিখিত প্রবণতা মুক্ত হতে চায় একটি গণতান্ত্রিক ও বুদ্ধির স্বাধীন পরিশীলনের স্তরে।
টানা দুই দশকের গুমোট অতিক্রম করে মুক্তিযুদ্ধের জয়-ধ্বনির প্রতিষ্ঠা বাংলাদেশে যে-নতুন আশা ও আকাঙ্ক্ষা বাঙালি মুসলিম সমাজে তৈরি হয়, মুসলিম সাহিত্য-সমাজ : সমাজচিন্তা ও সাহিত্যকর্ম (১৯৮৪) গবেষণাকর্মটি তার এক বড় দৃষ্টান্ত। পাকিস্তান আমলে মুসলিম সমাজ, সংস্কৃতি ও সাহিত্য নিয়ে যে-সমস্ত গবেষণা হয়েছে, খোন্দকার সিরাজুল হকের এই গবেষণা সে-সব থেকে সম্পূর্ণভাবে আলাদা! কেননা তাঁর বিষয় : বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন! রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক পদ্ধতি ও মুক্তচিন্তার চাষ জরুরি—যা বাধা পেয়েছিল ব্রিটিশ রাষ্ট্রে, যা প্রায় নিষিদ্ধ ছিল পাকিস্তাানী শাসকশ্রেণীর নির্যাতনে।
ব্রিটিশ রাষ্ট্রে বুদ্ধির মুক্তি প্রচন্ড বিরোধিতার মুখে পড়ে। শাস্ত্রশাসিত নবাব পরিবার ছিল মুক্তচিন্তার বিরোধী। পাকিস্তান রাষ্ট্রে এ ছিল এক অনুচ্চারিত ও নিষিদ্ধ বিষয়। সেই আন্দোলনের পুরো ইতিহাসটা আজ কেবল স্মরণ করা নয়, নতুন করে তার লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও বিস্তারের আকাঙ্ক্ষা এ অঞ্চলের শিক্ষিত ও প্রগতিশীল ব্যক্তিবর্গের সামনে উপস্থিত করবার তাগিদ অনুভূত হয়। এই অভাবটা একদিকে যেমন জাতীয় কর্তব্যের দায় থেকে অনুভূত হয়েছে, তেমনি মহৎ মনীষার আহ্বান থেকে অন্তর সাড়া দিয়েছে!
এর থেকে খোন্দকার সিরাজুল হক বলেন, 'বেদনাদায়ক হলেও এ কথা সত্য যে, মুসলিম সাহিত্য-সমাজ প্রতিষ্ঠার পর অর্ধ শতাব্দীকাল অতিক্রান্ত হলেও এই সাহিত্য প্রতিষ্ঠানের কর্মপ্রয়াস সম্পর্কে কোনো পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস এখনো রচিত হয়নি।' কেন অভাবটা এত প্রবল হয়ে দেখা দিয়েছিল? অনেক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এই সমাজের আগে বাঙালি মুসলিম সমাজে যুক্তিবাদিতার পরিচয় খুব-একটা পাওয়া যায় না। এই দৃষ্টিভঙ্গি ও আদর্শিক মনোভাব নিয়ে সংঘবদ্ধ আন্দোলনের কোনো সংবাদ এই সমাজের ইতিহাসে নেই। এমন কি এই যুক্তিবাদ পুরোপুরিভাবে কোনো সাহিত্য-সংগঠন কিংবা কোনো সাহিত্যিকের জীবনের মৌল দর্শন হয়ে ওঠেনি। এঁদের পরেও এমন ঐক্যবন্ধন এ সমাজে চোখে পড়ে না! বলাবাহুল্য, মুসলিম সাহিত্য-সমাজ এ ব্যাপারে পথ-প্রদর্শক।
শাস্ত্রের কাছে অন্ধ আনুগত্য নয়। কেননা মানুষের জ্ঞানের ক্ষুধা অপরিমেয়। জগতে মননের সম্পদ অফুরন্ত। এর আহরণে ব্যক্তি-মনের পুষ্টি নয় কেবল, জাতীয় জীবনকে সমৃদ্ধ করায় এর বিকল্প নেই। সংগীত থেকে নিয়ে সমস্ত রকম শিল্পকলা জীবনকে সুন্দর ও পরিব্যাপ্ত করতে চায় মানুষ। কাজেই তাকে সেই মুক্ত আকাশে মনের পাখা মেলে ধরবার জায়গা করে দিতে হবে। খোন্দকার সিরাজুল হক তার গবেষণায় মুসলিম সাহিত্য সমাজের এই অনিন্দ্য সুন্দর আকাঙ্ক্ষা নতুন প্রজন্মের কাছে নতুন ব্যাখ্য-বিশ্লেষণে, অসংখ্য প্রামাণ্য তথ্যের সমাবেশে বিপুল ধৈর্য,পরিশ্রমে, দৃঢ় মনোবলে উপস্থাপন করেছেন।
খোন্দকার সিরাজুল হকের এই গবেষণা নিয়ে বলা যায়, বাঙালি মুসলিম সমাজের একটি বিবেকী ধারার বুদ্ধিবৃত্তিক পর্যবেক্ষণ ছিল ঢাকার বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন। এই আন্দোলনের এক প্রামাণ্য ও মূল্যবান গ্রন্থ মুসলিম সাহিত্য-সমাজ: সমাজচিন্তা ও সাহিত্যকর্ম। বুদ্ধি মুক্তি আন্দোলনের বিস্তৃত পরিচয়, আন্দোলনকারী নেতৃবৃন্দের সৃষ্টিকর্ম, তাদের ভাবনার উদ্দেশ্য, সমাজের সমকালীন পরিস্থিতি প্রভৃতি এ গ্রন্থের আলোচ্য বিষয়। গ্রন্থটি পিএইচডি গবেষণাপত্রের পরিবর্তিত ও পরিমার্জিত রূপ বটে, কিন্তু এর প্রেরণায় কাজ করেছে জাতি গঠনের এক মহৎ উদ্দেশ্য ও জাতীয় কর্তব্যবোধ।
এই সংগঠন সম্বন্ধে এমন পরিশ্রমনিষ্ঠ ও মনন-সম্মত এবং বিশ্লেষণধর্মী গবেষণা ইতিপূর্বে হয়নি। সে জন্যে এ গ্রন্থ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই বাঙালি বিদ্বৎসমাজে সমাদৃত হয়েছিল। তথ্যের বিপুলতায়, মনননের শৃঙ্খলায় আর আকাঙ্ক্ষার সবলতায় গ্রন্থটি রচিত হয়েছে যেমন বিপুল শ্রম-নৈপুণ্যে, তেমনি প্রাণের এক দুর্মর তাগিদ থেকে। সবমিলে, শুদ্ধ আবেগ আর শুভবুদ্ধির যোগাত্মক ভূমিকার ফল গবেষণাগ্রন্থ। এই গ্রন্থের জন্যে অধ্যাপক সিরাজুল হক রাষ্ট্রীয় কোনো পুরস্কার পান নি। এর পিছনে ছিল না কোনো 'স্কলাপশিপ'। অথচ এর পূর্ববর্তী মুসলিম সাহিত্য বিষয়ক গবেষণায় এ দুয়েরই প্রাপ্তি বর্তমান ছিল!
২
খোন্দকার সিরাজুল হক ১৯৪১ সালের ১ মার্চ রাজশাহী শহরে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা-মাতার বারো সন্তানের মধ্যে তিনি তৃতীয় এবং সবার থেকে মেধাবী ও শিক্ষানুরাগী। প্রাতিষ্ঠানিক সকল পরীক্ষায় কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৪ সালে প্রথম শ্রেণী প্রথম হয়ে এম এ পাশ করেন। কিছুকাল যশোর জেলার মাইকেল মধুসূদন দত্ত কলেজে অধ্যাপনা করবার পরে, ১৯৬৫ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৮২ সনে তিনি পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করেন। গবেষণাকর্মের জন্যে তিনি বাংলা একাডেমি পরিচালিত সা'দত আলী আখন্দ পুরস্কার (২০১১) ও বাংলা একাডেমি পুরস্কার (২০১২) লাভ করেন। ২০০৬ সালে বাংলা বিভাগের সিনিয়র প্রফেসর হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন।
৩
খোন্দকার সিরাজুল হকের গবেষণার জায়গাটা ছোটো, কিন্তু ছোটোর মধ্যে উজ্জ্বল, জ্যোতিষ্কের মতো। তিনি বিশ্বাস করতেন, মানুষের আজকের জীবনের মধ্যে যে-পরিসর, মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষ হয়ে, সংসারের বিচিত্র দায়িত্ব পালন করে, গবেষণার মতো সূক্ষ্ম ও গভীর বিষয়ের বিস্তার সম্ভব নয়। আমাদের মতো দেশের পক্ষে তো সেটা আরো কঠিন। কেননা এখানে মানবতন্ত্রী গবেষণার মূল্য নেই বললেই চলে। যে-গবেষণা সমাজ পরিবর্তনে সহায়ক হবে, যে-গবেষণা সংস্কৃতির মৌল জিজ্ঞাসায় কার্যকর হবে, আমাদের মননের মধ্যে তার আহ্বান নেই! এমন আকাঙ্ক্ষাহীন, এমন সদিচ্ছাবিরত সমাজে সূক্ষ্ম ও ভারী চিন্তার জন্ম হতেই পারে না। তবুও তিনি নিভৃতে বসে, মফস্বল শহরে মনন-বিরুদ্ধ পরিবেশে, বুদ্ধি, রুচি ও বন্ধুহীন আবহে বাস করে, নিজের অর্জিত জ্ঞানের পরিসরের মধ্যে শুভবুদ্ধি ও মুক্তচিন্তার ইজ্জত রক্ষা করে, যে-গবেষণাপ্রয়াসটা করে গেছেন, তা যেমন নিরেট, তেমনি লক্ষ্যভেদী!
তিনি নিজেকে কোথাও প্রচার করেননি। রেডিও-টেলিভিশনে প্রতিদিন মুখ দেখানোয় ব্যস্ত থাকেননি। প্রতিদিনকার সংবাদপত্রে নানা অপ্রয়োজনীয় ও মিছে কথা লিখে লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেননি। তার বন্ধুসংখ্যা অগণিত ছিল না। মননবিরত, রুচিহীন ও বিত্তবদ্ধ ব্যক্তির সঙ্গ তিনি এড়িয়ে চলতেন। পরিমিতিবোধ ও সুনীতিবোধের প্রতি তার অনুরাগ ছিল চমৎকার। শিক্ষক হিসেবে তিনি মনে করতেন, যিনি শিক্ষক হবেন, তিনি কেবল বই পড়াবেন না। তিনি নিজে যেমন শিখবেন, তেমনি সেই শিক্ষায় কেবল বিদ্বান হয়ে থাকবেন না, তিনি ভাবুক হয়ে উঠবেন। এটা না হলে ভাবসঞ্চারের ক্ষেত্র বড় হবে না। চিন্তার পরিসর ছোটো হলে মানবিক গুণের পরিধি বড় হতে পারে না। তিনি কথা বলতেন কম। শুনতেন বেশি। অনেক দিন তাকে কবি ভারতচন্দ্রের একটি কথা বলতে শুনেছি। বলতেন, 'সে কহে বিস্তর মিছে যে কহে বিস্তর।' বলতেন, মানুষের আত্মপ্রকাশ ঘটবে তার কর্মের মধ্যে, আচরণের মধ্যে। কেননা বিদ্যা আহরণ সহজ, কিন্তু শিক্ষা তা নয়। শিক্ষা আচরিত ধর্ম! এর প্রকাশে সৌন্দর্য থাকলে, তবে তা সার্থক। শিক্ষক যদি তাঁর চিন্তার খোরাক সংগ্রহ করতে পারেন বিচিত্র অভিজ্ঞতা থেকে, তবে তাঁর সূক্ষ্ম কর্মের ভিতর দিয়ে তা প্রকাশ ঘটতে বাধ্য।
৪
বাঙালি মুসলিম সমাজ নিয়েই ছিল তার গবেষণা। বিচরণ করতেন তিনি এই সীমানার মধ্যে। কিন্তু মনের আলো তিনি সংগ্রহ করতেন বিচিত্র জ্ঞানের উৎস থেকে। মৃত্যুর কিছুদিন আগে (৬ এপ্রিল ২০১৬), আমার বিশেষ অনুরোধে একটি লেখা লিখেছিলেন। সেটি পশ্চিমবঙ্গের কোরক সাহিত্য পত্রিকায় (বইমেলা ২০১৬) প্রকাশিত হয়।
সেখানে তিনি লিখেছেন, আমি জীবন-সায়াহ্নে উপস্থিত হয়েছি। অতিক্রম করেছি শৈশব, কৈশোর, যৌবন ও পৌঢ়ত্ব-- উপনীত হয়েছি বার্ধ্যক্যের শেষ প্রান্তে। জীবনের অন্তিমলগ্নে এসে যখন পেছনে ফিরে তাকাই তখন অজস্র গ্রন্থের কথা মনে পড়ে, সে-সব গ্রন্থ ও গ্রন্থকারের কাছে আমার ঋণেরর শেষ নেই। যে-গ্রন্থগুলো আমার মনোজগৎকে সমৃদ্ধ করে আমাকে বর্তমানের 'আমি'তে পরিণত করেছে, সে-সবের কথা ভুলি কী করে! সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শন, সমাজবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, প্রাকৃতিক বিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয়ে বহু গ্রন্থের নাম আজ আমার মনের দর্পণে ভীড় করে আসছে।
ইংরেজ মনীষী ফ্রান্সিস বেকন গ্রন্থের জগৎকে তিনটি ভাগে ভাগ করে কাজটি অনেক সহজ করে দিয়েছেন বলে আজ তাকেই স্মরণ করছি। তিনি খাবার নির্বাচনের প্রক্রিয়ায় গ্রন্থ নির্বাচনের পথ বাতলে দিয়ে আমাদের আশ্বস্ত করেছেন। Of Studies' প্রবন্ধে বলেছেন, Some books are to be tested, others to be swallowed, and some few to be chewed and digested। গ্রন্থ-নির্বাচনে বেকনের অমোঘ উক্তিটি একটি মূল্যবান সূত্র বৈকি। এই সূত্রই বলে দেয় আমাকে কোন্ বিভাগের গ্রন্থগুলোর মধ্যে থেকে একটি গ্রন্থ খুঁজে বের করতে হবে। বেকন তৃতীয় বিভাগের গ্রন্থগুলো সম্পর্কে বলেছেন, খাদ্যের মতোই এই গ্রন্থগুলোকে নিবিড় পাঠের মাধ্যমে চিবিয়ে খেয়ে হজম করতে হয়।
তাই শারীরিক পুষ্টির নিয়মেই গ্রন্থগুলো মানসিক পুষ্টি সাধন করে। দুর্লভ গ্রন্থগুলো এভাবেই মানব সমাজের মনন জগতের পুষ্টি সাধন করে চলেছে। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান তার সম্পর্কে বলেন, 'খোন্দকার সিরাজুল হক স্থিতধী মানুষ, নিষ্ঠাবান গবেষক, যত্নশীল লেখক।'
Comments