‘মনে হচ্ছিল, এই বুঝি ফারদিন এসে বললো, আমি হারাই নাই’

ফারদিনের মৃত্যু : এক মাস পেরিয়ে গেলেও এই নির্মম মৃত্যু এখনো মেনে নিতে পারেনি ফারদিন নূর পরশের পরিবার
ফারদিন নূর পরশ। ছবি: সংগৃহীত

তার বই, পরনের শার্ট, বিছানা, যত্ন করে সাজিয়ে রাখা মেডেল ও ক্রেস্টগুলো সারাক্ষণই যেন তার কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। এক মাস পেরিয়ে গেলেও এই নির্মম মৃত্যু এখনো মেনে নিতে পারেনি ফারদিন নূর পরশের পরিবার।

মা ফারহানা ইয়াসমিনের দিন কাটছে ছেলের বিতর্ক প্রতিযোগিতার রেকর্ডিং দেখে। তার বিশ্বাস, ফারদিন বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে স্পেন যাবে। বছর দুয়েক পর বুয়েটের সমাবর্তনের দিনে সে কালো গাউন পরে মাকে জড়িয়ে ধরবে।

'সেদিন আমি বুয়েট ক্যাম্পাসে গিয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল, এই বুঝি ফারদিন আসলো... আমাকে ডাকলো... বললো, "বাবা এইতো আমি। আমি হারাই নাই..."', বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন ফারদিনের বাবা কাজী নূরউদ্দিন রানা।

গত ৪ নভেম্বর বিকেলে ফারদিনকে শেষবারের মতো দেখেছিল তার পরিবার।

'বের হওয়ার সময় ফারদিন বলেছিল, পরীক্ষা শেষ করে পরদিন ফিরে আসবে। আর ফেরেনি। এরপর গত ৭ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে শীতলক্ষ্যা থেকে তার গলিত মরদেহ উদ্ধার করা হয়।'

ফারদিনের ময়নাতদন্তে জানা গেছে তাকে হত্যা করা হয়েছে। এক মাস পেরিয়ে গেলেও তদন্তে কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই।

নূরউদ্দিন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ফারদিন খুব উদাসী ছিল, বইপড়ুয়া ছিল। এমন একজনকে কেন কেউ খুন করতে চাইবে?'

'তার ইচ্ছা ছিল মৃত্যুর সময় তার একটাই পরিচয় থাকবে—সে একজন পাঠক। বাইরে থেকে বাসায় ফিরলে আমার ছোট ২ ছেলে চকলেট-চিপস খুঁজতো। ফারদিন খুঁজতো বই বা ম্যাগাজিন। আমার ব্যাগে বই না পেলে সে খুব মন খারাপ করতো,' যোগ করেন তিনি।

বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ফারদিন নূর পরশ গণিত ভালোবাসতেন। ছোট শিশুদের প্রতি স্নেহশীল ছিলেন। সবসময় পরিশ্রমী ও চিন্তাশীল ব্যক্তিদের পছন্দ করতেন।

'এমন এক ছেলে মারা যাওয়ার পরও কেন তারা মিথ্যা তথ্য ছড়ায় তা আমি জানি না,' বলেন ফারদিনের বাবা।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও প্রমাণ ছাড়াই এমন তথ্য দিয়েছে।

'এটি ভীষণ আশ্চর্যজনক… এবং কয়েকটি মিডিয়া যাচাই-বাছাই না করেই এসব প্রকাশ করছে যা খুবই বেদনাদায়ক। যে মানুষটিকে হত্যা করা হয়েছে তাকেই আবার সম্মানহানি করা হচ্ছে। দমবন্ধ হয়ে পড়ে থাকা এক পরিবারকে তারা আরও বেশি শ্বাসরুদ্ধ করছে। আমাদের প্রিয়জনকে হারিয়েছি এবং এখন তারা আমাদেরই সম্মানহানি করছে।'

তদন্তের বিষয়ে তিনি বলেন, 'মনে হচ্ছে তদন্ত কোথাও আটকে গেছে। আমরা সাধারণত দেখি যে প্রধান তদন্তকারী সংস্থা নেতৃত্ব দেয়। কিন্তু এখানে, এটা ভিন্ন। এখানে ছায়া তদন্তকারীরা বেশি সোচ্চার। এটি আশ্চর্যজনক। মরদেহ উদ্ধারের ২৪ ঘণ্টা পর তারা বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়েছে। এখনো তারা কোনো সুনির্দিষ্ট প্রমাণ নিয়ে আসতে পারেনি।'

২টি সংস্থা পরস্পরবিরোধী বক্তব্যও দিয়েছে। এছাড়া, বুয়েট কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষকদের আচরণেও অবাক হয়েছেন ফারদিনের বাবা।

তিনি বলেন, 'তারা আমার ছেলের জন্য, তাদের ছাত্রের বিচারের জন্য আওয়াজ তুলছে না। তদন্ত কোনদিকে যাচ্ছে তারা জানে না। বুয়েট কর্তৃপক্ষ একবারও শোকাহত পরিবারের বাড়িতে যাওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি। শিক্ষার্থীরা যেখানে সমাবেশ করছে সেখানে শিক্ষকরা একেবারে নীরব।'

তবে তদন্ত নিয়ে এখনো আশাবাদী নূরউদ্দিন।

তিনি বলেন, 'আমি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ওপর আস্থা রাখতে চাই। কারণ তাদের কঠিন কঠিন মামলাও সমাধানের প্রশংসনীয় রেকর্ড আছে। কিন্তু, বিশ্বাসযোগ্যতা নেই এমন তথ্য দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করা উচিত নয়।'

তদন্তে সত্য ঘটনা বের হয়ে না আসা পর্যন্ত সান্ত্বনা মিলবে না নুরুদ্দিন ও তার স্ত্রী ফারহানা ইয়াসমিনের। প্রথম সন্তান ফারদিনকে নিয়ে তাদের দুজনেরই বড় স্বপ্ন ও আশা ছিল।

'আমার নাম থেকে, আমি তার নাম নূর রেখেছি। "নূর" মানে আলো। আমরা ভেবেছিলাম সে তার জ্ঞান-প্রজ্ঞা দিয়ে আলো ছড়াবে। দেশের সম্পদ হয়ে উঠবে। সে সঠিক পথেই ছিল। কিন্তু তারপর এই ঘটনা ঘটলো,' বলেন ফারদিনের বাবা। সরকারি চাকরি ছেড়ে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে নেন তিনি। তার স্ত্রী ফারহানা ইয়াসমিন গৃহিণী।

এই দম্পতির স্বপ্ন ছিল তাদের ৩ ছেলেই বড় হয়ে পরিবারের চেহারা বদলে দেবে। তাদের কষ্টের দিনের অবসান ঘটাবে।

ছেলেদের পড়াশোনার জন্য তারা নারায়ণগঞ্জে বাড়ি থাকা সত্ত্বেও ডেমরার কোনাপাড়ায় ভাড়াবাসায় থাকতেন।

ফারদিন চতুর্থ শ্রেণি থেকে একা নিজের রুটিনে পড়াশুনা করতেন। ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে তিনি নিয়মিত বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে বই পড়তে যেতেন। নবম শ্রেণি থেকে টিউশন করাতেন।

'স্বল্প আয়ের কারণে আমরা তার যত্ন নিতে পারিনি। ফারদিন নিজেই নিজেকে তৈরি করেছে। সে যোদ্ধা, তার অদম্য প্রতিভা ছিল, যেকোনো পরিস্থিতিতে সে মানিয়ে নিতে পারতো... এখন, আমার এই সুন্দর ছেলেটি আর নেই,' বলেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English
NSC shop rent scam in Dhaka stadiums

Shop rent Tk 3 lakh, but govt gets just Tk 22,000

A probe has found massive irregularities in the rental of shops at nine markets of the National Sports Council (NSC), including a case where the government receives as little as Tk 22,000 in monthly rent while as much as Tk 3 lakh is being collected from the tenant. 

19h ago