‘সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় পথিকৃৎ ছিলেন রাজা রামমোহন রায়’

রাজা রামমোহন রায় ছিলেন বাংলার রেনেসাঁ মানব। সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে যেমন তিনি পথিকৃৎ ছিলেন, ঠিক তেমনি নারী শিক্ষার প্রসার, ভাষা শিক্ষা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, মানবতাবাদ ও দর্শনের ক্ষেত্রেও তিনি পালন করেছিলেন যুগান্তকারী ভূমিকা। রাজা না হলেও যুক্তিবোধ আর মূল্যবোধের জন্যই তাকে রাজা উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছিল। রামমোহন রায় প্রকৃত অর্থেই ছিলেন বিশ্ব নাগরিক।
রাজা রামমোহন রায়ের ২৫১তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় এসব কথা বলেন আলোচকরা। গতকাল সোমবার রাজধানীর পাটুয়াটুলীর ব্রাহ্ম সমাজ মন্দিরে 'সমকালের অপরিহার্য মহর্ষি রাজা রামমোহন রায়' শীর্ষক আলোচনা সভাটির আয়োজন করে বাংলাদেশ ব্রাহ্ম সমাজ। সভায় সভাপতিত্ব করেন বঙ্গীয় সাহিত্য সংস্কৃতি সংসদের সাধারণ সম্পাদক ও রামমোহন গবেষক কামরুল ইসলাম।
সভায় বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মিঠুন কুমার সাহা ও দীনেশচন্দ্র সেন গবেষণা কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক ড. চিন্ময় হাওলাদার।
অধ্যাপক মিঠুন কুমার সাহা বলেন, 'সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে পথিকৃৎ ছিলেন রাজা রামমোহন রায়। ১৮২৩ সালে তৎকালীন কোম্পানি সরকারের সমালোচনার দায়ে যখন জেমস বাকিংহাম প্রচারিত ক্যালকাটা জার্নালকে নিষিদ্ধ করা হয়, তখন রাজা রামমোহন রায় সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে সরকারের কড়া সমালোচনা করতেও দ্বিধাবোধ করেননি। তিনি বলেছেন, সংবাদপত্র নিষিদ্ধ করা মানে আমাদের নাগরিক অধিকারের ওপর আক্রমণ।'
তিনি বলেন, 'রামমোহন রায় যেমন ছিলেন সময়ের সন্তান, ঠিক তেমনি ছিলেন একটি সময়ের স্রষ্টা। নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে তখনকার সমাজ কাঠামো অনুযায়ী নারীকে রক্ষার জন্য রাজা রামমোহন রায় যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন, বর্তমান আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায়ও আমরা রামমোহন রায়ের চিন্তার প্রসারতা ধারের কাছেও পৌঁছাতে পারিনি। রাজা রামমোহন রায় প্রকৃতই বুঝেছিলেন, সমাজে-রাষ্ট্রে মানবতাবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য নারীকে অবশ্যই সঙ্গী করে এগোতে হবে। এ ক্ষেত্রে তিনি যুক্তির শক্তি প্রয়োগ করেছেন।'
ড. চিন্ময় হাওলাদার বলেন, 'রাজা রামমোহন রায় প্রকৃত অর্থেই ছিলেন একজন দার্শনিক। তিনি আরও ২-৩টি ধর্মের দ্বারা যেমন আলোড়িত হয়েছেন, ঠিক তেমনি নতুন ধর্মের প্রবক্তা হওয়ার ক্ষেত্রে তিনি গ্রহণ করেছেন বাকি ধর্মগুলোর সৌন্দর্য। ইসলাম থেকে যেমন সাম্যতা নিয়েছেন, ঠিক তেমনি বৈদিক দর্শন থেকে দর্শন গ্রহণ করেছেন। যুক্তিবোধ, মূল্যবোধ ও মানবতাবাদের জন্যই দ্বিতীয় আকবর তাকে রাজা উপাধি দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তাকে বলেছেন, ভারত পথিক।'
সভাপতির বক্তব্যে কামরুল ইসলাম বলেন, 'রাজা না হয়েও ভারতবর্ষের যুক্তিবোধ আর মূল্যবোধের রাজা ছিলেন রাজা রামমোহন রায়। নারীর ক্ষমতায়নে রাজা রামমোহন রায়ের ভূমিকা অপরিসীম। একই সঙ্গে স্বাদেশিক ও বিশ্ব নাগরিক ছিলেন রাজা রামমোহন রায়। উপনিবেশিক চিন্তায় যখন উপমহাদেশ পিছিয়ে পড়েছিল, তখন বুদ্ধি মুক্তির আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন রাজা রামমোহন রায়। তিনি ছিলেন উদার ভাবনার মানুষ।'
তিনি বলেন, 'রামমোহন রায় কোনো কিছু ধার করেননি, বরং দেশের সমাজের শাস্ত্র থেকেই পরাজিত শক্তিকে পরাজিত করেছেন। তবে তিনি হিংসাত্মক না হয়ে ভিন্নমতকে শ্রদ্ধার সঙ্গে ত্যাগ করেছেন। ভিন্নমতের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তার সবচেয়ে বড় অস্ত্র ও শক্তির জায়গা ছিল ভিন্নমতের শ্রদ্ধা ও সম্মান। একই সঙ্গে রামমোহন রায় বাঙালি জাতীয়তাবাদ থেকে বিশ্ব জাতীয়তাবাদে রূপান্তর করতে চেয়েছেন।'
অনুষ্ঠানে আলোচকরা বাংলাদেশে অধিকতর রামমোহন চর্চার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
আলোচনা অনুষ্ঠান শুরুর আগে রাজা রামমোহন রায়ের প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান আগত অতিথি ও দর্শনার্থীরা। ব্রাহ্ম সংগীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের সূচনা হয়। অনুষ্ঠানের শুরুতে স্বাগত বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ ব্রাহ্ম সমাজের সাধারণ সম্পাদক রনবীর পাল রবি। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সংগীতা চৌধুরী।
অনুষ্ঠান শেষে কামরুল ইসলামের লেখা 'আধুনিক বাঙালী রামমোহন রায়' শীর্ষক গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন করা হয়।
Comments