সরকার গায়েবি মামলা করে নিপীড়ন-জুলুমের যে রেকর্ড করেছে, তা নজিরবিহীন: ফখরুল

‘কোনো সভ্য-সুস্থ নাগরিক প্রতিপক্ষ সম্পর্কে এমন সন্ত্রাসীসুলভ কথা বলতে পারে না।’
গুলশানে সংবাদ সম্মেলনে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বিএনপি নেতারা। ছবি: সংগৃহীত

জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে আইনের নামে সরকার যা করছে, তা বেআইনি সন্ত্রাস ছাড়া আর কিছু নয় বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

আজ বুধবার রাজধানীর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ মন্তব্য করেন।

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, 'গত ৯ অক্টোবর অনুষ্ঠিত সভায় বিস্তারিত আলোচনা-পর্যালোচনা করে যেসব বিষয়ে সর্বসম্মত প্রস্তাব ও সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে, তার অন্যতম হলো—বিএনপির চেয়ারপারসন, গণতন্ত্রের মাতা, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার অসুস্থতার বিষয়ে তার চিকিৎসকদের সংবাদ সম্মেলনে দেওয়া বক্তব্যে দেশবাসীর মতোই বিএনপির সব পর্যায়ের নেতাকর্মী, সদস্য, সমর্থকরা উদ্বিগ্ন। দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে দেশনেত্রীর জীবন রক্ষার জন্য অনতিবিলম্বে তার সুচিকিৎসা সম্ভব—এমন কোনো দেশে যাওয়ার পথে আরোপিত অমানবিক বাধা দূর করার জন্য সরকারের প্রতি জোর দাবি জানিয়েছে।'

'দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটি দেশনেত্রীর দ্রুত সুচিকিৎসার বিষয়ে দারুণ উৎকণ্ঠার পাশাপাশি তার দণ্ড স্থগিতের শর্ত, বয়স ও অসুস্থতা নিয়ে সরকারপ্রধান ও মন্ত্রীদের অশোভন, নিষ্ঠুর ও অমানবিক বক্তব্য এবং প্রচলিত আইনের অযৌক্তিক ও ভ্রান্ত ব্যাখ্যা দিয়ে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা পূরণের অসুস্থ প্রয়াসের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানায়। দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটি দৃঢ়ভাবে মনে করে যে, শ্রেফ রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য যেমন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে অন্যায়ভাবে তার ক্যান্টনমেন্টের বাসভবন থেকে উৎখাত করা হয়েছিল, ঠিক একইভাবে বিনা অপরাধে ফরমায়েশি রায়ে তাকে পরিত্যক্ত কারাগারে পাঠিয়ে বিনা চিকিৎসা এবং ইচ্ছাকৃত ভুল চিকিৎসায় মৃত্যুর পথে ঠেলে দেওয়ার অপচেষ্টা চালানো হয়েছে।'

তিনি আরও বলেন, 'বিনাভোটে জোর করে ক্ষমতা দখলকারী বর্তমান সরকার যে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে জীবিত দেখতে চায় না, তার অনেক প্রমাণের অন্যতম হলো—প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক দেশনেত্রীকে "টুস করে পদ্মার পানিতে ফেলে দেওয়ার" ইচ্ছা প্রকাশ এবং সম্প্রতি "৮০ বছর বয়স হয়েছে, চলেই তো যাবে, এত কান্নাকাটির কী আছে?" এমন কথা বলা। কোনো দেশের সরকারপ্রধান তো দূরের কথা, কোনো সভ্য, মানবিক, সুস্থ সাধারণ নাগরিক প্রতিপক্ষ সম্পর্কে এমন সন্ত্রাসীসুলভ কথা বলতে পারে না। যে সরকার দেশনেত্রীর মৃত্যু চায়, সেই সরকার তার সুচিকিৎসায় অন্যায়ভাবে বাধা দেবে—এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু দেশবাসীর কাছে সরকারের এই মনোভাব ও আচরণ গ্রহণযোগ্য নয়। আর তাই গণমানুষের প্রিয় নেত্রীকে প্রাপ্য সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে তার কোনো ক্ষতি করা হলে সরকার অবশ্যই তীব্র গণরোষের শিকার হবে।'

বিএনপি মহাসচিব বলেন, 'গণবিরোধী নিশিরাতের সরকার শুধু দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকেই একটার পর একটা বানোয়াট অভিযোগে কারাদণ্ড দিচ্ছে না, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দেশনায়ক তারেক রহমানকেও তার অনুপস্থিতিতে কয়েকটি মিথ্যা ও বানোয়াট মামলায় কারাদণ্ড দিয়েছে। এমনকি তার স্ত্রী রাজনীতিতে সক্রিয় না থাকা সত্ত্বেও শুধু জিয়া পরিবারের সদস্য হওয়ার অপরাধে দণ্ডিত হয়েছেন। ইতোমধ্যে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুকে নয় বছর, ভাইস চেয়ারম্যান আমান উল্লাহ আমানকে ১৩ বছর, তার স্ত্রীকে তিন বছর, দলের ভাইস চেয়ারম্যান মো. শাহজাহানকে চার বছর, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা হাবিবুর রহমান হাবিবকে চার বছর, দলের কেন্দ্রীয় প্রকাশনা বিষয়ক সম্পাদক হাবিবুল ইসলাম হাবিবকে ৭০ বছর, দলের সহ-গ্রাম সরকার বিষয়ক সম্পাদক বেলাল আহমেদ ও কৃষিবিদ শামীমুর রহমান শামীম এবং জাতীয় পার্টির মহাসচিব সাবেক এমপি আহসান হাবিব লিংকনসহ ১৫ জন নেতাকর্মীকে চার বছর করে, রাজশাহী জেলা বিএনপি সভাপতি আবু সাঈদ চাঁদকে তিন বছর, যুবদল নেতা ইসহাক সরকারকে দুই বছর এবং ছাত্রদলের যুগ্ম সম্পাদক রেজাওয়ানুল হক সবুজকে দুই বছরসহ যুবদল, ছাত্রদল ও অন্যান্য অঙ্গ সংগঠনের অসংখ্য নেতাকর্মীকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়েছে।'

'এর বেশিরভাগই হয়েছে গত ২-৩ মাসের মধ্যে। অতি দ্রুত সাজা দেওয়ার লক্ষ্যে প্রতিদিনই বিএনপি ও অঙ্গদলের নেতাকর্মীদের মামলার শুনানি চলছে। কিছুদিন আগে সাতক্ষীরা জেলায় এবং ঈশ্বরদীতে দলের ও অঙ্গদলের বহু নেতাকর্মীর ফাঁসি, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।'

তিনি বলেন, 'আমরা জানতে পেরেছি যে, আইন মন্ত্রণালয়ে একটি বিশেষ শাখা খোলা হয়েছে, যাদের কাজ হলো বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মিথ্যা ও গায়েবি মামলার তালিকা করে নির্দিষ্ট কিছু মামলা দ্রুত বিচার করে সাজা দেওয়ার জন্য আদালতগুলোকে নির্দেশ দেওয়া। কাজটা শুরু হয়েছে এবং গতকালই ১৫ জন নেতাকে চার বছর করে সাজা দেওয়া হয়েছে। দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটি দৃঢ়ভাবে মনে করে যে, জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে আইনের নামে সরকার যা করছে, তা বেআইনি সন্ত্রাস ছাড়া আর কিছু নয়। সভায় অবিলম্বে এই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বন্ধ করার জন্য জোর দাবি জানানো হচ্ছে।'

'সম্প্রতি নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তারের ঘটনা দ্রুত বাড়ছে। পুলিশের পাশাপাশি ডিবি এ ব্যাপারে অধিক তৎপর। স্বাভাবিক দলীয় শান্তিপূর্ণ কর্মকাণ্ড, এমনকি গভীর রাতে ঘুম থেকে উঠিয়ে নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করে আগের কোনো গায়েবি মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এজাহারভুক্ত আসামি না হওয়া সত্ত্বেও জামিন দেওয়া হচ্ছে না। উচ্চ আদালত থেকে জামিনপ্রাপ্তরা নিম্ন আদালতে হাজিরা দিতে গেলেই জামিন নামঞ্জুর করে জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে।'

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, অন্যদিকে কারাগারে বন্দিদের ওপর নিপীড়ন-সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। প্রতিটি কক্ষে দ্বিগুণ-তিনগুণ বন্দিকে গাদাগাদি করে রাখা হচ্ছে। ১৫ দিনের আগে তো নয়ই, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ১৫ দিন পরেও বন্দিদের সঙ্গে আত্মীয়-স্বজন দেখা করতে পারেন না। দর্শনার্থীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার নিত্যই ঘটছে। খাবার অতি নিম্নমানের এবং রোগে চিকিৎসা পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। অর্থাৎ সব মিলিয়ে নেতাকর্মীদের ওপর অমানবিক নির্যাতন চালিয়ে সরকারবিরোধী আন্দোলন যেন একটি পাপকর্ম, তেমনটা বোঝানোর পাশাপাশি যারা বাইরে আছে তাদেরকে সন্ত্রস্ত করার অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে।

বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটি নির্যাতন, নিপীড়নের এসব ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে রাজনৈতিক বন্দিদের সঙ্গে আইনানুগ মানবিক আচরণ করার জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি জোর দাবি জানিয়েছে তিনি।

দলটির মহাসচিব বলেন, 'গত কয়েক বছরে ক্ষমতাসীন অবৈধ সরকার প্রায় ৭০০ বিরোধী নেতাকর্মীকে গুম, সহস্রাধিক নেতাকর্মীকে খুন, প্রায় ৫০ লাখ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে প্রায় এক লাখ ৪২ হাজার মিথ্যা ও গায়েবি মামলা করে নিপীড়ন ও জুলুমের যে নিকৃষ্ট রেকর্ড স্থাপন করেছে, তা বিশ্বে নজিরবিহীন। এর বিপরীতে ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনে জীবন উৎসর্গ করার নজির স্থাপন করেছে আমাদের দেশের বীর জনতা। তারা ভাষার জন্য জীবন দিয়েছে, স্বাধীনতার জন্য জীবন দিয়েছে এবং স্বাধীন দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্যও জীবন দিয়েছে ও দিচ্ছে। কোনো জীবনদানই বৃথা যায় না। শহীদের রক্তের ওপরই স্থাপিত হয় বিজয়ের পতাকা। আমাদের অনেক সাথী শহীদ হয়েছেন। এবার তাদের সীমাহীন আত্মত্যাগের বিনিময়ে ফ্যাসিবাদের পতন নিশ্চিত করে গণতন্ত্রের জয়যাত্রা নিশ্চিত করার লড়াইয়ে দেশের সংগ্রামী জনগণ অবশ্যই বিজয়ী হবে। বিএনপি সেই বিজয়ের লড়াইয়ে সম্পৃক্ত হওয়ার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে।'

শহীদ উদ্দিন চৌধুরী অ্যানিকে গ্রেপ্তারের বিষয়ে তিনি বলেন, গত রাতে আমাদের প্রচার সম্পাদক, মিডিয়া সেলের সদস্য সচিব, সাবেক এমপি ও নব্বইয়ের ছাত্র গণঅভ্যুত্থানের নেতা শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানিকে, তার বাড়িতে একেবারে রাতে ডাকাতি যেভাবে করে, সেভাবে দরজা ভেঙে গ্রেপ্তার করেছে। গ্রেপ্তার করেছে, বলে মামলা আছে। ঠিক আছে, মামলা থাকলে তো অন্যভাবেও তাকে গ্রেপ্তার করা যায় বা তাকে সারেন্ডার করতে বলা যায়। যে পদ্ধতিতে, যে ভঙ্গিতে তাকে গ্রেপ্তার করেছে, তা এটাই প্রমাণ করে এই সরকার ঠিক আগের মতোই, এখনো নির্বাচনের শিডিউল ঘোষিত হয়নি, তার আগেই বিরোধীদলের বিশেষ করে বিএনপি সক্রিয় নেতা যারা আছেন, যারা যোগ্য নেতা, তাদেরকে গ্রেপ্তার করে, মিথ্যা মামলা দিয়ে আগের মতোই একতরফা নির্বাচন করার দিকে তারা ভালোভাবে এগিয়ে চলেছেন। আমরা তার এই গ্রেপ্তারের তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি এবং অবিলম্বে তাকে মুক্তি দেওয়ার দাবি জানাচ্ছি।'

Comments