ভালোবাসা সবসময় বুকে থাকে প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে!

Bachchu
এলআরবির সদস্যদের সঙ্গে সাংবাদিক মইনুল হক রোজ (বামে নিচে বসা)। ছবি: সংগৃহীত

কিংবদন্তি শিল্পী আইয়ুব বাচ্চুর অজানা কিছু বিষয় উঠে এসেছে এই লেখায়, যা অনেকের অজানা ছিল। তার সঙ্গে পরিচয় আড্ডা বিভিন্ন কনসার্টে সফরসঙ্গী হয়েছেন অসংখ্যবার, সেসব স্মৃতি তুলে ধরলেন দুই দশকের সম্পর্কে জড়িয়ে থাকা সাংবাদিক মইনুল হক রোজ

কী দিয়ে লেখাটা শুরু করব? কোথা থেকে শুরু করা যায় বুঝছি না? বড় কঠিন একটা লেখা লিখতে হচ্ছে। আসলে জীবনের খুব বেশি ভালোবাসার বা পছন্দের কেউ যদি হঠাৎই এভাবে চলে যান, তাকে নিয়ে যদি স্মৃতিচারণ করতে হয় তা খুব কঠিন হয়ে যায়। স্মৃতি তখন মধুর না হয়ে কষ্টের রূপে ধরা দেয়।

আইয়ুব বাচ্চু নামটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে কোটি মানুষের ভালোবাসা, শ্রদ্ধা। এই বিশাল মাপের মানুষটির সঙ্গে টানা ২০টি বছর মেশার, তাকে খুব কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। ভক্ত তো তার ছিলামই আগে থেকে কিন্তু সাংবাদিকতা পেশায় আসার পর কর্মসূত্রেই পরিচয়ের শুরু। জানি না কোনো এক অজানা কারণে পরিচয়ের প্রথমদিন থেকেই বেশ পছন্দ করেছিলেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই পছন্দটা পেশাগত সীমারেখার বাইরে গিয়ে হয়ে উঠেছিল পুরোপুরিই আত্মিক। আসলে সেই সম্পর্কের নামটা যে কী, তা বলা কঠিন আমার জন্য। সেই সময়টাতে সপ্তাহে প্রায় প্রতিটি দিনই যাওয়া হতোই এবি কিচেনে। না গেলে কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগত। গেলেই আড্ডা হতো, এলআরবির ব্যান্ড প্র্যাকটিস, নতুন নতুন গানের ধুন শোনা- কত কী যে হতো!

এমনিতেই তখন ছিলাম কিছুটা বাউণ্ডুলে টাইপের। আর আড্ডা, গান শোনার নেশাটা ছিল চরম। কোনো কনসার্টই মিস করতাম না সেই সময়। এমন অনেক কনসার্ট আছে, যেখানে আমি শুধু গেছি বসের টানে, এলআরবির টানে। আর কনসার্টে গেলেই যে নিউজ করতে হবে, এমন কোনো বাধ্যবাধকতাও ছিল না।

একটা শো’র কথা বলি। ২০০২ সালের ঘটনা। রংপুর স্টেডিয়ামে একটা চ্যারিটি কনসার্ট ছিল সেটা। এলআরবি আর ভাইকিংস পারফর্ম করবে। শো’টা সম্ভবত রংপুর মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা আয়োজন করেছিল একটা বাচ্চার চিকিৎসার সাহায্যের জন্য। সেই কনসার্টে বসের সঙ্গে গিয়েছিলাম।

ঢাকা থেকে যখন রওনা হই, তখন সবই ঠিকঠাক। কিন্তু রংপুর ঢোকার ঠিক আগে থেকেই হঠাৎ প্রচণ্ড ঝড় আর বৃষ্টি শুরু হলো। বস গাড়ির মধ্যেই শামীম ভাইকে (এলআরবির ম্যানেজার ও সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার) বললেন, “এমন বৃষ্টি থাকলে শো করব কীভাবে?” শামীম ভাই উত্তর দিয়েছিলেন, “মনে হয় কাল আর বৃষ্টি হবে না বস।” যা-ই হোক সেই ঝড়-বৃষ্টি মাথায় নিয়েই আমরা রংপুর পৌঁছালাম। সবাই উঠেছিলাম পর্যটনের মোটেলে।

সারারাত ঝুম বৃষ্টির সঙ্গে ভোরবেলা একটা হালকা ভূমিকম্পও হয়েছিল সেদিন! কিন্তু ভোরের ভূমিকম্পের পর যে আরো কত বড় বিস্ময়ের ভূমিকম্প অপেক্ষা করছিল আমাদের জন্য, তা তো আর জানতাম না। আমার ঠিক খেয়াল নেই সময়টা। শো’র দিন সকাল ১০-১১টার দিকে শামীম ভাই রংপুর স্টেডিয়াম থেকে এসে জানালেন পুরো স্টেডিয়াম পানির নিচে! এ অবস্থায় শো করাটা অসম্ভব। এই কথা শুনে বস কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, শো’টা তিনি করতে চান! যদি স্টেডিয়ামে সম্ভব না হয়, তাহলে রংপুরে কোনো বড় হল থাকলে তিনি সেখানেই শো করবেন। কারণ তা না হলে টিকিট বিক্রির সব টাকা ফেরত দিতে হবে আর বাচ্চাটার চিকিৎসার টাকাও উঠবে না। কাজেই যেভাবেই হোক শো করবেন।

শামীম ভাই বললেন, “এত বড় হল রংপুরে নেই।” বস বললেন, “সাউন্ড সিস্টেম যেভাবেই হোক ব্যবস্থা করতে।” দুজনার কথা শুনছিলাম আর ভাবছিলাম কেমনে? স্টেডিয়ামের ভেতরে প্রায় বুক সমান পানি, এই শো কেমনে হয়? কিন্তু শো শেষ পর্যন্ত হয়েছিল! এলআরবি যে গাড়িতে করে স্টেডিয়ামে গিয়েছিল সে গাড়ি পানির জন্য স্টেডিয়াম পর্যন্ত যেতে পারেনি। গাড়ির ভেতরেই বসসহ এলআরবির সব সদস্য জুতো খুলে প্যান্ট হাঁটুর ওপর পর্যন্ত গুটিয়ে যার যার ইনস্ট্রুমেন্টস হাতে নিয়ে পানি ভেঙে ঢুকেছিলেন স্টেডিয়ামের ভেতর। সে এক অবিশ্বাস্য দৃশ্য!

আইয়ুব বাচ্চু তার গিটার দু’হাতে মাথার ওপরে তুলে ধরে প্রায় কোমর পানি ভেঙে হেঁটে যাচ্ছেন মঞ্চের দিকে! পুরো স্টেডিয়ামজুড়ে সেই দৃশ্য দেখে যে ভালোবাসার চিৎকারের ঝড় উঠেছিল, তা কোনোদিন ভুলব না। এরপর বস সেই শো এমনই মাতিয়েছিলেন যে, এক সময় পুরো স্টেডিয়ামের দর্শক গ্যালারি ছেড়ে নেমে এসেছিলেন সেই পানি ভরা মাঠে। কী এক দৃশ্য! সেই শো শেষ করে একইভাবে পানি ভেঙেই আবার ফিরেছিলাম হোটেলে।

শো’টা শেষ করে পরেরদিন আবার যখন ঢাকার দিকে রওনা দিলাম রংপুর থেকে, তখন কিন্তু বস সেই বাচ্চাটাকে দেখতে গিয়েছিলেন তাদের বাসায়। বলেছিলেন, এরপরও যদি বাচ্চাটার কিছু লাগে উনাকে জানাতে।

ঢাকা ফেরার পথে জিজ্ঞাসা করেছিলাম “বস, যদি কাল শো’টা না করতে পারতেন, তাহলে কী হতো?” উনার উত্তরটা ছিল অনেকটা এ রকম, “কিছুই হতো না। দরকার হলে আজকে করতাম, নাহলে আগামীকাল করতাম। কিন্তু এই শো করতাম। আর কিছু না হোক বাচ্চাটার জন্য হলেও এই শো শেষ না করে আমি ঢাকায় ফিরতাম না।” এই ছিলেন আইয়ুব বাচ্চু। তার কথার দাম ছিল প্রচণ্ড।

আর একটা ব্যাপার এখানে না বললেই নয়। খুবই দানশীল, পরোপকারী একজন মানুষ ছিলেন বস। কতজনকে যে কতভাবে গোপনে তিনি সাহায্য করে গেছেন তার হিসাব নেই। এ বিষয়গুলো যদি আমরা কেউ জেনে ফেলতাম, তাহলে তৎক্ষণাৎ আমাদের নিষেধ করে দিতেন, কখনো যেন এসব ব্যাপার কাউকে না বলি।

এ রকম অসংখ্য স্মৃতি বসকে ঘিরে রয়েছে আমার। সবাই জানেন তার মাতৃভক্তির কথা। খালাম্মা মানে (বসের আম্মা) মারা যাওয়ার পর বস খুব ভেঙে পড়েছিলেন। কিন্তু তার এই ভেঙে পড়াটা কাউকে বুঝতে দিতে চাইতেন না। ওই সময়টাতে তিনি নিজের স্টুডিওতেই থাকতেন বেশি। স্টুডিওতে গেলেই দেখতাম প্রিয় গিটারগুলো নিয়ে বসে আছেন। মাঝেমাঝে ড্রামসেও গিয়ে বসতেন।

একদিন এবি কিচেনে গিয়েছি। ঢোকার পর বললেন, “আয় একটা গান গাচ্ছি নতুন, শুনে যা।” আমাকে নিয়ে গেলেন স্টুডিওর ভয়েস রুমে। গানটা যখন শোনাচ্ছিলেন, তখন তার দুচোখ বেয়ে অঝোর ধারায় পানি পড়ছিল। গানটা ছিল ‘মা’। মা হারানো এক সন্তানের আবেগ যে কত তীব্র, কত কষ্টের হতে পারে, সেদিন বসকে দেখে বুঝেছিলাম আরো একবার। এই গানটা ছিল তার বুকে জমে থাকা বিশাল কষ্ট সরানোর একটা চেষ্টা আর মায়ের প্রতি তার ভালোবাসার প্রকাশ মাত্র।

লেখার শুরুতেই বলেছিলাম, খুব ভালোবাসার কেউ হঠাৎ করে চলে গেলে তাকে ঘিরে স্মৃতিগুলো বড় কষ্টের হয়ে দাঁড়ায়। আর তাই স্মৃতির খাতাটা আপাতত একটু বন্ধ করে রাখতে চাই। কারণ যে মানুষটার জন্য এক জীবনে অনেক সুখের হাসি আমি হেসেছি, তাকে আমি স্মৃতির তালিকায় রাখতে চাই না। তাকে রাখতে চাই ঠিক তেমনটাই জীবন্ত উজ্জ্বল করে নিজের ভেতরে, যতটা আমি পেয়েছি গত ২০টা বছর। ‘বস’ আপনি ছিলেন, থাকবেন। আর ‘বস’ আরেকটা কথা, ভালোবাসা কখনো মরে না, ভালোবাসা সবসময় ভালোবাসার জায়গাতেই থাকে প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে।

Comments

The Daily Star  | English

JP central office vandalised, set ablaze

A group of unidentified people set fire to the central office of Jatiyo Party in Dhaka's Kakrail area this evening

1h ago