প্রধানমন্ত্রীর সামনে ইতিহাসের হাতছানি

দলীয় সরকারের অধীনেও যে সুষ্ঠু নির্বাচন হয়, আগামী জাতীয় নির্বাচন করে তা ‘দেখিয়ে দেওয়া’ হবে। প্রধানমন্ত্রীর এই আশ্বাসের কথাটা গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি বিরোধী দলকে সরকারের প্রতি ‘বিশ্বাস’ এবং ‘আস্থা’ রাখতে বলেছেন। বিশ্বাস-আস্থার এই আকালের দিনে, তা কতটা রাখা যাবে বা বিরোধী দল কতটা রাখবে?
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ছবি: বাসস ফাইল ফটো

দলীয় সরকারের অধীনেও যে সুষ্ঠু নির্বাচন হয়, আগামী জাতীয় নির্বাচন করে তা ‘দেখিয়ে দেওয়া’ হবে। প্রধানমন্ত্রীর এই আশ্বাসের কথাটা গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি বিরোধী দলকে সরকারের প্রতি ‘বিশ্বাস’ এবং ‘আস্থা’ রাখতে বলেছেন। বিশ্বাস-আস্থার এই আকালের দিনে, তা কতটা রাখা যাবে বা বিরোধী দল কতটা রাখবে? সংক্ষেপে কিছু কথা।

১. প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসকে ‘বিশ্বাস’ করে ‘আস্থা’ রেখে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট যদি নির্বাচনে অংশ নিতো এবং নির্বাচনটি যদি সুষ্ঠু গ্রহণযোগ্য হতো, এর চেয়ে ভালো কিছু আর হতে পারত না। সকল প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করে প্রধানমন্ত্রী সংলাপে সাড়া দিয়ে বৈরী রাজনীতিতে একটা ইতিবাচক পরিবেশ তৈরি করেছেন। এখন একটি সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারলে তিনি ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকতে পারবেন।

জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট যদি প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতি ‘আস্থা’ এবং ‘বিশ্বাস’ না রাখে, তা হবে সুষ্ঠু-অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের অন্তরায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যের ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছতে কষ্ট হয় না যে, সরকার একটি সুষ্ঠু গ্রহণযোগ্য নির্বাচন চায়। যদিও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাস ‘বিশ্বাস’ করে ‘আস্থা’য় নিয়ে নির্বাচন করবে, তা বলা যাচ্ছে না। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের বক্তব্য থেকে বোঝা যাচ্ছে তারা প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসে ‘বিশ্বাস’ রাখছেন না, আরও কিছু চাইছেন।

২. ‘বিশ্বাস’ অর্জনের জন্যে সরকার বা প্রধানমন্ত্রীর আর কিছু করণীয় আছে কি না বা কেন করবেন? করবেন এই কারণে যে, যেহেতু প্রত্যাশা একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের, যা প্রধানমন্ত্রী নিজেও চাইছেন। আর আন্তরিকতা থাকলে সংবিধানের ভেতরে থেকেই আরও কিছু করার সুযোগও আছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার জাতীয় কিছু করা সম্ভব না হলেও, সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচন করার সুযোগ সংবিধানের ভেতরেই আছে।

সংবিধানের ১২৩(৩) অনুচ্ছেদে লেখা আছে

‘সংসদ-সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে

(ক) মেয়াদ-অবসানের কারণে সংসদ ভাংগিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাংগিয়া যাইবার পূর্ববর্তী নব্বই দিনের মধ্যে; এবং

(খ) মেয়াদ-অবসান ব্যতীত অন্য কোন কারণে সংসদ ভাংগিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাংগিয়া যাইবার পরবর্তী নব্বই দিনের মধ্যে’

অর্থাৎ ‘পূর্ববর্তী’ নব্বই দিনের মধ্যে নির্বাচন করার যেমন সুযোগ আছে, ‘পরবর্তী’ নব্বই দিনের মধ্যেও নির্বাচন করার সুযোগ আছে। সংবিধানের ভেতরে থেকেই তা সম্ভব। এখানেই প্রশ্ন আসে আন্তরিকতার। সরকারের পক্ষ থেকে মুখের আন্তরিকতা সংলাপ পর্বে দৃশ্যমান হয়েছে।

কিন্তু ‘আন্তরিকতা’ বাস্তবায়ন পর্বে এসে যেন অদৃশ্য হয়ে পড়ছে।

৩. ‘গ্রেপ্তার বা মামলা’ দেওয়া হবে না, শুধু আশ্বাসে ‘বিশ্বাস’ ভিত্তি পাচ্ছে না। রাজশাহীতে সমাবেশের আগের রাতে গ্রেপ্তার চলেছে। রাজশাহীতে যান চলাচল বন্ধ করে দিয়ে সমাবেশে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয়েছে।

প্রথম সংলাপেও  প্রধানমন্ত্রী গ্রেপ্তার-মামলা না দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিলেন। মাঠপর্যায়ে তার প্রতিপালন দেখা যায়নি। ৬ নভেম্বরের সমাবেশের আগে পরেও পুলিশ মামলা দিয়েছে, গ্রেপ্তার করছে। কোনো ঘটনা ঘটেনি কিন্তু ‘সহিংসতা’ করতে পারে, এই অজুহাতে মামলা-গ্রেপ্তার করতে দেখা গেছে।

৪. বিরোধী দল তথা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের কাছে ‘আস্থা’ ‘বিশ্বাস’ প্রত্যাশা করলে, আরও একটু  আগে থেকে শুরু করা দরকার ছিল। বিগত নির্বাচনগুলো যদি কিছুটা হলেও সুষ্ঠু করা যেতো, তবে হয়তো ‘বিশ্বাস’ ‘আস্থা’র পরিবেশ এখন বিরাজমান থাকতে পারতো। নারায়ণগঞ্জ, রংপুর আর কুমিল্লা ছাড়া কোনো নির্বাচন প্রশ্নের ঊর্ধ্বে রাখা যায়নি। যা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের জন্যে ‘বিশ্বাস-আস্থা’ রাখার ক্ষেত্রে বড় রকমের প্রতিবন্ধকতা।

যে পুলিশ ‘গায়েবি’ মামলা দিয়ে হাজার হাজার নেতাকর্মী গ্রেপ্তার করছে, সেই পুলিশের ওপর ‘আস্থা’ রাখা সহজ নয়। এক্ষেত্রেই সেনাবাহিনীর প্রসঙ্গ এসেছে। যুক্তি হিসেবে যা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।

৫. সরকার-জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট দুই পক্ষের মাঝখানে শক্তিশালী ভূমিকা নিয়ে দৃশ্যমান হওয়া দরকার ছিল নির্বাচন কমিশনের।

দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, নির্বাচন কমিশনকে সেই ভূমিকায় দেখা যাচ্ছে না।

ইতিমধ্যে তারা নিজেদের সেই ইমেজ প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। অন্য সময়ের চেয়ে তড়িঘড়ি করে তফসিল ঘোষণা করায় মরিয়া হয়ে উঠেছে। ইভিএম নিয়ে অতি আগ্রহের কারণে নির্বাচন কমিশন নিয়ে সন্দেহ বেড়েছে। নির্বাচন কমিশনের সচিবের বক্তব্য, শারীরিক বাচনভঙ্গি কোনো কোনো ক্ষেত্রে সহনশীল বা দায়িত্বশীল নয়। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পদযাত্রার কর্মসূচি তিনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে প্রতিরোধের হুংকার দিয়েছেন। যার সঙ্গে রাজনৈতিক সরকারের বক্তব্যের মিল পাওয়া যায়। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের সচিবের বক্তব্য এমন হওয়া প্রত্যাশিত নয়। পদযাত্রা করার অধিকার জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আছে। তারা অরাজকতা করলে নিশ্চয়ই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তা প্রতিরোধ করবে। কিন্তু কমিশনের সচিব তা নিয়ে রাজনৈতিক সরকারের মতো কথা বললে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের মর্যাদাহানি হয়। সচিব যা ইতিমধ্যে করেছেন। সচিবের পরিবর্তে নির্বাচন কমিশনারদের কাউকে যদি কথা বলার দায়িত্ব দেওয়া হয়, তা অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য হতে পারে।

‘সুষ্ঠু নির্বাচনের নিশ্চয়তা দেওয়া সম্ভব নয়’- বলে প্রধান নির্বাচন কমিশনারও পদের মর্যাদা রক্ষা করতে পারেননি। অন্য কমিশনারদের বাদ দিয়ে সচিবের সঙ্গে মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েও বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রধান নির্বাচন কমিশনার একা বা সচিব মিলে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। সব সিদ্ধান্ত নিতে হবে সব নির্বাচন কমিশনার মিলে, সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং সচিবের এই পদে থাকা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ তারা নিজেরাই তৈরি করে দিয়েছেন।

৬. সংলাপের প্রভাবে রাজনীতিতে যে ইতিবাচক পরিবেশ সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়েছে তা যদি অক্ষুণ্ণ না থাকে, অচিরেই আশা পরিণত হতে পারে হতাশায়। প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনের আগে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের রোড মার্চ স্থগিতকে ইতিবাচকভাবে দেখার সুযোগ আছে। প্রধানমন্ত্রী তার স্থগিত রাখা সংবাদ সম্মেলনে সেই ইতিবাচকতাকে ভিত্তি দিতে পারেন। সংবিধানের ভেতরে থেকে মেনে নেওয়া সম্ভব এমন কিছু বিষয় তিনি বিবেচনায় নিতে পারেন। সেই সুযোগ এখনো রয়ে গেছে। ছাড় দেওয়ার মানসিকতা থাকতে হবে ঐক্যফ্রন্টেরও। সব দাবি মানতেই হবে, এমন কঠোর অবস্থানে থাকা যাবে না। এক্ষেত্রে তড়িঘড়ি পর্ব স্থগিত করে, কার্যকর দায়িত্বশীল আচরণের সুযোগ আছে নির্বাচন কমিশনের।

৭. আশাবাদী হয়েই লেখাটা শেষ করতে চাইছি। যদিও সেই আশাবাদে ‘কিন্তু’র উপস্থিতি বাদ দেওয়া যাচ্ছে না। রাজশাহীর সমাবেশকে নিয়ে যা ঘটছে, প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসের সঙ্গে তার মিল নেই। মিল রাখার সুযোগ শেষ হয়ে যায়নি। এখনো যা কিছু ঘটছে, প্রধানমন্ত্রী চাইলেই তা বন্ধ করতে পারেন। বাংলাদেশে দলীয় সরকারের অধীনে কোনো জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার নজির নেই। সেই নজির তৈরি করতে পারেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি সংলাপে যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তা বাস্তবায়ন করে ‘দেখিয়ে দিতে’ পারেন, বঙ্গবন্ধু কন্যা যা বলেন তা করেন।

পরপর দুই মেয়াদে ক্ষমতায় থেকে, একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে তিনি ইতিমধ্যে অনন্য নজির তৈরি করেছেন। আন্দোলন করে বাধ্য করতে না পারলেও যে যৌক্তিক দাবি মেনে নেওয়া যায়, তা ‘দেখিয়ে দিতে’ পারেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করে ইতিহাসের পাতায় স্থান পাওয়ার সুযোগ এসেছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সামনে। সারা দেশ তাকিয়ে আছে তার দিকে।

Comments

The Daily Star  | English

Abu sayed’s death in police firing: Cops’ FIR runs counter to known facts

Video footage shows police shooting at Begum Rokeya University student Abu Sayed, who posed no physical threat to the law enforcers, during the quota reform protest near the campus on July 16. He died soon afterwards.

8h ago