স্ত্রীরা যখন বেশি সম্পদশালী!
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য নির্বাচন কমিশনে (ইসি) জমা দেওয়া প্রার্থীদের হলফনামা পর্যালোচনা করে বেশ অবাক করা তথ্য পাওয়া গেছে। হলফনামায় দেখা গেছে, জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এবং ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননের স্ত্রীরা তাদের স্বামীদের চেয়েও বেশি সম্পদের মালিক।
এমনকি, গত ১০ বছরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের চেয়েও তার স্ত্রীর আয় ক্রমান্বয়ে বহুগুণ বেড়ে যাওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে।
অপরদিকে, নিজের ব্যবসা থেকে মাসে ৫০ হাজার টাকা আয় করেন বলে দাবি করেছেন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী সালমান এফ রহমান। হলফনামায় ব্যক্তিগত কোনো ইলেকট্রনিক সামগ্রী ও আসবাবপত্র নেই উল্লেখ করলেও, স্ত্রীর চেয়ে তার কাছে বেশি সোনা আছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
এরশাদ এবং তার স্ত্রী
বিগত তিনটি নির্বাচনে দাখিলকৃত হলফনামায় বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ার, বেতন-ভাতা ও অনির্দিষ্ট ব্যবসা থেকে উপার্জনকে নিজের আয়ের উৎস হিসেবে দেখিয়ে এসেছেন সাবেক রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। যদিও এসব উৎস সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য তিনি দেননি। এরশাদের স্ত্রী রওশন এরশাদের আয়ের ক্ষেত্রেও শেয়ার, ইজারা, বিনিয়োগ এবং বিবিধ উৎস উল্লেখ করা হয়।
এই দম্পতির এবারের নির্বাচনী হলফনামা বলছে, এরশাদের বাৎসরিক আয় ১ কোটি ৮০ হাজার টাকা এবং রওশন এরশাদের ১ কোটি ১৩ লাখ টাকা। এরশাদের স্থাবর সম্পত্তির মধ্যে আছে নিজের নামে বারিধারা, বনানী ও গুলশানে তিনটি ফ্ল্যাট।
এদিকে, ইউনিয়ন ব্যাংক ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংকে এরশাদের ঋণ আছে ২ কোটি ৩২ লাখ ৪ হাজার ৬৩৫ টাকা। যদিও ইউনিয়ন ব্যাংকের পরিচালক হিসেবে তিনি বাৎসরিক বেতন পান ৭৪ লাখ টাকা। অপরদিকে নিজের কাছে ৩৫ কোটি ১ লাখ টাকা নগদ অর্থ থাকার হিসাব দাখিল করেছেন রওশন।
মেনন এবং তার স্ত্রী
বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননের সম্পত্তি তার স্ত্রীর চেয়ে কম রয়েছে বলে জানা গেছে। বর্তমানে তার কাছে নগদ ৭ লাখ ৫৭ হাজার টাকা এবং তার স্ত্রীর কাছে ৭ লাখ ৯৬ হাজার টাকা রয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে।
সমাজকল্যাণমন্ত্রী রাশেদ খান মেননের সঞ্চয় ৩০ হাজার টাকা এবং স্ত্রীর সঞ্চয় ৪৫ লাখ টাকা রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
গত নির্বাচনে মেননের ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বন্ড, ঋণপত্র, শেয়ারবাজার, সঞ্চয়পত্র ও স্থায়ী আমানত ছিল ১২ লাখ ৫৬ হাজার টাকা। আর স্ত্রীর নামে ছিল ২৭ লাখ টাকা। বর্তমানে তার স্থায়ী আমানত রয়েছে ৭ লাখ ৪৬ হাজার টাকা। স্ত্রীর নামে রয়েছে ৫০ লাখ ৮০ হাজার টাকা।
এছাড়াও, গাড়ির সংখ্যা কমেছে মেননের। তার ৬০ লাখ এবং ৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা দামের দুটি গাড়ি ছিলো। বর্তমানে ৬১ লাখ ৮৫ হাজার টাকা দামের একটি গাড়ি রয়েছে।
স্থাবর সম্পত্তি হিসেবে তার রাজউক পূর্বাচলে ৩০ লাখ টাকার জমি, স্ত্রীর নামে ৫ লাখ টাকার জমি ও ২টি ফ্ল্যাট ছিলো। বর্তমানে ৩৭ লাখ ২০ হাজার টাকার জমি ও স্ত্রীর নামে ১ কোটি ৪৯ লাখ ৮০ হাজার টাকা মূল্যের একটি ফ্ল্যাট রয়েছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও তার স্ত্রী
গত ১০ বছরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের চেয়ে তার স্ত্রীর আয় বেড়েছে প্রায় ৪৮ গুণ। মন্ত্রী ও তার স্ত্রীর বার্ষিক আয় দেখানো হয়েছে ১ কোটি ২৫ লাখ ৬৪ হাজার টাকা।
এবারের হলফনামায় কামালের মোট অস্থাবর সম্পত্তির হিসাব দেখানো হয়েছে ৪ কোটি ৪৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা। স্থাবর সম্পত্তি ১ কোটি ১৪ লাখ ৪৫ হাজার টাকা। কামাল তার অস্থাবর সম্পত্তির মধ্যে নগদ টাকা দেখিয়েছেন ২ লাখ ৭০ হাজার ৬৮৫ টাকা। তার স্ত্রীর নগদ টাকার পরিমাণ উল্লেখ করা হয়েছে ৩৯ লাখ ৩৬ হাজার টাকা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ১০ ভরি ও তার স্ত্রীর ২০ ভরি সোনা রয়েছে বলে হলফনামা দেওয়া আছে।
হলফনামায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরও উল্লেখ করেছেন, তার আয়ের মধ্যে রয়েছে বাড়ি, অ্যাপার্টমেন্ট, দোকান বা অন্যান্য ভাড়া থেকে ৩ লাখ ৬০ হাজার, শেয়ার, সঞ্চয়পত্র, ব্যাংক আমানত থেকে ৭ লাখ ৬১ হাজার টাকা।
চাকরি ও মন্ত্রী হিসেবে প্রাপ্ত বেতন ও ভাতা ২৩ লাখ ২৭ হাজার টাকা। অন্যান্য ৩০ লাখ ৩০ হাজার টাকা। সব মিলে কামালের মোট বার্ষিক আয় ৬৪ লাখ ৭৯ হাজার টাকা। অন্যদিকে, তার স্ত্রীর মোট বার্ষিক আয় দেখানো হয়েছে ৬০ লাখ ৮৫ হাজার টাকা। যার মধ্যে ব্যবসা থেকে আসে ৪৯ লাখ ২২ হাজার টাকা।
সালমান এফ রহমান এবং তার স্ত্রী
শিল্পপতি সালমান এফ রহমান, যিনি গতবছর চীন-ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান হুরুন গ্লোবালের তালিকায় বিশ্বের ২ হাজার ২৫৭ জন ধনী ব্যক্তির মধ্যে ১ হাজার ৬৮৫তম অবস্থানে ছিলেন, তিনি হলফনামায় দাবি করেছেন যে ব্যবসা থেকে মাসে তার ৫০ হাজার টাকা আয় হয়।
তার কোনো ইলেকট্রনিক সামগ্রী নেই, নেই কোনো আসবাবপত্র, বৈদেশিক মুদ্রা, বাড়ি বা অ্যাপার্টমেন্ট। যদিও হুরুন গ্লোবালের তথ্য অনুযায়ী সালমান এফ রহমানের সম্পদের পরিমাণ ১৩০ কোটি মার্কিন ডলার যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি।
হলফনামায় সালমান ২০১৮ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত পাঁচটি খাতে তার আয় দেখিয়েছেন। এর মধ্যে তার সবচেয়ে বেশি আয়- বাংলাদেশ এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট কোম্পানির বোনাস শেয়ার ও আইএফআইসি ব্যাংকের বোনাস শেয়ার বাবদ ৪ কোটি ৫৬ লাখ ৯৮ হাজার টাকা। শেয়ারবাজার ও ব্যাংক আমানতের লভ্যাংশ থেকে তার আয় ৪ কোটি ২৫ লাখ ৮৭ হাজার টাকা। এছাড়াও, চাকরি (সম্মানী ভাতা) থেকে ৪১ লাখ ৯২ হাজার টাকা, ব্যবসা থেকে ৬ লাখ টাকা, বাড়ি, দোকান বা অন্যান্য ভাড়া থেকে তার আয় ৩ লাখ ৯৯ হাজার টাকা।
স্থাবর সম্পত্তির মধ্যে হলফনামা অনুযায়ী সালমান এফ রহমানের নগদ টাকা রয়েছে ২ কোটি ১০ লাখ এবং ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা আছে ২ কোটি ৮৬ লাখ ৭০ হাজার টাকা। তার স্ত্রীর নগদ ৬০ হাজার টাকা, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ৪৫ লাখ ৫১ হাজার টাকা এবং ১ লাখ ৮০ হাজার টাকার সোনার অলংকার রয়েছে। এছাড়াও সালমানের ৩৪ লাখ টাকার গাড়ি, ১৫ লাখ টাকার সোনা ও মূল্যবান ধাতু রয়েছে।
হলফনামার তথ্য অনুযায়ী অস্থাবর সম্পত্তির মধ্যে সালমানের ২ কোটি ৩ লাখ ও তার স্ত্রীর ৩ কোটি ৭৩ লাখ টাকার অকৃষিজমি রয়েছে। নিজের ৮ লাখ ৫৩ হাজার টাকার দালান রয়েছে। তবে, স্ত্রীর নামে ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে ২৫ কোটি ১৯ লাখ ৭১ হাজার টাকার সম্পদ দেখানো হয়েছে।
সালমান এফ রহমান দেখিয়েছেন, তার ৮৩ কোটি ৭৯ লাখ ৫৩ হাজার টাকা দায়-দেনা রয়েছে। তার স্ত্রী ৪৪ লাখ ২ হাজার টাকার দেনাদার সালমান রহমানের কাছেই। তার স্ত্রী বেক্সিমকো গ্রুপের প্রতিষ্ঠান বেক্সিমকো হোল্ডিংয়ের কাছেও দেনাদার ১২ কোটি ৬১ লাখ ২৫ হাজার টাকা।
Comments