জাহালমের পুনর্বাসনের জন্য আপাতত ১০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ চাওয়া উচিত ছিল: শাহদীন মালিক
সোনালী ব্যাংকের প্রায় সাড়ে ১৮ কোটি টাকা জালিয়াতির অভিযোগে আবু সালেকের বিরুদ্ধে ৩৩টি মামলা হয়। এর মধ্যে ২৬টিতে জাহালমকে আসামি আবু সালেক হিসেবে চিহ্নিত করে অভিযোগপত্র দেয় দুদক।
পাঁচ বছর আগে দুদক কার্যালয়ে হাজির হয়ে জাহালম বলেছিলেন, তিনি সালেক নন। বাংলায় লিখতে পারলেও ইংরেজিতে লিখতে জানেন না। কিন্তু, নিরীহ পাটকলশ্রমিক জাহালমের কথা সেদিন দুদকের কেউ বিশ্বাস করেননি।
এরপর, ২০১৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি দুদকের এসব মামলায় জাহালম গ্রেপ্তার হন। জাহালমের কারাবাসের তিন বছর পূর্ণ হবে আগামী ৬ ফেব্রুয়ারি। দুদক এখন বলছে, জাহালম নিরপরাধ প্রমাণিত হয়েছেন। তদন্ত করে একই মত দিয়েছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনও।
আজ (৩ ফেব্রুয়ারি) দুদকের সব মামলা থেকে নিরীহ জাহালমকে অব্যাহতি দিয়ে আজই মুক্তি দিতে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে আদালত এই ভুল তদন্তের সঙ্গে কারা জড়িত, তাদের চিহ্নিত করার নির্দেশ দিয়েছেন। না হলে আদালত হস্তক্ষেপ করবেন বলে জানান।
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক দ্য ডেইলি স্টার অনলাইনকে বলেন, “দুদকের মামলায় বিনাদোষে তিনবছর কারাভোগ করেছেন জাহালম। তবে, দুদক তো রাষ্ট্রের অংশ। যেকোনো ফৌজদারি মামলায় সবসময় বাদী হয় রাষ্ট্র। তো সর্বোপরি এই মামলাটি রাষ্ট্র বনাম জাহালমের মধ্যে বিদ্যমান। এখানে রাষ্ট্রের পক্ষ হয়ে দুদক মামলা করেছে। সুতরাং এখানে রাষ্ট্রের কর্মকাণ্ডের ফলে জাহালমের ক্ষতি হয়েছে এবং রাষ্ট্রের পক্ষে ভুল স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে।”
“অতএব, এখানে প্রথমেই জাহালমের আইনজীবীদের উচিত ছিল- আজ যে হাইকোর্ট বেঞ্চ জাহালমের জামিনের আদেশ দিয়েছেন, সেই আদালতের কাছে জাহালমের আপাতত পুনর্বাসনের জন্য অন্তত ১০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ চাওয়া। কিন্তু, এখানে তো ক্ষতিপূরণ চাওয়ারও লোক নেই। কারণ- আসামির আইনজীবী গিয়ে তো বলবেন, যে দুদকের দোষী কর্মকর্তাদের শাস্তি দিন। কিন্তু, দুদক কর্মকর্তাদের শাস্তি হলে জাহালমের কী লাভ হবে?”, বলেন তিনি।
শাহদীন মালিক বলেন, “এসব ঘটনার ক্ষেত্রে কারো শাস্তি নিশ্চিত করা যায় না। কারণ- এটা প্রমাণ করা যায় না যে, কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে অপরাধ করেছে। এখানে প্রশাসনিক অদক্ষতার বিষয়টি সামনে চলে আসে। তারপরও, এ ঘটনায় দুদকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের প্রশাসনিক অদক্ষতা অথবা ইচ্ছাকৃত ভুলের জন্য শাস্তি হিসেবে পদাবনতি থেকে শুরু করে চাকরিচ্যুতি পর্যন্ত হতে পারে।”
সুপ্রিম কোর্টের এই আইনজীবী বলেন, “জাহালমের আইনজীবী আদালতে ক্ষতিপূরণের আবেদন না করলে আদালত তা দেবেন না। কারণ- আদালতের কাজ বিচার করা। দুই পক্ষের কথা শুনে আদালত তার সিদ্ধান্ত জানাবেন। এই ধরনের বিশেষ মামলার ক্ষেত্রে আদালত স্বপ্রণোদিত হয়ে আসামিকে ছাড়ানোর ব্যবস্থা করেন। কিন্তু, ক্ষতিপূরণের জন্য তার আইনজীবীকে চাইতে হবে।”
প্রায় আড়াইশো-তিনশো বছর আগেই দার্শনিকরা বলে গেছেন, যে জাতি যতো অসভ্য এবং বর্বর, সেই জাতি একটি সমস্যার সমাধান ততো বেশি শাস্তির মাধ্যমে খুঁজে থাকে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
ভুক্তভোগী পাটকল শ্রমিক জাহালমের পক্ষে আজ আদালতে শুনানিতে অংশ নেওয়া আইনজীবী অমিত দাস গুপ্ত বলেন, “জাহালম সম্ভবত আজই মুক্ত হয়ে যাবেন। কারণ- আদালতের দেওয়া আদেশটি বিশেষ বার্তা প্রেরকের মাধ্যমে কারাগারে চলে যাচ্ছে।”
মামলার বিষয়ে তিনি বলেন, “দুদক ইতোমধ্যে তাদের প্রসিকিউটরদের চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিয়েছে যে, প্রতিটি মামলায় জাহালমের বিরুদ্ধে তারা প্রসিকিউশন তুলে নিচ্ছে। যার ফলে, জাহালমকে এইসব মামলার দায় থেকে অব্যাহতি দিয়েছে দুদক।”
জাহালমের ক্ষতিপূরণের বিষয়ে তিনি বলেন, “এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য আগামী ৬ মার্চ দুই পক্ষের যুক্তি-তর্ক শুনবেন আদালত। ওই দিনের মধ্যেই দুদকের মামলার ভুল তদন্তে কোনো সিন্ডিকেট জড়িত কিনা, সিন্ডিকেট থাকলে কারা এর সঙ্গে জড়িত, তা চিহ্নিত করে আদালতকে জানাতে বলা হয়েছে। এরপরই জাহালমের ক্ষতিপূরণসহ দোষীদের শাস্তির বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবেন আদালত।”
জাহালমের পক্ষে আদালতে ক্ষতিপূরণের আবেদন করবেন কী না? এমন প্রশ্নের জবাবে অমিত দাস গুপ্ত বলেন, “আমি তো বিষয়টি আদালতের নজরে এনেছি এবং পরে আদালত স্বপ্রণোদিত রুল জারি করেছেন। আমার জায়গায় দাঁড়িয়ে আবেদন করার বিষয়টিতে একটু সীমাবদ্ধতা আছে। আমি কেবল আসামির পক্ষে শুনানিতে অংশ নিতে পারব। আদালত আমাকে সেই অনুমতি দিয়েছেন।”
তিনি আরও বলেন, “এখন আগামী ৬ মার্চের শুনানিতে আদালত কী সিদ্ধান্ত দেন তা জানার পর আমরা পরবর্তী পদক্ষেপ নিব। ক্ষতিপূরণের পরিমাণটি কীভাবে নির্ধারিত হবে, এই মামলা নিষ্পত্তির প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই বিষয়গুলো পরিষ্কার হয়ে যাবে। আশা করি এতে আলাদা কোনো রিটের প্রয়োজন হবে না।”
Comments