আগুন, ডাক্তার ও দমকল কর্মী

সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কেনো আগুন লেগেছে বা কীভাবে আগুন লেগেছে? একজন চিকিৎসক হিসেবে আমি তা জানতে চাই না। কিন্তু, দেশের একজন নাগরিক হিসেবে আমার অবশ্যই জিজ্ঞাসা থাকবে কেনো এই আগুন লাগলো বা এই আগুন লাগার পিছনে ‘থলের বিড়াল’ বেরিয়ে যাওয়ার মতো কোনো ঘটনা আছে কী না? আপনিও একজন সুনাগরিক হিসেবে জানতে চাইতে পারেন, এই আগুন লাগার ফলে কোনো রোগীর প্রাণহানি ঘটেনি ঠিকই কিন্তু রাষ্ট্রীয় মালামালের যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তার দায়ভার কে নিবে? তবে, এই আগুন লাগার কারণ, ক্ষয়ক্ষতির দায়ভার কার, তা খোঁজার জন্য তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে।
Fire at Suhrawardy
সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে আগুন লাগার পর রোগীদের সরিয়ে নেওয়ার দৃশ্য। ছবি: স্টার ফাইল ফটো

সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কেনো আগুন লেগেছে বা কীভাবে আগুন লেগেছে? একজন চিকিৎসক হিসেবে আমি তা জানতে চাই না। কিন্তু, দেশের একজন নাগরিক হিসেবে আমার অবশ্যই জিজ্ঞাসা থাকবে কেনো এই আগুন লাগলো বা এই আগুন লাগার পিছনে ‘থলের বিড়াল’ বেরিয়ে যাওয়ার মতো কোনো ঘটনা আছে কী না? আপনিও একজন সুনাগরিক হিসেবে জানতে চাইতে পারেন, এই আগুন লাগার ফলে কোনো রোগীর প্রাণহানি ঘটেনি ঠিকই কিন্তু রাষ্ট্রীয় মালামালের যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তার দায়ভার কে নিবে? তবে, এই আগুন লাগার কারণ, ক্ষয়ক্ষতির দায়ভার কার, তা খোঁজার জন্য তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে।

আমি একজন নাগরিক হিসেবে সবচেয়ে ব্যথিত হবো যদি তদন্তে বের হয়ে আসে এই আগুন লাগার পিছনে কোনো দুর্নীতি জড়িত রয়েছে। আর একজন চিকিৎসক হিসেবে লজ্জিত হবো যদি এই আগুন লাগার পিছনে কোনো ডাক্তার জড়িত থাকেন। আমার আশা তদন্ত রিপোর্ট আসার পর আমি লজ্জিত এবং ব্যথিত কোনটিই হবো না। তবে এটি নিশ্চিত আমি হতাশ হবো। কারণ, আগুন লাগার পিছনে যে ঘটনাই থাকুক না কেনো, সব আগুন লাগার মতো গৎবাঁধা এটির রিপোর্টে হয়ত দেখা যাবে, কোনো বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিটের জন্য আগুন লেগেছে। এর জন্য প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি দায়ী নয়।

সমালোচনা আর প্রশংসা মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। সবসময় একপিঠে থাকতে থাকতে আসলে আমরা মুদ্রার অপর পিঠের কথা ভুলে যাই। মুদ্রার ভালো পিঠের কিছু মানবিক চিকিৎসকদের কথা বলতে চাই।

সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজে গত কিছুদিন আগে স্টোর রুম থেকে আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। আগুন লাগার পর প্রায় এক হাজার রোগী অবরুদ্ধ ছিলেন এবং সেখানে অনেক চিকিৎসক কর্মরত ছিলেন। ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্টের যে গাইডলাইন তা হলো কোনো ডিজাস্টার ঘটলে সবার প্রথম যে কথা তা হলো সেফটি ফার্স্ট। অর্থাৎ, আপনি কোনো ডিজাস্টারে পড়লে প্রথম কাজ হলো আপনার নিজেকে নিরাপদে রাখা। কোনো বদ্ধ জায়গায় যদি আগুন লাগে আর আপনার কাছে যদি আগুন নেভানোর কোনো উপাদান না থাকে তাহলে আপনার প্রথম দায়িত্ব হলো আগুন থেকে নিজেকে বাঁচানো। এটিই সবাই করবে এবং এটি করাই সবার উচিত। কিন্তু, মানুষ যদি মানবিক হয় তাহলে সে ভাবে না কোনটা তার করা উচিত, সে ভাবে কোনটা করলে আরেকজন মানুষের উপকার হবে বা কোনটা করলে একজন মানুষ হয়ে আমি আরেকজন মানুষের ভালো করতে পারি। সেই ব্রত নিয়েই যেনো সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের চিকিৎসকরা ঐদিন দায়িত্ব পালন করতে গিয়েছিলেন।

রোগীর অপারেশন করা অবস্থায় বিদ্যুৎ চলে যায়, সেই চিকিৎসক তখন জানেন হাসপাতালে আগুন লেগেছে, তারপরেও তিনি নিজের জীবনের কথা চিন্তা না করে রোগীর অপারেশন চালিয়ে গিয়েছেন। বিদ্যুৎ ছিলো না, তখন মোবাইলের টর্চ দিয়ে কয়েকজন চিকিৎসক সে অপারেশন সম্পূর্ণ  করেছেন। অপারেশন সম্পূর্ণ  হওয়ার পর সেই রোগীকে আগুন থেকে নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নিয়ে অপারেশন পরবর্তী চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছেন।

যে কোন জায়গায় আগুন লাগার পর সেখানকার বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। হাসপাতালে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেলে সেন্ট্রাল অক্সিজেন সরবরাহও বন্ধ হয়ে যায়। সব আইসিইউতেই সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইন থাকে। আইসিইউতে এমন সব রোগী ভর্তি থাকেন যাদের দুই বা ততোধিক অর্গান ফেইলিউর থাকে, মানে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো বিকল হয়ে যায়। তার মধ্যে প্রায় সব রোগীদের শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়ার স্বাভাবিক ক্ষমতাটা বিকল হয়ে যায়, কৃত্রিমভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস বা অক্সিজেন দিতে হয়। কিন্তু, যে রোগীদের জীবন রক্ষার জন্য অক্সিজেন ম্যান্ডেটরি তারা অক্সিজেন না পেলে কয়েক মিনিটের মধ্যে ইরিভারসিবল ব্রেন ডেথ হয়ে যায়। সোহরাওয়ার্দী মেডিকেলেও সেই অবস্থা হতে পারতো। মৃত্যুর মিছিল আর স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হতে পারতো সোহরাওয়ার্দীর আকাশ। কিন্তু, তা হয়নি, চিকিৎসকরা হতে দেয়নি। একজন চিকিৎসক আইসিইউ এর স্টোর রুমের দরজা ভেঙে অক্সিজেন সিলিন্ডার বের করে রোগীদের অক্সিজেন সরবরাহ করে জীবন বাঁচিয়েছেন। এরকম  জানা-অজানা শত শত ঘটনা সেদিন সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজে ঘটেছে। একজন রোগীরও প্রাণহানি ঘটেনি। কত মায়া, দায়িত্ববোধ আর মনুষ্যত্ববোধের পরিচয় দিয়েছেন সেদিন সোহরাওয়ার্দীতে থাকা চিকিৎসকরা। সেই অবস্থায়ও দেখলাম ফেসবুকে অনেকে চিকিৎসকদের মৃত্যু কামনা করেছেন।

আমরা বাঙালি জাতিটা আসলেই একটি অবিমিশ্র জাতি। আমাদের উৎপত্তিটাই অবিমিশ্র প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে যেখানে একদল মানুষ জীবন বাজি রেখে, রক্ত দিয়ে দেশ স্বাধীন করেছেন, সেই একই দেশের আরেক দল মানুষ নিজের দেশের মানুষদের হত্যা করে সেই স্বাধীনতাকামীদের বিরোধিতা করেছে। তেমনিভাবে দেখেন- সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজে আগুন লেগেছে, কিছু মানুষ সেই আগুনে যাতে ডাক্তাররা পুড়ে ছাই হয়ে যান সেই দোয়া করেছেন, অথচ যাদের পুড়ে ছাই হওয়ার জন্য আপনারা দোয়া করেছেন, তারাই নিজেদের জীবন বাজি রেখে রোগীদের জীবন রক্ষা করেছেন। অবিমিশ্র এই জাতি মানবিকতার মানদণ্ডে মানুষের বিবেচনা করে না, প্রতিহিংসার জেরে একজন আরেকজনের মৃত্যু কামনা করে।

একজন চিকিৎসকের দায়িত্ব রোগী দেখা এবং রোগীর ব্যবস্থাপত্র লেখা। সেই ব্যবস্থাপত্র এক্সিকিউট করা এবং অন্যান্য সেবার সম্পূর্ণ দায়িত্ব নার্সদের। যদিও আমাদের দেশে এই নিয়ম অনুসরণ করা হয় না, চিকিৎসকরাই রোগীর ব্যবস্থাপত্রও দেখে সেবাও করেন। কিন্তু, বাইরের দেশে এটি এভাবে  চলে না। আগুন লেগেছে আগুনে পুড়ে রোগীর দেহ ভস্ম হয়ে যাচ্ছে, তা থেকে রোগীদের রক্ষা করার দায়িত্ব একজন চিকিৎসকের নয়। সেই দায়িত্ব ফায়ার বিগ্রেডের। বাইরের দেশে এই ঘটনা ঘটলে ফায়ার ব্রিগেড না আসা পর্যন্ত যদি রোগীরা পুড়ে ভস্মীভূতও হয়ে যেতো তাহলেও কেউ এগিয়ে আসতো না। আমি ভেবেছিলাম আমাদের দেশেও মনে হয় এই পরস্থিতি শুরু হয়ে গিয়েছে। একসময় আমাদের দেশে মানুষ ছিলো এমন যে, কেউ বিপদে পড়লে পাশের মানুষ সাহায্য করতে এগিয়ে আসতো। আর এখন আপনি বিপদে পড়লে আপনার পাশের জন এগিয়ে না এসে সেই বিপদজনক ঘটনার ভিডিও করবে। ভিডিও করতে এগিয়ে আসবে কিন্তু সাহায্য করতে নয়। এটিই আগের আর বর্তমান মানুষের মধ্যে পার্থক্য।

ইট-কাঠ আর দেয়ালের মায়াহীন এই ঢাকা শহরে যেখানে মানুষ পাশের ফ্ল্যাটের খবর রাখেন না, সেখানে চিকিৎসকরা নিজেদের জীবনের কথা চিন্তা না করে অচেনা-অজানা রোগীদের জীবন বাঁচাতে যারা ঝাঁপিয়ে পড়েছেন, তা তাদের অতিমানবীয় গুণ- এছাড়া অন্য কোনো শব্দ দিয়ে এর ব্যাখ্যা করতে পারছি না।

সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে আগুন লাগার পর তা মৃত্যুহীন, হতাহতহীন থাকার পেছনে যাদের অবদান কখনোই ঘটা করে বলা হয় না, তারা হলেন ফায়ার ফাইটার্স। ফায়ার সার্ভিসের ১৮টি ইউনিট, সাথে উৎসুক জনগণ টানা চার ঘণ্টা কাজ করে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন এবং রোগীদের অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার কাজে অসামান্য ভূমিকা পালন করেন।

প্রতিনিয়ত জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ফায়ার বিগ্রেডের সদস্যদের কাজ করে যাওয়া আর সাহসিকতা নিয়ে মানুষের জীবন রক্ষা করার যুদ্ধটা সত্যিই অবাক করার মতো। যারা নিয়ম রক্ষার চেয়ে বেশি কিছু করেন আমরা তাদেরকে ধন্যবাদ জানাই না, বা জানাতে কার্পণ্য করি। অথচ কতো শত মৃত্যুর জ্বলন্ত সাক্ষী ওরা, কতো জীবনের নতুন স্পন্দন ফিরিয়ে দেওয়ার কারিগর এই বীরেরা। যে বিধ্বংসী আগুন মানুষের জীবন কেড়ে নিয়ে যায় সেই আগুনের সাথে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেন তারা।

কোনো মানুষ তার ওপর অর্পিত দায়িত্বটুকু পালন করলে তার প্রশংসা করার কিছু নেই। কিন্তু, তিনি যদি তার সচরাচর দায়িত্বের বাইরে গিয়ে মানুষের সেবায় এগিয়ে আসেন তাহলে তার প্রশংসা করা আপনার-আমার দায়িত্ব। তা না করলে সেটি তাকে নিরুৎসাহিত করার শামিল হবে।

আমি কখনোই ডাক্তারদের সচরাচর ও স্বাভাবিক কাজের প্রশংসা করি না, কিন্তু সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের চিকিৎসকরা যে নজির স্থাপন করেছেন তার প্রশংসা না করলে আমি আমার ব্যক্তিগত দায়িত্ববোধের অবহেলা করছি বলে বিবেক আমাকে বার বার তাড়া করবে।

মানুষ হয়ে মানুষের সেবা করার নামই মানবিকতা। একজন চিকিৎসক হয়ে মানবিক হওয়াটা যে কতো জরুরি তা দেখিয়েছেন সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের চিকিৎসকবৃন্দ। দায়িত্বের বাইরে গিয়ে যখন মানুষ জনগণের সেবায় নিয়োজিত হন তখনই তাদের মানবিক মানুষ বলা হয়। স্বার্থপরতা আর ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার পরতে পরতে গড়ে উঠা আমাদের বিবর্তিত সমাজে মানবিক মানুষের খুব প্রয়োজন।

লেখক: ডাঃ কাওসার আলম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্ডিওলজি বিভাগের মেডিকেল অফিসার ও রেসিডেন্ট

Comments

The Daily Star  | English

One month of interim govt: Yunus navigating thru high hopes

A month ago, as Bangladesh teetered on the brink of chaos after the downfall of Sheikh Hasina, Nobel Laureate Muhammad Yunus returned home to steer the nation through political turbulences.

10h ago