স্ত্রীকে ফোনে বলেছিলাম, ‘ছেলেটাকে দেখে রেখো’

বনানীর আগুনের শিকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা মারজেল হোসেন ভর্তি হয়েছিলেন কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে। গতকাল আগুনের হাত থেকে তাকে উদ্ধার করেন দমকল বাহিনীর সদস্যরা। আজ (২৯ মার্চ) হাসপাতালের বিছানায় বসে মারজেল কথা বলেন দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে। শোনান তার জীবনের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা।
Marzel Hossain
২৯ মার্চ ২০১৯, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের বিছানায় বসে মারজেল হোসেন। ছবি: পলাশ খান

বনানীর আগুনের শিকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা মারজেল হোসেন ভর্তি হয়েছিলেন কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে। গতকাল আগুনের হাত থেকে তাকে উদ্ধার করেন দমকল বাহিনীর সদস্যরা। আজ (২৯ মার্চ) হাসপাতালের বিছানায় বসে মারজেল কথা বলেন দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে। শোনান তার জীবনের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা।

মারজেল বলেন, “আমি ইম্পেরিয়াল গ্রুপে চাকরি করি অডিট ম্যানেজার হিসেবে। আমার অফিস ছিলো আটতলায়। আগুন লাগার পর আমাদের অফিসের পিয়ন ফ্রন্ট ডেস্ক থেকে ভেতরে এসে জানায়- বিল্ডিংয়ে আগুন লেগেছে। আমাদের বের হতে হবে। দ্রুত বের হওয়ার জন্যে সহকর্মীরা সবাই মিলে মূল দরজার কাছে আসি।”

“সিঁড়ি দিয়ে ওপরের দিকে যাওয়ার জন্যে দরজার স্লাইড খুলে দেখি অনেক ধোঁয়া। সেই ধোঁয়া সহনীয় ছিলো না। আমরা বিভিন্নভাবে- মুখে তোয়ালে বেঁধে, শরীর থেকে শার্ট খুলে মুখে বেঁধে চেষ্টা করি কোনোভাবে উপরে যাওয়া যায় কী না। কিন্তু, ধোঁয়ার কারণে সম্ভব হয়নি। একবার চেষ্টা করি আবার পিছিয়ে আসি। এভাবে কয়েকবার চেষ্টা করার পর আমরা বের হওয়ার জন্যে বিকল্প পথ খুঁজতে থাকি।”

“সাততলায় আগুন জ্বলছিলো। আর আমরা ছিলাম আটতলায়। তাই নিচে যাওয়ার সুযোগ ছিলো না। বাঁচতে হলে আমাদেরকে উপরেই উঠতে হবে। সেসময় আমরা বিভিন্ন রুমে ঢুকে ঢুকে জানলা খুলে দেখছিলাম বের হওয়া যায় কী না। একসময় স্টোর রুমে ঢুকে দেখি এসির আউটডোর সিরিয়াল দিয়ে সাজানো। ভাবলাম সেটা ধরে ধরে ওপরে উঠবো।”

“আমার সঙ্গে আরও কয়েকজন ছিলেন। তাদের মধ্যে হাল্কা-পাতলা একজন পাঠালাম দেখতে- সেদিক দিয়ে ওপরে ওঠা যায় কী। সে কিছু দূর উঠে জানালো যে- যাওয়া যাবে। তারপর আমরা এক এক করে সবাই সেদিক দিয়ে বের হতে শুরু করলাম। সেটি অনেক উঁচুতে ছিলো বলে নিচের দিকে তাকালে ভয় করতো। সেসময় পাশের খোলা জায়গা থেকে দেখছিলাম অনেককে ছিঁটকে পড়ে যাচ্ছেন। তা দেখে খুব ভয় লাগছিলো।”

মারজেল আরও জানান যে তারা একসঙ্গে সাতজনের মতো ছিলেন। বলেন, “আমরা ওভাবে আটতলা থেকে ১৪-তলা পর্যন্ত উঠে গিয়েছিলাম। ওখানে যাওয়ার পর প্রথমে একটু নিরাপদ মনে হয়েছিলো। কিন্তু, আধঘণ্টা পরে দেখি প্রচণ্ড আকারে ধোঁয়ায় সব আচ্ছন্ন হয়ে গেছে। তখন আমরা সবাই নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলাম যে আর বেশি সময় বাঁচবো না। যে যার মা-বাবা-ভাই-বোন-স্ত্রী-সন্তানদের ফোন করতে শুরু করলেন। সবাই শেষ বিদায় নিতে শুরু করেন।”

“এর ১০-১৫ মিনিট পরে আমাদেরকে ক্রেন দিয়ে উদ্ধার করা হয়। আমার এক আত্মীয় অনেক কষ্ট করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানিয়েছিলেন আমাদের আটকে থাকার বিষয়ে।”

প্রাণে বেঁচে যাওয়া মারজেল বলেন, “শেষ মুহূর্তে আমার ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলেছি। স্ত্রীর সঙ্গেও কথা বলেছি। স্ত্রীকে বলেছিলাম, ‘সাবধানে থেকো।’ আমার একটা ছেলে আছে- সাড়ে তিন বছর বয়স। স্ত্রীকে বলেছিলাম, ‘ছেলেটাকে দেখে রেখো। আমার কিছুই করার নাই।’ কারণ আমার মনে হচ্ছিলো না যে আমি এখান থেকে আর ফিরতে পারবো।”

“মনে হচ্ছিলো আমি আর বেশি সময় বেঁচে থাকতে পারবো না। আমি সেসময় ধোঁয়ার কারণে আর টিকতে পারছিলাম না।”

অবশেষে মারজেলসহ আরও কয়েকজনকে উদ্ধার করে দমকল বাহিনীর সদস্যরা হাসপাতালে পাঠিয়ে দেন। অবশেষে তাদের মুক্তি মেলে দুঃসহ সেই মুহূর্তগুলো থেকে।

Comments