লোকসভা ভোট বিশ্লেষণ

এনআরসি, অনুপ্রবেশ, দুর্নীতি ও সংখ্যালঘু তোষণই পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির ভোট প্রচারের প্রধান হাতিয়ার এবার

ভারতের নির্বাচনের ইতিহাসে এবার প্রথম জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি), নাগরিকত্ব (সংশোধনী) বিল, অনুপ্রবেশ এবং সংখ্যালঘু তোষণনীতির মতো ইস্যুগুলো নির্বাচনী প্রচারণার হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। এই সমস্ত ইস্যুতেই সরগরম হয়ে উঠেছে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য রাজনীতি। ভোটে বাংলা বাজার গরম করতে এখন এই বিষয়গুলিকেই এ রাজ্যে প্রধান হাতিয়ার করেছে কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন দল বিজেপি।
India polls
১১ এপ্রিল ২০১৯, লোকসভা নির্বাচনের প্রথম দফায় ভারতের পশ্চিবঙ্গ রাজ্যের আলিপুরদুয়ার আসনের একটি ভোটকেন্দ্রের সামনে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়েছেন ভোটাররা। ছবি: রয়টার্স

ভারতের নির্বাচনের ইতিহাসে এবার প্রথম জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি), নাগরিকত্ব (সংশোধনী) বিল, অনুপ্রবেশ এবং সংখ্যালঘু তোষণনীতির মতো ইস্যুগুলো নির্বাচনী প্রচারণার হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। এই সমস্ত ইস্যুতেই সরগরম হয়ে উঠেছে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য রাজনীতি। ভোটে বাংলা বাজার গরম করতে এখন এই বিষয়গুলিকেই এ রাজ্যে প্রধান হাতিয়ার করেছে কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন দল বিজেপি।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি থেকে শুরু করে দলের সভাপতি অমিত শাহ-সহ ছোট-বড় সব নেতাই এই ইস্যু নিয়ে বাংলার বাজার কাঁপাচ্ছেন। এরই সঙ্গে রয়েছে কর্মসংস্থান, দুর্নীতি, পাকিস্তানের বালাকোটে ভারতীয় বিমানবাহিনীর অভিযান এবং কেন্দ্রে আগামী সরকার গঠনে তৃণমূলের ভূমিকার মতো ইস্যুগুলিও। তবে বিজেপির এই প্রশ্নের মুখে পড়ে পাল্টা জবাব দিচ্ছে তৃণমূল কংগ্রেসও।

গত ১২ এপ্রিল গোটা ভারতের সাথে পশ্চিমবঙ্গেও লোকসভা নির্বাচনের প্রথম দফার ভোট হয়েছে। রাজ্যের ৪২টি আসনের মধ্যে প্রথম দফায় মাত্র ২টি আসনে ভোট হয়েছে। বাকি এখনও ৪০টি কেন্দ্র। কিন্তু দিন যতো এগোচ্ছে ততোই নিজেদের মধ্যে বাকযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ছে বিজেপি এবং তৃণমূল।

১২ এপ্রিল পশ্চিমবঙ্গের রায়গঞ্জ থেকে অমিত শাহ জোরের সাথে বলেন ‘ক্ষমতায় এলে অসমের মতো এ রাজ্যেও নাগরিকপঞ্জি হবেই। অনুপ্রবেশকারীদের এক একজনকে চিহ্নিত করে তাদের সাগরে ফেলে দেওয়া হবে। মমতাজি সব শক্তি দিয়ে বাধা দিলেও এনআরসি ঠেকাতে পারবেন না।

শাহ আরও জানিয়েছিলেন, ‘আমাদের প্রতিশ্রুতি হলো প্রতিটি অনুপ্রবেশকারীদের খুঁজে বের করতে সারাদেশেই এনআরসি চালু করা। তিনি বলেন, “অনুপ্রবেশকারীদের আমাদের ভোটব্যাঙ্ক হিসাবে ধরি না। জাতীয় নিরাপত্তাই আমাদের অগ্রাধিকার।”

তারও স্পষ্ট বার্তা- অনুপ্রবেশকারীদের দেশ থেকে বিতাড়িত করা হবে এবং বাংলাদেশ, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের সংখ্যালঘু হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানদের ভারতীয় নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। প্রত্যুত্তরে মমতাও সাফ জানিয়ে দিয়েছেন কোন মতেই এ রাজ্যে এনআরসি চালু করতে দেওয়া হবে না। তার পাল্টা চ্যালেঞ্জ- বাংলার গায়ে হাত দিয়ে দেখুক, মজা বুঝতে পারবে। মমতার দাবি- এনআরসির নামে বাঙালি ও মুসলিম খেদাও চলছে। আর নাগরিকত্ব বিলের ফলে প্রকৃত ভারতীয়রাই বিদেশি নাগরিকে পরিণত হবে।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের সাথে ভারতের সীমান্ত বিস্তৃত রয়েছে ৪,০৯৬ কিলোমিটার। এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের সাথে দীর্ঘ ২,২১৬ দশমিক ৭ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে বাংলাদেশের। দেশভাগের সময় থেকেই অনুপ্রবেশ ও উদ্বাস্তু সমস্যায় জর্জরিত পশ্চিমবঙ্গ। স্বাভাবিকভাবেই এনআরসি, নাগরিকত্ব বিল এবং অনুপ্রবেশ- এই তিন ইস্যু রাজ্যটির আম-জনতাকে বিশেষভাবে নাড়া দিয়েছে।

যদিও তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চ্যাটার্জি বলেন, “এনআরসি এবং নাগরিকত্ব বিল সাধারণ মানুষের কতোখানি ক্ষতি করবে এবং বিজেপি কীভাবে তাদের ভুল পথে পরিচালিত করেছে, আমরা মানুষের কাছে গিয়ে সেই বার্তা দিচ্ছি। এতে আমরা ভালো সাড়া পাচ্ছি। আসলে কেউই আর উদ্বাস্তু হতে চায় না। অনুপ্রবেশ ইস্যু ভারতের অর্থনীতি বা জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে কতোটা হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে নির্বাচনী প্রচারণায় তাও তুলে ধরছে বিজেপি শিবিরের নেতারা। তাদের অভিযোগ সংখ্যালঘু তোষণনীতির কারণেই তৃণমূল অনুপ্রবেশে মদদ দিচ্ছে।

২০১৮ সালে কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের তরফে প্রকাশিত একটি তথ্যেই দেখা গেছে যে ২০১৭ সালে পশ্চিমবঙ্গে ৫৮টি সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। যার মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া উত্তরচব্বিশ পরগনা জেলার বসিরহাট এবং অন্যটি বর্ধমান জেলার আসানসোল।  পশ্চিমবঙ্গের মোট জনসংখ্যার ৩০ শতাংশ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত। আর এই সংখ্যালঘু ভোটই রাজ্যের যে কোনো নির্বাচনে বড় ফারাক গড়ে দেয়। রাজ্যটির ১২ থেকে ১৪টি লোকসভা কেন্দ্রে সংখ্যালঘুরাই নির্ণায়ক শক্তি। যার মধ্যে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের রায়গঞ্জ, কোচবিহার, বালুরঘাট, মালদা, উত্তর মালদা, দক্ষিণ বহরমপুর, মুর্শিদাবাদ, জলপাইগুড়ি, জয়নগর, বসিরহাট ও বনগাঁ।

ফলে প্রতিটি রাজনৈতিক দলেরই লক্ষ্য থাকে ওই ভোট নিজেদের কাছে টানা। একটা সময় এই ভোটকে কাজে লাগিয়ে বাজিমাত করেছিলো বামেরা। আর ২০১১ সালে রাজ্যে পালা বদলের নির্বাচনের সময় থেকে সংখ্যালঘুদের একটি বড় অংশ মমতা ব্যানার্জির তৃণমূলের পাশে থেকেছে। এ ব্যাপারে তৃণমূলের মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম জানান, বিজেপি এ রাজ্যে মুসলিমদের টার্গেট করছে। কিন্তু, আমরা তা কিছুতেই হতে দেবো না।

অন্যদিকে, বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ বলেছেন, “রাজ্যে বিজেপি ক্ষমতায় আসলে অবৈধ মাদ্রাসাগুলির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং কোনোরকম তোষণ নীতিকে বরদাস্ত করা হবে না। ফলে এবারের ভোটবাজারে এনআরসি, অনুপ্রবেশ, সারদা-নারদার ও রোজভ্যালির মতো বেসরকারি আর্থিক সংস্থাগুলির দুর্নীতি এবং সংখ্যালঘু তোষণই হয়ে উঠেছে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য রাজনীতিতে রাজ্যের শাসক বিরোধীদের ভোট প্রচারের হাতিয়ার।

Comments

The Daily Star  | English

One month of interim govt: Yunus navigating thru high hopes

A month ago, as Bangladesh teetered on the brink of chaos after the downfall of Sheikh Hasina, Nobel Laureate Muhammad Yunus returned home to steer the nation through political turbulences.

10h ago