হালদার সংযোগ খালে কয়েক হাজার লিটার ফার্নেস ওয়েল, ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে জীববৈচিত্র্য
চট্টগ্রামের হাটহাজারী একশ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য আনা ফার্নেস অয়েলবাহী সাতটি রেলওয়ে ওয়াগনের তিনটি গতকাল (২৯ এপ্রিল) বিকালে উপজেলার এগার মাইলস্থ আবুল কালাম মাদরাসার ব্রিজ ভেঙে হালদা নদীর শাখা খাল ‘মরা ছড়ার’ নিচে পড়ে যায়। এতে প্রায় কয়েক হাজার লিটার ফার্নেস অয়েল খালে ছড়িয়ে পড়ে।
তিনটি ওয়াগনে এক লাখ পাঁচ হাজার লিটার ফার্নেস অয়েল ছিল বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
এদিকে বিষাক্ত তেলের স্রোত যাতে হালদা নদীর দিকে যেতে না পারে, সেজন্য তাৎক্ষণিক খালটির ভাটা এলাকায় বালির বস্তার ১০টি বাঁধ দেওয়া হয়েছে।
তাই অল্পের জন্য প্রাকৃতিক উপায়ে মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদীর মাছ, পরিবেশ ও প্রকৃতি ভয়াবহ হুমকি থেকে রক্ষা পেলেও এখনো শঙ্কামুক্ত নয়।
স্থানীয় বিভিন্ন সূত্র জানায়, হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রুহুল আমিনের দ্রুত সিদ্ধান্তে এই বাঁধ দেওয়ার পর রাত সাড়ে ১২টা পর্যন্ত ৬ হাজার লিটার ফার্নেস ওয়েল তেল নদী থেকে তোলা সম্ভব হয়েছে। বাকি তেল উত্তোলনের প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে।
তেল নিষ্কাশনে স্থানীয়দের মাঝে আগ্রহ সৃষ্টির লক্ষ্যে সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, যারা এসব তেল তুলে আনবে তাদের কাছ থেকে ২০ টাকা দরে প্রতি লিটার কিনে নেওয়া হবে। এ ঘোষণার পর স্থানীয়রা খাল থেকে ফার্নেস ওয়েল তুলে এনে উপজেলা প্রশাসনের কাছে বিক্রি করতে দেখা গেছে।
ইউএনও মো. রুহুল আমিন বলেন, “খবর পাওয়া মাত্র আমরা দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করি। তাৎক্ষণিক উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা, পৌর প্রকৌশলী, পৌরসভার পরিচ্ছন্ন কর্মী ও স্থানীয়দের সহযোগিতায় চার ঘণ্টা লাগাতার কাজ করে ঘটনাস্থল থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার পর্যন্ত ‘ছড়ায়’ (খাল) দশটি বাঁধ নির্মাণ করেছি। যদিও দুর্বল বাঁধ, তবে কাজে লেগেছে। হালদা নদীতে যাতে এক ফোঁটা ফার্নেস অয়েলও না যেতে পারে সে চেষ্টায় আছি। ছড়া থেকে ফার্নেস অয়েল সংগ্রহ করা হচ্ছে।”
তিনি আরও বলেন, “যেখানে আমরা তেল আটকিয়েছি সেখান থেকে হালদার দূরত্ব ১০ কিলোমিটার। এখনো তেল উত্তোলন চলছে। রাত সাড়ে ১২টা পর্যন্ত এলাকাবাসীকে নিয়ে ৬ হাজার লিটার তেল তুলেছি। যদি বৃষ্টি না হয় তাহলে ইনশাআল্লাহ সব ঠিক হয়ে যাবে।”
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও হালদা নদী গবেষক ড. মঞ্জুরুল কিবরীয়া বলেন, “ঘটনাস্থল থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার পর্যন্ত এ তেল ছড়িয়েছে। বাঁধ দেওয়া না গেলে হয়তো তেল হালদা নদীতে ছড়িয়ে পড়ে মাছ ও জীববৈচিত্র্যের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যেতো। একটি বড় ধরনের বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেল হালদা নদীর মাছ, পরিবেশ ও প্রকৃতি। তবে এখনো আমরা আশঙ্কামুক্ত হতে পারছি না।”
তিনি বলেন, “বৃষ্টি হলে কোনো প্রতিরোধ ব্যবস্থা কাজে আসবে না। ফার্নেস অয়েলের অর্ধেকও যদি হালদায় যায়, নদীতে কোনো জীববৈচিত্র্য থাকবে না। চিরতরে হালদার প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্র হারানোর সম্ভাবনা রয়েছে।”
মঙ্গলবার সকালে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ফার্নেস ওয়েল অপসারণে হাটহাজারী উপজেলা প্রশাসনের সঙ্গে পরিবেশ অধিদপ্তর, হাটহাজারী পৌরসভা ও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ তাদের প্রযুক্তি ও সক্ষমতা নিয়ে নদীর তেল দূষণমুক্ত করার কাজে যোগ দিয়েছেন। বাংলাদেশ রেলওয়ে সর্বশক্তি নিয়ে উদ্ধার অভিযান শুরু করেছে।
বিশেষজ্ঞরা জানান, রেলওয়ে ওয়াগনের দুর্ঘটনায় নদীতে ফার্নেস অয়েল ছড়িয়ে পড়া এটি নতুন কোনো ঘটনা নয়। এর আগে বোয়লখালির ঘটনা থেকে বাংলাদেশ রেলওয়ে শিক্ষা গ্রহণ করেনি। অত্যন্ত পুরাতন, দুর্বল এবং সংস্কারবিহীন রেলসেতু দিয়ে প্রায় প্রতিটি (২৫X৭) ১৭৫ মেট্রিক টন ওজনের ফার্নেস অয়েলবাহী ওয়াগন কীভাবে চলাচলের অনুমতি পায়। তদন্তের মাধ্যমে বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসনকে অনুরোধ জানিয়েছেন তারা।
Comments