বাজারে সবই পাওয়া যায়, সবই কি খাওয়া যায়?

বাংলাদেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। বাংলাদেশের অভিধান থেকে মঙ্গা বা দুর্ভিক্ষ শব্দটি বিলুপ্তপ্রায়। না খেয়ে মানুষ মারা যাওয়ার ঘটনা বাংলাদেশে আর ঘটে না। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও নিরাপদ খাদ্যে কতোটা স্বয়ংসম্পূর্ণ সে প্রশ্ন আজ সমাজের সর্বস্তরের জিজ্ঞাসা।
Food quality
ছবি: স্টার

বাংলাদেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। বাংলাদেশের অভিধান থেকে মঙ্গা বা দুর্ভিক্ষ শব্দটি বিলুপ্তপ্রায়। না খেয়ে মানুষ মারা যাওয়ার ঘটনা বাংলাদেশে আর ঘটে না। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও নিরাপদ খাদ্যে কতোটা স্বয়ংসম্পূর্ণ সে প্রশ্ন আজ সমাজের সর্বস্তরের জিজ্ঞাসা।

বাজারে দরকারি সবই পাওয়া যায়, সবই কি খাওয়া যায়? ভেজাল খাদ্য বা নিম্নমানের খাদ্যে বাজার সয়লাব। ভেজালের ভিড়ে নিরাপদ খাদ্য খুঁজে বের করা যেনো সাগর সেঁচে মুক্তো খোঁজার মতোই! অবস্থা দেখে মনে পড়ে গেল স্যামুয়েল টেইলর কোল্ডরিজের বিখ্যাত কবিতা ‘দ্য এনশিয়েন্ট ম্যারিনার’ এর সেই বৃদ্ধ নাবিকের কথা, যেখানে তৃষ্ণার্ত নাবিক যখন পানির পিপাসায় কাতরাচ্ছে, তার জাহাজের চারপাশে পানি থাকার পরেও একফোঁটা পানি পান করার মতো উপযুক্ত ছিলো না। আমাদের চারপাশে হরেক রকমের খাদ্য, কিন্তু ভেজালের ভয়ে খাওয়ার অবস্থা নেই, আস্থা নেই।

সম্প্রতি, খাদ্যপণ্যের মান নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান বিএসটিআই বাজার থেকে নমুনা সমগ্র করে দেখেছে নামিদামি ব্র্যান্ডের ৫২টি খাদ্যপণ্য নিম্নমানের। আমরা না জেনে বিজ্ঞাপনে প্রলুব্ধ হয়ে দিনের পর দিন এসব নিম্নমানের খাবার বাজার থেকে কিনেছি, খেয়েছি। এ ঘটনায় সবচেয়ে বড় ক্ষতি যেটা হয়েছে সেটা হলো বিশ্বাস। কাকে বিশ্বাস করবো, কেনো বিশ্বাস করবো? বিশ্বাস করে তো ঠকেছে ক্রেতারা। ভোক্তাদের বিশ্বাসের ঘাটতি রেখে ব্যবসা কতটুকু সফল হবে তা সময়ই বলে দেবে।

নিম্নমানের বাইরে খাদ্যে ভেজালের চিত্র কেমন? চালে পাথর, মোটা চাল মেশিনে কেটে পলিশ করে বলা হয় মিনিকেট, তেলে মিক্সচার, মাছের খাবারে ভেজাল, পোলট্রি মুরগিতে ক্রোমিয়াম, গরুর নামে মহিষ, খাসির নামে পাঠা না হলে ভেড়া, ফলমূলে ক্যামিকেল, শাকসবজিতে কীটনাশক, মুড়িতে ইউরিয়া, গুঁড়ো দুধে মেলামাইন, কনডেন্সড মিল্কের নামে ভেজিটেবল ফ্যাট, বিভিন্ন খাদ্য-দ্রব্যে ফুড গ্রেড রঙ এর পরিবর্তে ব্যবহার করা হয় ক্ষতিকর টেক্সটাইল গ্রেড রঙ, এডিবল অয়েল এর পরিবর্তে পেট্রোল দিয়ে ভাজা হচ্ছে চানাচুর, জিলাপির সিরায় ইঁদুর, মিষ্টির রসে তেলাপোকা আরও কতো কী।

অবস্থা দেখে মনে পড়লো সুকান্তের ভেজাল কবিতাটি। “ভেজাল, ভেজাল ভেজাল রে ভাই, ভেজাল সারা দেশটায়/ ভেজাল ছাড়া খাঁটি জিনিষ মিলবে নাকো চেষ্টায়!/ ভেজাল তেল আর ভেজাল চাল, ভেজাল ঘি আর ময়দা,/ ‘কৌন ছোড়ে গা ভেজাল ভেইয়া, ভেজালসে হ্যায় ফয়দা।’”

ভেজাল বন্ধে সরকারের আন্তরিকতার অভাব আছে কী না তা নিয়ে নানাজনের নানা মত থাকলেও আমি মনে করি সরকারের চেয়ে বড় কেউ নেই। সরকারের চেয়ে ক্ষমতাশালী কেউ না। শুধু ভেজালবিরোধী আইন করে আর মোবাইল কোর্ট মাঠে নামিয়ে সরকার তার দায় এড়াতে পারে না। এখন দরকার কয়েকটা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি যাতে ভেজালকারীরা সাহস না পায়।

সরকারের বাইরে দায় আমাদের ব্যবসায়ীদেরও আছে। তাদের লোভ, তাদের বিকৃত মানসিকতার নির্মম শিকার নিরীহ জনগণ। ব্যবসায়ীরা হয়ে উঠেছে বেপরোয়া আর চরম সুবিধাভোগী। সরকারের কাছ থেকে সব সুবিধা নিবে কিন্তু মুনাফা লাভের আশায় জনগণের সাথে করবে প্রতারণা। তাই ব্যবসায়ীদের উপর যদি সরকার কঠোর হতে না পারে তবে সবই হবে অরণ্যে রোদন।

কবি সুকান্ত কী আর সাধে বলেছেন:

‘খাঁটি জিনিষ’ এই কথাটা রেখো না আর চিত্তে,

‘ভেজাল’ নামটা খাঁটি কেবল আর সকলই মিথ্যে।

দুঃখের বিষয় এই ভেজালের বিষচক্র থেকে কিন্তু ব্যবসায়ীরা নিজেরাও মুক্ত না। কারণ যে মাংসে ভেজাল করছে সে ভেজাল তেল খাচ্ছে। তাই খাদ্য ভেজাল মেশাচ্ছে ব্যবসায়ীরা আবার সেই ভেজাল মেশানো খাবার আমজনতার সাথে ব্যবসায়ীরাও খাচ্ছে। বাঙালিই মারছে বাঙালিকে- সেটা মনে হয় নীরদ সি চৌধুরী বহু আগেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তাইতো তিনি বলতেন “আত্মঘাতী বাঙালি”। কারণ বাঙালি ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোনো জাতি এভাবে দিনের পর দিন খাবারের মাধ্যমে বিষ খাওয়া বা খাওয়ানোর কথা চিন্তাও করতে পারে না। তাই আমরা “আত্মঘাতী বাঙালি”।

ভেজালের ভয়াবহ চিত্র দেখে মনে পড়ছে ফরাসি সেনানায়ক নেপোলিয়ন বোনাপার্ট এর কথা। কথিত আছে ওয়াটার লু এর যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর নেপোলিয়নকে সেন্ট হেলেনা দ্বীপ এ বন্দি রাখা হয়। ধারণা করা হয় প্রতিদিন খাবারের সাথে অল্প পরিমাণে আর্সেনিক মিশিয়ে নেপোলিয়নকে খেতে দেওয়া হত। এভাবে স্লো পয়জনিংয়ের মাধ্যমে নেপোলিয়নকে হত্যা করা হয়। নেপোলিয়নকে তার অজান্তেই স্লো পয়জনিং এর মাধ্যমে হত্যা করা হয়। কিন্তু, আমরা তো নিজেরাই নিজেদেরকে বিভিন্ন বিষাক্ত খাবার গ্রহণের মধ্য দিয়ে স্লো পয়জনিং করে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছি। আমরা জানি কিন্তু কিছুই করতে পারছি না।

কয়েক বছর আগে ‘পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন’ একটা গবেষণা প্রকাশ করে। যেখানে বলা হয়েছে, রাসায়নিক ও বিষাক্ত খাদ্য গ্রহণের কারণে প্রতি বছর ক্যান্সার রোগী সংখ্যা- দেড় লাখ, কিডনি রোগীর সংখ্যা ২০ লাখ, গর্ভজাত বিকলাঙ্গ শিশু জন্ম নিচ্ছে ১৫ লাখ।

কথায় আছে সুস্থ খাবার, সুস্থ জীবন। আমরা খাবার খাই সুস্থ দেহের জন্যে, সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্যে। কিন্তু, এখন মানুষের হাতে তৈরি ভেজাল খাবার খেয়ে মানুষ মরছে।

সরকার, ব্যবসায়ী, মধ্যস্বত্ব ভোগী, ক্রেতা সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে এই মহামারি থেকে দেশের বাঁচাতে, জাতিকে বাঁচাতে। কোনো ছাড় নয়, অবস্থা যাই হোক।

[email protected]

Comments