পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির সাফল্য, হঠাৎ করে নয়-অজানাও ছিলো না

ভারতের সর্বকালের সব থেকে জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী কে? এ প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে এবার নেহরু, ইন্দিরার পরে যে নামটি লিখতে হবে সেটি হলো নরেন্দ্র মোদি। রাজীব গান্ধী বিপুল ভোটে ১৯৮৪ সালে নির্বাচন জিতেছিলেন বটে কিন্তু বছর তিনেক যেতে না যেতেই তা তলানিতে ঠেকে ছিলো। উল্টো দিকে মোদির কাঁধে ভর দিয়ে বিজেপি ২০১৪ সালে, এককভাবে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। ১৯৮৪’র পর সেটিও একটি রেকর্ড, কারণ মাঝের সময়টি ধরে ছিলো মিলিজুলি (কোয়ালিশন) সরকার।
West Bengal BJP
২৩ মে ২০১৯, নির্বাচনে জেতার পর পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতায় বিজেপি সমর্থকদের উল্লাস। ছবি: দ্য স্টেটসম্যান

ভারতের সর্বকালের সব থেকে জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী কে? এ প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে এবার নেহরু, ইন্দিরার পরে যে নামটি লিখতে হবে সেটি হলো নরেন্দ্র মোদি। রাজীব গান্ধী বিপুল ভোটে ১৯৮৪ সালে নির্বাচন জিতেছিলেন বটে কিন্তু বছর তিনেক যেতে না যেতেই তা তলানিতে ঠেকে ছিলো। উল্টো দিকে মোদির কাঁধে ভর দিয়ে বিজেপি ২০১৪ সালে, এককভাবে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। ১৯৮৪’র পর সেটিও একটি রেকর্ড, কারণ মাঝের সময়টি ধরে ছিলো মিলিজুলি (কোয়ালিশন) সরকার।

অনেকেই মনে করেছিলেন, ২০১৯ সালে মোদির পক্ষে এই জনপ্রিয়তা ধরে রাখা সম্ভব হবে না। ছোট রাজ্যভিত্তিক দলগুলো– যেমন পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল, উত্তরপ্রদেশের সমাজবাদী পার্টি এবং বহুজন সমাজ পার্টি ‘ফেডারেল ফ্রন্ট’ গড়েছিলো। কংগ্রেস এতে খোলাখুলি যোগ না দিলেও মোটামুটি বোঝাপড়ায় ছিলো (যেমন রাহুল গান্ধীর বিরুদ্ধে অখিলেশ বা মায়াবতী কেউ প্রার্থী দেননি)। মুল লক্ষ্য মোদিকে হারাতে হবে। ওদিকে বিজেপির স্লোগানও পুরোপুরি মোদিভিত্তিক ছিলো। অর্থাৎ বহুদলীয় ভোট অনেকটা মোদির বিরুদ্ধে রেফারেন্ডামের (গণভোট) আকার ধারণ করেছিলো। খবরের কাগজ ও টিভি দেখে কেউ মনে করেননি যে বিজেপির নিজের পক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভের কোনো আশা আছে।

বাস্তবে অবশ্য দেখা গেলো উল্টো। মোদির জনপ্রিয়তা বেড়ে গেছে। বিজেপির আসন ২৮২ থেকে বেড়ে ৩০৩। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে লাগে ২৭২। ভোটের হার ৩১% থেকে ৩৮%; ১৯৮৪-তে কংগ্রেসের ৩৯% এর কাছাকাছি। বারোটি রাজ্যে কংগ্রেস নেই। ট্রেনে চড়ে মুম্বাই থেকে উত্তরে গেলে, প্রথম কংগ্রেস এমপি পাওয়া যাবে পাঞ্জাবে। ফেডারেল ফ্রন্টের নেতাদের অবস্থা শোচনীয়। সকলের ভাগে মোদি থাবা বসিয়েছেন, এদের মধ্যে দিদি- মানে মমতা ব্যানার্জিও রয়েছেন। রাজ্যে ৪২টি আসনের মধ্যে ১৮টি বিজেপির দখলে। আগে ছিলো দুই। দিদি বলেছিলেন এবার ৪২টিই পাবেন। কাগজ বা টিভিওয়ালারাও বিজেপিকে বিশেষ পাত্তা দেয়নি। অথচ বিজেপির জয়জয়কার। কলকাতা থেকে পশ্চিমে ১০০ কি.মি. গেলেও তৃণমূল নেই। বাংলাদেশ থেকে ভারতে আসতে হলেও বনগাঁ বিজেপির। বর্ধমান, হুগলীর শিল্পাঞ্চলেও তৃণমূল নেই। উত্তরে ফারাক্কা ব্যারেজ পেরুলে শুধু বিজেপি। তার ওপরে আসামেও বিজেপি।

একটু তলিয়ে দেখলে, দেশে বিজেপির যে ২১টি আসন বেড়েছে তার ১৮টি এসেছে পশ্চিমবঙ্গ থেকে। এতো বাড়বাড়ন্ত তো অলক্ষ্যে হয় না। কেনো দেখতে পাননি, সে কথা তারাই বলবেন। তবে লোকে বলাবলি করছিলো ঠিকই, আর আমি যে দেখতে পেয়েছিলাম সেটা লিখেছিলাম। এই লেখার শেষে তা জুড়ে দিলাম, মিলিয়ে নিতে পারেন।

এখন প্রশ্ন: দিদির এই দুরবস্থা হলো কী করে? ২০১৯ সালে তৃণমূল লোকসভায় বামেদের থেকে বেশি (১৯) আসন পায়। বাকিটা ইতিহাস। ২০১১ সালে রাজ্যে ক্ষমতায় আসা। ২০১৪ সালে লোকসভায় মোদি ঝড় থামিয়ে ৩৪টি আসন। ২০১৬ সালে, নারদা ও সারদা কেলেঙ্কারি উড়িয়ে, ভোট ও আসন বাড়িয়ে ক্ষমতায় ফেরা। মাঝের তিন বছরে এমন কী হলো যে দিদির ভোট কমে ৪৩% আর বিজেপির ভোট ২০১৪’র ১৭% থেকে বেড়ে ৪০% হয়? ছ-মাস আগে পঞ্চায়েত ভোটেও তো দিদিরই জয়জয়কার।

প্রশ্নটি জটিল। পঞ্চায়েত ভোট দিয়েই শুরু করা যাক। পঞ্চায়েত ভোট করায় রাজ্য। তাতে এক-তৃতীয়াংশ আসন তৃণমূল কোনোরকম প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়াই জিতেছে। বিরোধীদের প্রার্থীই দিতে দেওয়া হয়নি। আদিবাসী অধ্যুষিত পুরুলিয়া, বাঁকুড়া জেলায় প্রতিরোধ এসেছিলো। বিজেপি সেখানে আসনও পায়। ভোটের ফলাফল বেরুতেই দেখা যায়, বিজেপি কর্মীরা গাছে, বিদ্যুতের খুঁটিতে, আমের মতো ঝুলে আছে। বিরোধীরা বললো- তৃণমূল মেরেছে। দিদির পুলিশ বললো, মিথ্যে কথা। এবারের ভোটে এসব জেলায় তৃণমূল দাঁত ফোঁটাতে পারেনি। কারণ বিরোধী ভোট সব একজোট ছিলো।

এর পরেও আছে। বীরভূম কেন্দ্রের কথাই ধরুন। এখানে ৪০% মুসলমান। ২০১৪ সালে তৃণমূল ৩৬% ভোট পেয়ে এখান থেকে জেতে। ৩১% ভোট পেয়ে দ্বিতীয় স্থানে ছিলো সিপিএম। কংগ্রেস ১০%। তৃণমূলের অত্যাচার থেকে বাঁচতে, ২০১৫ সালে বহু সিপিএম সমর্থক দলে দলে বিজেপিতে যোগ দেন। সে সময়ের কাগজ ঘাঁটলে দেখা যাবে, মুসলমান অধ্যুষিত পাড়ুই গ্রামে সবাই বিজেপি হয়েছিলো। তাতে অবশ্য অবস্থার বিশেষ হেরফের হয়নি। কারণ ২০১৮ সালে পঞ্চায়েত ভোটে এ জেলায় কোনো বিরোধী প্রার্থী ছিল না। ২০১৯’র লোকসভায় তৃণমূল পেয়েছে ৪৫%, বিজেপি ৩৯%, কংগ্রেস আর সিপিএম মিলে ১১%। মানে বিরোধী ভোট একজোট হয়ে বিজেপিতে গেছে যাতে তৃণমূলকে আটকানো যায়। যেটুকু ভোট এখনও কংগ্রেস কিংবা সিপিএমে পড়ে আছে, সেটা পাঁড় সমর্থকের ভোট। বাকিদের হিন্দু-মুসলমান নেই। মাথা বাঁচানোই প্রথম তাগিদ। আর বিজেপি এখন সেই ভরসা দিতে পারে।

দুটো উদাহরণ মিলিয়ে দেখলে বোঝা যাবে, পশ্চিমবাংলায় এবারের ভোটে হিন্দু-মুসলমান কোনো বিষয় ছিলো না। আদিবাসী থেকে আম-আদমি তাদের কাছে কেবলমাত্র দুটো পথ খোলা ছিলো ‘দিদি না মোদি?’ ২০০৯ ও ২০১১-তে মমতা ব্যানার্জি বিরোধীদের সিপিএমের বিরুদ্ধে একজোট করেছিলেন। এবার তা হয়নি। কিন্তু ভোটার এই সুযোগ ফস্কাতে চায়নি। তারা একজোট হয়েছে। আর নেতিবাচক ভোটের নিয়ম মেনেই বলা যায়, আগামী বিধানসভা নির্বাচনে এই ঢেউ আরও বড় হতে পারে। অন্তত এতোদিন তাই হয়েছে। ২০০৯’র লোকসভায় ধাক্কার পর সিপিএম আর পায়ের তলায় জমি খুঁজে পায়নি। আসলে আমার মনে হয়, সিপিএমের ৩৪ বছরের সরকারকে ধাক্কা দিতে পেরে, বাংলার ভোটার এখন বেশ সাহসী হয়ে গেছে। ভারতের অন্য রাজ্যে যেমন হয়। পছন্দ না হলেই গলাধাক্কা।

কাজের কথায় ফিরি। তাহলে ধর্ম এবারের নির্বাচনে আসেনি? এসেছে তো। উত্তরবাংলায় রায়গঞ্জ কেন্দ্রে এবারের নির্বাচনে এটা মুল বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। কারণ দাড়িভিট গ্রামে শিক্ষক নিয়োগককে কেন্দ্র করে দুই ছাত্রের মৃত্যুর ঘটনা। স্কুলে বাংলার শিক্ষক দরকার ছিলো। প্রশাসন পাঠায় উর্দুর শিক্ষক, যদিও উর্দু পড়াবার শিক্ষক আগেই ছিলো। ছাত্ররা যখন এনিয়ে হৈচৈ করছিলো তখন পুলিশের উপস্থিতিতেই কেউ গুলি চালায়, তাতে দুজন ছাত্রের মৃত্যু হয়। অভিযোগের আঙ্গুল উঠেছিলো পুলিশের দিকে। পুলিশ সে অভিযোগ নাকচ করে। এবারের নির্বাচনে রায়গঞ্জে হিন্দু-মুসলমানের দড়ি টানাটানি বড় আকার ধারণ করেছিলো।

তাছাড়া হিন্দু ভোটের একজোট হওয়ার প্রবণতা বেড়েছিলো। কেনো বেড়েছিলো তা বলতে গেলে মহাভারত হয়ে যাবে। তবে একটি উদাহরণ দেওয়াই যায়। প্রথম: ক্ষমতায় এসেই মমতা ইমাম ভাতা চালু করেন। মুসলমানদের ভেতর একটি শ্রেণি এর বিরোধিতা করেছিলেন তবে সে আপত্তি ধোপে টেকেনি। লোকসভা নির্বাচনের এক্সিট-পোল দেখে আবার ব্রাহ্মণ ভাতা চালু করেছেন। মমতার কাজের পেছনে কিন্তু যুক্তি ছিলো। পশ্চিমবঙ্গে ২৮%’র বেশি মুসলমান (মানে দেশভাগ হওয়ার আগে যা ছিলো তাই)। অতীতে এই ভোট কংগ্রেস ও সিপিএম সমানভাবে পেতো। তৃণমূল এর বেশিটাই (ধরা হয় ১৮%) কব্জা করেছে। বাকিটা সিপিএম আর কংগ্রেসের কাছে। মমতা পুরোটাই চেয়েছিলেন। তাহলে আর ক্ষমতায় থাকা ঠেকায় কে? মুশকিল হলো তাতে কিছু লোকে বাড়াবাড়ি করে ফেললো। এক ধর্মীয় নেতা তো গরম গরম কথা বলার জন্যে বিখ্যাত হয়ে উঠেছিলেন।

শুধু এটাই নয়। পশ্চিমবঙ্গে হিন্দুদের ভেতর ভোটে জাতপাতের হিসেব ছিলো না। ২০০৯ থেকে মতুয়া ভোট, রাজবংশী ভোট ইত্যাদি কথা শোনা গেলো। এমনকী, দার্জিলিংয়ে জাতপাতের হিসাবে সরকারি টাকায় ১৭টা কাউন্সিল চালু হলো। উদ্দেশ্য গোর্খা ভোট ভাঙ্গা। তারপর বিমল গুরুংকে ঘরছাড়া করা, বহু মাস ধরে ইন্টারনেট বন্ধ করা এসবও আছে। এবার বিজেপি দার্জিলিংয়ে প্রায় ৬০% ভোট পেয়েছে। কুচবিহার, জলপাইগুড়ি, বালুরঘাট- এরকম যে চারটি কেন্দ্রে রাজবংশীরা থাকেন সব বিজেপির। মতুয়াদের বনগাঁও বিজেপির। অর্থাৎ হিন্দু ভোট একজোট হওয়ার বিষয়টিকে যেভাবে প্রচার করা হচ্ছে তা পুরোপুরি ঠিক নয়। আদতে মমতা যে ভোটগুলোকে ভেঙেছিলেন। সেগুলো আবার ২০০৯’র আগের পরিস্থিতিতে ফিরে গেছে।

আর মুসলমানেরা যে কম হলেও বিজেপিকে ভোট দিয়েছেন সেকথাও জলের মতো স্পষ্ট। কুচবিহার কেন্দ্রে ৩০% এর ওপর মুসলমান। শুধু হিন্দু ভোট নিয়ে বিজেপি এখানে ৪৮% ভোট পায়? আরও ভালো উদাহরণ আছে মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুরে। এ জেলায় ৭০% মুসলমান। জঙ্গিপুরে সব প্রার্থী মুসলমান। বিজেপির মাফুজা খাতুন ২৪% ভোট পেয়ে দ্বিতীয় হয়েছেন। কংগ্রেসের এমপি, প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জীর ছেলে, অভিজিত ২০% ভোট পেয়ে তৃতীয়। তৃণমূল ৪৩% ভোট নিয়ে আসন পেয়েছে।

আসলে যেসব জেলায় মুসলমান ভোট ৩০% এর ওপর সেখানে তারা আর পাঁচটা নাগরিকের মতোই ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন। কারণ সমস্যাগুলো একই: গুন্ডাগিরি, তোলাবাজি, সিন্ডিকেট, পুলিশের অত্যাচার। রাজ্যে রোজগারের উপায় না থাকায়, হিন্দু-মুসলমান সবাইকেই ভিন রাজ্যে ছুটতে হয়। আর যারা ঘোরাঘুরি করে, তারা অন্যের মুখে শুনে ঝাল খায় না। তাছাড়া হাতে হাতে স্মার্টফোন তো আছেই। দেশে তো বিজেপি শাসিত রাজ্যই বেশি। তাই সেখানে কী হয়, বা না হয়, সেটি নিশ্চয়ই জানে।

এবারের ভোটে ১৮ থেকে ২৫ বছর বয়সীরা ঢেলে মোদিকে ভোট দিয়েছেন। বাস, অটোরিক্সা, ট্যাক্সিচালক, রাজ্য সরকারি কর্মী সবাই তাই। কেনো? সরকারি কর্মীরা মনে করেন তাদের প্রাপ্য ডিএ না দিয়ে, দিদি ক্লাবে টাকা দিয়েছেন। বাস, ট্যাক্সির কর্মীরা তোলাবাজিতে ক্লান্ত। এককালে এরা সিপিএমকে ভোট দিয়েছে। তারপর তৃণমূল। এবার বিজেপি। আর এর মধ্য দিয়েই পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে একটি বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলেছে।

চল্লিশ বছর ধরে এ রাজ্য আঞ্চলিক দলের দখলে। ক্ষমতাসীনরা, কেন্দ্রের সঙ্গে পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া করাটাকে, ভোট পাওয়ার অস্ত্র ভেবে ফেলেছিলেন; ফলে কেন্দ্রীয় রাজনীতির সঙ্গে যোগ নেই। অর্থনীতির অবস্থা বেহাল। ভোটার এবার বীতশ্রদ্ধ। কাউকে মৌরসি পাট্টা করার সুযোগ দেবে না। বিজেপিকেও না।

https://pratimview.blogspot.com/2019/04/west-bengal-may-witness-re-run-of-2009.html

লেখক: ভারতীয় সাংবাদিক

Comments

The Daily Star  | English

DMCH doctors threaten strike after assault on colleague

A doctor at Dhaka Medical College Hospital (DMCH) was allegedly assaulted yesterday after the death of a private university student there, with some of his peers accusing the physicians of neglecting their duty in his treatment

6h ago