ফিরে দেখা

শখের পিস্তল, ডগ ও কাফনের কাপড়

কতো মানুষের কতো রকমের শখ থাকে। ডাক টিকেট বা কয়েন সংগ্রহ বা ঘুরে বেড়ানো... কতো কিছু। এর বাইরে আরও বহু রকমের শখের কথাও অনেকেই কম বেশি জানি। কিন্তু, শখ যে কতো বিচিত্র বা অভিনব হতে পারে, তা জানার সুযোগ হয়েছিলো অনেক বছর আগে একদিন। ব্যতিক্রমী সেই শখের গল্প বলার আগে কিঞ্চিত ভূমিকা প্রয়োজন।
প্রতীকী ছবি। স্টার অনলাইন গ্রাফিক্স

কতো মানুষের কতো রকমের শখ থাকে। ডাক টিকেট বা কয়েন সংগ্রহ বা ঘুরে বেড়ানো... কতো কিছু। এর বাইরে আরও বহু রকমের শখের কথাও অনেকেই কম বেশি জানি। কিন্তু, শখ যে কতো বিচিত্র বা অভিনব হতে পারে, তা জানার সুযোগ হয়েছিলো অনেক বছর আগে একদিন। ব্যতিক্রমী সেই শখের গল্প বলার আগে কিঞ্চিত ভূমিকা প্রয়োজন।

২০০০ সালের আগে-পরের সময়কাল। রিপোর্টারের কাজ, মাঠে-ঘাটে ছুটাছুটি করে তথ্য সংগ্রহ করি। বাংলাদেশের আন্ডারওয়ার্ল্ডের তথ্য সংগ্রহ করে প্রতিবেদন লেখা শুধু পেশা নয়, নেশায়ও পরিণত হয়েছে। সুব্রত বাইন, কালা জাহাঙ্গীর, মুরগি মিলন, সুইডেন আসলাম, ইমন, জোসেফ, বিকাশ, পিচ্চি হান্নান, টোকাই সাগর... একজনের চেয়ে আরেকজন বড় সন্ত্রাসী। এসব সন্ত্রাসীদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলেছি, দেখা হয়েছে।

সবার আলাদা আলাদা বাহিনী আছে। চাঁদাবাজি তাদের আয়ের প্রধান উৎস। তাছাড়া অর্থের বিনিময়ে তারা মানুষ হত্যা করে। গ্রুপের ভেতরে হত্যায় যারা পারদর্শী তাদের কারও নাম ‘স্ট্রাইকার’ কারও নাম ‘হিটম্যান’। কে, কত সাহসিকতার সঙ্গে মানুষ হত্যা করলো, তা নিয়ে বহু গল্প আন্ডারওয়ার্ল্ডের ভেতরে। প্রভাব-আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে এক গ্রুপের হাতে আরেক গ্রুপের সন্ত্রাসী-ক্যাডার নিহত হওয়া খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। এসব সন্ত্রাসীদের ফোনে কেঁপে ওঠেন ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা।

এক ফোনে পাঁচ দশ বা বিশ লাখ টাকা পৌঁছে যায় তাদের কাছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর হলে কেউ ধরা পড়ে জেলে যায়। কেউ পালিয়ে চলে যায় ভারত বা নেপালে। হত্যার পরিকল্পনা করে সুইডেন আসলাম চলে যেতো সুইডেন। সেখান থেকে নিয়ন্ত্রণ করতো তার বাহিনী। হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন হওয়ার পর ফিরে আসতো দেশে। সুইডেন আসলামের সন্ত্রাসীরাই যে হত্যাকাণ্ডটি ঘটিয়েছে তা জানা থাকলেও, পাসপোর্ট প্রমাণ করতো যে সে তখন সুইডেনে ছিলো। সুইডেন আসলাম কবে-কখন সুইডেন গেলো, সুব্রত বাইন ঢাকায় না আগরতলায়, ইমন-বিকাশরা কবে-কাকে-কোথায়-কীভাবে হত্যা করলো, কোন সন্ত্রাসী গ্রুপের শক্তি কতোটা, কাদের কাছে কী অস্ত্র আছে, নতুন কী অস্ত্র কে কিনলো, এসব খবর জানার জন্যে দুই-তিন জন নির্ভরযোগ্য সোর্স ছিলেন। তাদের সঙ্গে নিয়মিত বিরতিতে দেখা করতাম। এদের একজন এক সময়ের ছাত্ররাজনীতির অস্ত্রধারী ক্যাডার ছিলেন। তখন তিনি সরাসরি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত নন। বিয়ে করেছেন। কিন্তু, আন্ডারওয়ার্ল্ডের প্রতি মুহূর্তের সংবাদ তার নখদর্পণে। এসব সংবাদ রাখা যেনো তার শখ। জাসদের মুরাদ জেল থেকে বের হয়ে ভোর রাতে কেনো মগবাজার রেলগেট এলাকায় গেলো, কোন গ্রুপের কোন ‘স্ট্রাইকার’ তাকে কোন অস্ত্র দিয়ে গুলি করে হত্যা করলো- সব তার জানা। তার থেকে জেনে দু-তিনটি উৎস থেকে যাচাই করে দেখেছি, তথ্য সঠিক। অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, পুলিশ সন্ত্রাসীদের নিয়ে মিথ তৈরি করে এবং তাদের তথ্যে সত্যের ঘাটতি থাকে। পুলিশ তাদের মতো করে তথ্য সরবরাহ করে সাংবাদিকদের দিয়ে তা লেখানোর চেষ্টা করেন। অনেক ক্ষেত্রেই পত্রিকায় তা প্রকাশিত হয়। মোটামুটি নিশ্চিত হয়েছি কালা জাহাঙ্গীর নামে কোনো সন্ত্রাসী ছিল না। অথচ কালা জাহাঙ্গীরকে নিয়ে যে মিথ পুলিশ সরবরাহ করেছে, পত্রিকায় তাই লেখা হয়েছে।

শুধু পুলিশের তথ্যের উপর নির্ভর করে কখনো কোনো প্রতিবেদন লিখিনি।

যাই হোক, প্রায়ই সেই সোর্সের বাসায় যেতাম। তার অবস্থা যে খুব সচ্ছল ছিলো না, তা বোঝা যেতো। জীবনে কিছুই করতে পারলেন না, কতোজনের জন্যে কতো কিছু করেছেন, জীবনবাজি রেখেছেন, অথচ তারা তার জন্যে কিছুই করলেন না। হতাশার কথা কিছু কিছু বলতেন কখনো কখনো।

এখন কী করছেন বা কী করবেন, এ জাতীয় এক প্রশ্নের উত্তরে যা বললেন, তা শুনে কথা বন্ধ হয়ে গেলো। নির্বিকারভাবে বললেন, “আমার জীবনের একটি শখ কিছু টাকা হলে একটা পিস্তল কিনবো।” পিস্তলের নাম, আকারে কতোটুকু, কীভাবে কোমরে রাখবেন, সবকিছু অভিনয় করে দেখালেন। বুঝলেন, “শখ আছে কিন্তু শখ পূরণের সামর্থ্য নেই। টাকা হলেই একটি পিস্তল কিনে ফেলবো।” “তারপর রাস্তা দিয়ে হাঁটবো এভাবে”- অভিনয় করে দেখালেন।

বিস্মিত হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। “কী হলো, এভাবে তাকিয়ে আছেন কেনো?” সম্বিত ফিরে প্রশ্ন করলাম- “আপনি তো এখন আর ঐ জীবনে নেই, পিস্তল দিয়ে কী করবেন?”

একজনের নাম উল্লেখ করে বললেন, ৮০ হাজার টাকা দিয়ে ‘ফাইভ স্টার’ কিনেছে। আরেকজনের কথা বললেন, তার পিস্তল ম্যাচ বাক্সের মতো ছোট। “আমার শখ এই সাইজের (হাত দিয়ে দেখালেন) পিস্তল। কতোজনের তো কতো রকমের শখ থাকে, আমার শখ একটা পিস্তল!”

তখন আমাদের শখ একটি জিনসের প্যান্ট, টি-শার্ট বা একজোড়া কেডস। পকেট ফাঁকা, কিনতে পারি না। আর তার শখ পিস্তল। টাকা নেই, কিনতে পারছেন না। এখন তার সঙ্গে যোগাযোগ আছে ফেসবুকে।

এই জীবনে তার শখ পূরণ হয়েছে কী না, জানা হয়নি।

২.

ছাত্ররাজনীতির অস্ত্রধারীরা পরিচিত ‘ক্যাডার’ নামে, সন্ত্রাসী নয়। প্রচলিত অর্থের যে সন্ত্রাসী, ক্যাডাররা তা ছিলো না। এখন ছাত্ররাজনীতিতে ‘ক্যাডার’ নেই। দখলদার-চাঁদাবাজ-মাস্তান আছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাডারদের অনেকে নিজেদের বিচিত্র কর্মকাণ্ড দিয়ে, অভিনব নামে পরিচিতি পেয়েছেন। ‘লাল ফিতার স্টেনগান’ ক্যাডার পাগলা শহীদের মৃত্যুর ঘটনা মর্মান্তিক। কিন্তু তা নিয়ে রোমাঞ্চকর কতো গল্প শুনেছি কতোজনের মুখে!

‘প্যালেস্টাইন বাবু’ নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন ক্যাডার ছিলেন। এমন নামকরণের কারণ ফিলিস্তিনিদের পক্ষে যুদ্ধ করতে গিয়েছিলেন তিনি।

ন্যাটা, ওয়েস্টার্ন, পিচ্চি... নামের আগে এমন বিচিত্র বিশেষণযুক্ত ছোট-বড় বহু ক্যাডারের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে। ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছি। ১৯৯৬ বা ৯৭ সালের ঘটনা। এক ক্যাডার গ্রুপের প্রধানের সঙ্গে কথা বলছি মহসিন হলের গেটের ভেতরে। কলাপসিবল গেটে তালা, বাইরে ত্রিশ চল্লিশজন পুলিশ। কলাপসিবল গেট লাগোয়া একটি কাঠের টেবিল, দুটি চেয়ার। গেটের তালা খুলে একটিতে বসতে দেওয়া হলো। বললেন, ভাই আসছেন। আপনি একটু বসেন, চা খান। হলের ভেতর থেকে ভাই আসলেন, সঙ্গে বিশ-পঁচিশ জন। কথা বলছি, দুই ক্যাডার দুই পাশে কাটা রাইফেল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন। দুটি রাইফেলেরই মুখ আমার দিকে। হুট করে কাটা রাইফেলের গুলি বের হয়ে যাওয়ার বহু গল্প শুনেছি।

কলাপসিবল গেটের এপাশে রাইফেল হাতে পুলিশ, ওপাশে কাটা রাইফেল হাতে ক্যাডার। মাঝখানে বসে আছি।

আমার অস্বস্তি দেখে ভাই ধমক দিয়ে দুই কাটা রাইফেলধারী ক্যাডারকে সরে যেতে বললেন। প্রতিবেদনে কিছু লিখেছিলাম, কিছু লিখিনি।

তাদের অস্ত্র-সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নিয়ে লিখলে সাধারণত কিছু মনে করতেন না। একজনের চেয়ে আরেকজনকে বেশি গুরুত্ব দিলে অভিযোগ করতেন।

আলাদা করে ক্যাডাররা ছিলো ছাত্ররাজনীতির আলোচনার বিষয়।

ঢাকা কলেজের ক্যান্টিনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলছিলেন “তুই জানোস না, ইলিয়াস ভাই ডন্ট লাইক বেয়াদবি।” একথা বলতে বলতে কোমর থেকে পিস্তল বের করলেন। পরে জানলাম, ছিপছিপে গড়ন, লম্বা চুলের এই ক্যাডারের নাম মির্জা। ‘ইলিয়াস গ্রুপ’র অসীম ‘সাহসী ফাইটার’ হিসেবে পরিচিত। অভিরা ছাত্রলীগে যোগ দেওয়ার পর ক্যাম্পাসে অভি গ্রুপের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেলেন ‘সাহসী ফাইটার’ মির্জা।

সাংবাদিকদের মধ্যে ক্যাডারদের নানা হিরোইজমের গল্প লেখার যেনো একটা প্রতিযোগিতা ছিলো। অভির ইংরেজি পোস্টার নিয়ে গল্প লেখা হতো।

’সন্ত্রাস যদি কোনো শিল্প হয় তবে তার জন্মদাতা গোলাম ফারুক অভি’- আদৌ ক্যাডার অভি কোনোদিন একথা বলেছিলেন কী না তা নিশ্চিত হওয়া না গেলেও সাধারণ শিক্ষার্থীদের মাঝে ছড়িয়ে পড়েছিলো এসব কথা। পুলিশ যেভাবে সন্ত্রাসীদের নিয়ে মিথ তৈরি করতো, কোনো কোনো সাংবাদিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাজনীতির ক্যাডার-সন্ত্রাসীদের নিয়ে সেভাবে মিথ তৈরি করতো। যাই হোক, আজকের লেখার মূল প্রসঙ্গে ফিরে যাই।

১৯৯৮ বা ৯৯ সালের ঘটনা। একজন ক্যাডারকে নিয়ে লিখে বড় বিপদে পড়ে গেলাম। তার নাম ছিল শিশির।

শিশির হঠাৎ করে ক্যাম্পাসে ‘ডগ শিশির’ নামে পরিচিত হয়ে উঠলেন। আইয়ুব খানের এনএসএফের ক্যাডার পাঁচ-পাত্তুররা ক্যাম্পাসে সাপ নিয়ে ঘুরতেন। সাপ দিয়ে প্রতিপক্ষকে ভয় দেখাতেন।

‘ডগ শিশির’ মোটরসাইকেলের পেছনে একটি কুকুর নিয়ে ঘুরতেন। তার ৮০ সিসির একটি মোটর সাইকেল ছিলো। শিশির কাঁটাবন পশু-পাখির মার্কেটে গিয়েছিলেন চাঁদা আনতে। এখানকার ব্যবসায়ীদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাডারদের নিয়মিত চাঁদা দিতে হতো। একদিন শিশির চাঁদা পায়নি বা প্রত্যাশা অনুযায়ী পায়নি। দোকান থেকে একটি বিদেশি কুকুর নিয়ে চলে এসেছেন। হলে তার রুমে সেই কুকুর থাকে। মোটরসাইকেলের পেছনে সেই কুকুর নিয়ে পুরো ক্যাম্পাস ঘুরে বেড়ায়। রসিক শিক্ষার্থীরা তাকে ‘ডগ শিশির’ নামে ডাকতে শুরু করলেন। সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল ‘ডগ শিশির’ নাম। গ্রাম থেকে আসা শিশির কীভাবে ‘ডগ শিশির’ হয়ে উঠলেন, বিস্তারিত লিখলাম।

লেখার কারণে কোনো ক্যাডার যে এতোটা ক্ষিপ্ত হতে পারেন, ধারণা ছিলো না। ক্যাম্পাসের ছাত্রনেতারা ফোন করে সতর্ক করলেন, যেনো ক্যাম্পাস বা আশেপাশে আগামী কিছুদিন না যাই। ‘ডগ শিশির’ পিস্তল নিয়ে খোঁজ করছেন। অফিসে কয়েকবার ফোন করেছেন। যিনি যখন ফোন ধরেছেন তাকে প্রকাশ-অযোগ্য ভাষায় বিষোদগার করেছেন। একবার আমার সঙ্গেও কথা হলো। বাংলা ভাষায় প্রকাশ-অযোগ্য যতো রকমের শব্দ আছে, সবই বললেন। কাটা রাইফেল শরীরের কোথায় ঠেকিয়ে গুলি করবেন, তার কুকুরকে কীভাবে খাওয়াবেন... বলতে কোনো কিছুই বাকি রাখলেন না। শেষ বাক্য ছিলো এমন- “তুই থাক আইতাছি আমি তোর অফিসে।”

‘ডগ শিশির’ এমনই রগচটা-ক্ষিপ্ত ক্যাডার ছিলেন, তার পক্ষে কোনো কিছুই অসম্ভব ছিলো না।

খোঁজ নিতে গিয়ে জানলাম, এখন তিনি নিজেকে আমূল বদলে ফেলেছেন।

৩.

একই সঙ্গে হুমকি ও বিড়ম্বনার একটি দীর্ঘ কাহিনি সংক্ষেপে বলি। আন্ডারওয়ার্ল্ড নিয়ে অনুসন্ধান করছি, লিখছি। ’আন্ডারওয়ার্ল্ড’ নামে একটি বই লিখলাম। অনন্যা প্রকাশনী বইটি প্রকাশ করবে। প্রখ্যাত শিল্পী ধ্রুব এষ প্রচ্ছদ আঁকলেন। প্রচ্ছদ-বই ছাপা হলো। কিন্তু, প্রকাশক মনিরুল হক কোনোভাবেই বইটি বাজারে আনতে সাহস করলেন না। লেখক আর প্রকাশক ছাড়া সেই বই আর কারো দেখারও সুযোগ হলো না। এরপর আন্ডারওয়ার্ল্ডের পাশাপাশি জঙ্গি নিয়ে অনুসন্ধান করতে শুরু করেছি। ‘আন্ডারওয়ার্ল্ড’ বইটির আর একটু সহনশীল সংস্করণ ‘আন্ডারওয়ার্ল্ড ও বাংলাদেশের রাজনীতি’ নামে একটি বই লিখেছি। প্রকাশ করলেন শ্রাবণ প্রকাশনীর রবিন আহসান।

নানা রকমের হুমকি-আতঙ্ক মনের মধ্যে থাকলেও তা প্রকাশ করি না।

ঘটনাটি সম্ভবত ২০০৩ বা ২০০৪ সালের। একদিন অফিসে বসে আছি। এক রুমে চারজন বসতাম। কুরিয়ার যোগে বেশ বড় আকারের একটি প্যাকেট এসেছে আমার নামে। প্যাকেট খুললাম, রুমের সবারই যেনো ভাষা হারিয়ে গেলো।

প্যাকেটের ভেতরে কাফনের কাপড় এবং তিন লাইনের একটি চিঠি। প্রস্তুত থাকতে বলেছেন। পত্রিকায়-টেলিভিশনে সংবাদটি প্রকাশিত হলো। আত্মীয়-বন্ধু-পরিচিতজনদের আতঙ্কের মাত্রা ছাড়িয়ে গেলো।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় থেকে যোগাযোগ করা হলো। তারা নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত। তখনকার আইএসপিআর’র পরিচালক লে. কর্নেল নজরুল ইসলাম আসলেন অফিসে। আলোচনার বিষয় নিরাপত্তা।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ে কর্মরত গুরুত্বপূর্ণ একজন শুভানুধ্যায়ী নিরাপত্তার জন্যে একটি পিস্তল কেনার কথা বললেন। লাইসেন্সসহ যাবতীয় প্রক্রিয়া তিনি সম্পন্ন করে দিবেন।

পিস্তল কিনতে নাকি দুই-তিন লাখ টাকা লাগবে। কোথায় পাবো এতো টাকা?

একথা শুনে একজন শুভানুধ্যায়ী পিস্তল কিনে দিতে চাইলেন। পিস্তল বহন করবো কীভাবে? রিকশায় চড়ে ঢাকা শহর ঘুরবো সঙ্গে পিস্তল নিয়ে? তা কী করে সম্ভব?

পিস্তল বহন করে চলাফেরা করা সম্ভব না। সুতরাং এ চিন্তা বাদ।

রমনা থানা থেকে তিনজন পুলিশ দেওয়া হলো। সব সময় সঙ্গে সঙ্গে থাকবেন পুলিশ তিনজন। তখন নিজস্ব গাড়ি নেই। মূলত রিকশায় যাতায়াত করি। তিনজন পুলিশ, তিনটি বড় বড় রাইফেল। এক রিকশায় তো চারজন যাওয়া যায় না। ভাড়ায় ট্যাক্সি পাওয়া যায়, কিন্তু অনেক খরচ। নিরাপত্তাও দরকার, আবার পকেটের অবস্থাও করুণ। এভাবে দিন পনেরো কাটলো। যেখানে যাই, সঙ্গে তিনজন পুলিশ। সবাই তাকিয়ে থাকে। সে কী দুর্বিষহ জীবন!

তারপর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ে বলে-কয়ে পুলিশ ফেরত পাঠাতে সক্ষম হলাম।

বলা হলো, সাবধানে থাকবেন।

‘সাবধানে থাকবেন’- একথা যে কতো শত-হাজার-লক্ষবার শুনলাম! আজও বুঝলাম না ‘সাবধানে থাকা’ বলতে আসলে কী বোঝায় বা সাংবাদিক হয়ে ‘সাবধানে’ থাকবো কীভাবে?

[email protected]

Comments