‘আগে বাংলাদেশ, পরে বাকি দুনিয়া’

কার্ডিফের টাফ নদীর এক পাড়ে মিলেনিয়াম রাগবি স্টেডিয়াম। রাগবি মাঠ হলেও এখানে ২০১৭ সালের চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনাল হয়েছিল। বেশ বিখ্যাত মাঠ। ঠিক ওপারে ‘দ্য রিভার হাউজ’ হোটেলে মিলেছিল দিন তিনেকের আশ্রয়। অদ্ভুত সুন্দর জায়গা। জানালা খুললেই চোখে পড়ে সোজা বয়ে চলা নদী, গায়ে লাগে ফুরফুরে হাওয়া। তার পাশ দিয়ে নিঃসঙ্গ রাস্তা। শনিবার সকালবেলা সেই নীরব নিস্তরঙ্গ রাস্তাতে হঠাৎ হৈ-হল্লার আওয়াজ।
bangladesh cricket supporters
ছবি: রয়টার্স

কার্ডিফের টাফ নদীর এক পাড়ে মিলেনিয়াম রাগবি স্টেডিয়াম। রাগবি মাঠ হলেও এখানে ২০১৭ সালের চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনাল হয়েছিল। বেশ বিখ্যাত মাঠ। ঠিক ওপারে ‘দ্য রিভার হাউজ’ হোটেলে মিলেছিল দিন তিনেকের আশ্রয়। অদ্ভুত সুন্দর জায়গা। জানালা খুললেই চোখে পড়ে সোজা বয়ে চলা নদী, গায়ে লাগে ফুরফুরে হাওয়া। তার পাশ দিয়ে নিঃসঙ্গ রাস্তা। শনিবার সকালবেলা সেই নীরব নিস্তরঙ্গ রাস্তাতে হঠাৎ হৈ-হল্লার আওয়াজ।

শব্দগুলোও অতি চেনা। এই হোটেলে আর কোনো বাংলাদেশি দেখিনি, ভাবলাম হুট করে এত দেশি কথা-বার্তা এলো কোত্থেকে! জানালা খুলে বাইরে তাকাতেই দেখি লাল-সবুজ জার্সি আর পতাকা নিয়ে বেশ ক’জনের আড্ডা। আগের দিন দুপুরে এখানে এসে তেমন কোনো বাংলাদেশি চোখে পড়েনি। এমনকি রাস্তা-ঘাটে স্থানীয় মানুষের সংখ্যাও নেহায়েত হাতেগোনা। আগ্রহ নিয়ে আলাপ জমালাম। বেশিরভাগই এসেছেন লন্ডন থেকে, কেউ অনেক পথ ঘুরে এসেছেন বার্মিংহাম থেকে, ব্রিস্টল থেকে ছুটে এসেছেন আরও ক’জন। অল্প হলেও দেশ থেকে আসা দুই-চারজনেরও দেখা মিলল।

বাংলাদেশ থেকে আসা ক্রীড়া সাংবাদিক জেনেই কয়েকজনের প্রশ্ন, ‘ভাই সেদিন (নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে) রুবেলকে রাখে নাই কেন, আজ রুবেলকে রাখবে তো?’ রুবেল হোসেন ওয়াকার ইউনুস নন। কিন্তু শনিবার ইংল্যান্ডের বিপক্ষে নামার আগে তার কদর বাংলাদেশি ভক্তদের কাছে সেই পর্যায়েই চলে গিয়েছিল। যার সঙ্গেই কথা বলেছি সবার মুখেই রুবেলের নাম। ২০১৫ সালে অ্যাডিলেডে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে দেওয়ার নায়ক ছিলেন রুবেল। ফের বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচে রুবেলকে না রাখায় মানুষের ক্ষোভ, খেদ দেখা গেল ম্যাচের পরে। ‘কেন রুবেল নাই? কেন টস জিতে আগে ফিল্ডিং? সব বাদ দিলেও কেন এরকম হাল ছেড়ে দেওয়া অ্যাপ্রোচ?’ সমর্থকদের এমন ঝাঁঝালো প্রশ্ন, উত্তেজিত আলাপ বুঝিয়ে দেয় তাদের প্রত্যাশার মাত্রা আসলে কতটা চড়া।

পৃথিবীর যেকোনো দেশেই ক্রিকেট খেলা হলে বেশিরভাগ সমর্থক পাওয়া যায় ভারতের। সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে, পাল্লা দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশও। লন্ডনের ওভালে মাশরাফি বিন মর্তুজাদের দুই ম্যাচেই ৯০ শতাংশ সমর্থক ছিল বাংলাদেশের। নিউজিল্যান্ডের রস টেইলর তো সেদিন খেলা শেষে বলেই দিয়েছেন, ‘ঢাকা না চট্টগ্রামে খেলছি!’ কার্ডিফের সোফিয়া গার্ডেন্সে ওভালের মতো লাল-সবুজের উত্তাল ঢেউ ওঠেনি। গ্যালারিতে স্বাগতিক দলের মান রাখতে ইংলিশ সমর্থকরাও ছিলেন ভরপুর।

তবে বাঙালিরাও কম যাননি। খেলার দিন সকালবেলা হোটেলেই একজনের সঙ্গে আলাপ। ব্যবসা ফেলে তিনি এসেছেন সিলেট থেকে। ওভালে নিউজিল্যান্ডের কাছে হার দেখেছেন। কার্ডিফের পর ব্রিস্টলে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচ দেখে ফিরবেন দেশে। দল সেমিফাইনালে গেলে আবার আসবেন। সেই ভদ্রলোক বলছিলেন, ‘ভাই সেদিন (নিউজিল্যান্ড ম্যাচ) যে কী কষ্ট পেয়েছি, বলে বোঝাতে পারব না। একদম বুকটা ভেঙে গেছে।’ ইংল্যান্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশ হৃদয় ভেঙে দেওয়ার মতো খেলেনি। একপেশে লড়াইয়ে কি আর হৃদয় ভাঙার পরিস্থিতি হয়! সেদিন যা হয়েছে তা উন্মাতাল সমর্থকদের রাগ বাড়িয়ে দিয়েছে। নিজেদের প্যাশনের স্রোতে ভেসে খেলা দেখতে গিয়ে নেওয়া সব ঝক্কি-ঝামেলার দায় যেন ক্রিকেট দলের!

সিমিন হোসেন এসেছেন লন্ডন থেকে। পড়াশোনার সূত্রে এদেশে থাকছেন। পড়াশোনার ফাঁকে এখানে কাজ করতে হয়। কাজে ফাঁকি দিলে পকেটে টান পড়ে। কিন্তু বাংলাদেশের খেলা দেখার জন্য সব ছাড় দিয়েছেন। বাদবাকি দিনগুলোতে অতিরিক্ত কাজ করে, বাড়তি শারীরিক শ্রম দিয়ে খেলার দিন ফাঁকা রাখছেন। তার মতে, ‘নিউজিল্যান্ডের কাছে দল হারলেও সেই ম্যাচ নিয়ে অখুশি হওয়ার কিছু ছিল না। ওভালের মতো মাঠে এত কম রান নিয়ে এরকম লড়াই বরং অবিশ্বাস্য কিছু। কিন্তু ইংল্যান্ডের সঙ্গে না জিতলেও আরেকটু লড়াই কি করা যেত না?’

শনিবার ইংল্যান্ডের বিপক্ষে লড়াই দূরে থাক, বাংলাদেশের শরীরী ভাষাও ছিল কেমন যেন নিস্তেজ। ফিল্ডিংয়ে ক্ষিপ্রতা তো দেখাই যায়নি। উল্টো মৌলিক ভুলের মহড়া চলেছে ম্যাচজুড়ে। ইনিংস বিরতির সময়ই লন্ডন থেকে আসা রানা মেহের জিজ্ঞেস করলেন, ‘এসব কি চলছে? এমন কেন হলো?’ লন্ডন থেকে এসেছিলেন সুমনও। দশ বছর ধরে এদেশে বাস। ব্রিটিশ নাগরিকত্ব পেয়ে গেছেন বেশ আগে। নাগরিকত্বের সূত্রে ইংল্যান্ডও তো তার দল। বাংলাদেশ হারলেও জিতেছে তো ইংল্যান্ড। তার তো উইন-উইন সিচুয়েশন হওয়ার কথা- এই কথায় আপত্তি তুলে বললেন, ‘কি বলেন ভাই, আগে বাংলাদেশ, পরে বাকি দুনিয়া। বাংলাদেশের সঙ্গে খেলা হলে আর কাউকে চিনি না। ইংল্যান্ড দ্বিতীয় পছন্দ। খুব কষ্ট পেয়েছি, মূলত রাগ লেগেছে বেশি। একটু সম্মান রাখা তো দরকার ছিল।’

খেলায় হয়তো মান-সম্মান খসে পড়ার কিছু নেই। কিন্তু একপেশে, লড়াইবিহীন হারকে সমর্থকরা দেখছেন সম্মানহানীর মতোই। খেলা নিয়ে তাদের বোঝাপড়ারও যেন শেষ নেই। প্রত্যেকেরই আছে ‘বিশেষজ্ঞ মত’! সেসব জানাতে মরিয়াও তারা। ‘ঘাস আছে এমন উইকেটে মইন আলীকে বাদ দিয়ে লিয়াম প্লাঙ্কেটকে খেলিয়েছে ইংল্যান্ড। বাংলাদেশ কেন রুবেলকে রাখল না?’ ইংল্যান্ড আগে ব্যাটিং পেলেই বড় বড় রান করে ফেলে, তবে সেধে সেধে তাদের কেন ওটা করতে দেওয়া।

তাদের সব ব্যাখ্যাই হয়তো ক্রিকেটীয় নয়, মিশে আছে তীব্র আবেগ। সেই আবেগের জোরে সোফিয়া গার্ডেন্সের রাগ সোফিয়া গার্ডেন্সেই ফেলে সবাই ছুটছেন ব্রিস্টল। মান্না রায় নামের এক ভক্ত জানালেন, সব ভেন্যুতে ঘুরেই খেলা দেখার পরিকল্পনা তার, টিকেট কিনে রেখেছেন আগে-ভাগে। আপাতত র‍্যাঙ্কিং, শক্তিতে পিছিয়ে থাকা লঙ্কানদের বিপক্ষে তো জিততেই হবে। ক্রিকেটাররা নেতিয়ে পড়লে গ্যালারি থেকে গলা ফাটিয়ে তাদের জাগাতে হবে। মাঠে ক্রিকেটাররা খেলছেন বটে, এখানকার সমর্থকরা মনে করছেন মাঠের বাইরে তাদের কাজও বিস্তর।

নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সেদিনের উত্তাপ ছড়ানো শেষ মুহূর্তগুলোতে যেমন একজন শোনাচ্ছিলেন গ্যালারির বাইরে গিয়ে তার পায়চারীর কথা। তার মনে হয়েছিল, খেলা না দেখে পায়চারী করলেই বাংলাদেশ জিতে যাবে! এরকম অনেক সংস্কার ধারণ করেও মাতোয়ারা অনেকে। ব্রিস্টল থেকে টন্টন হয়ে নটিংহ্যাম, সব ভেন্যুতেই লাল-সবুজের রঙ মাখাতে তৈরি তারা। যেকোনোভাবেই হোক, অন্তত সেমিফাইনালে বাংলাদেশকে চাই-ই চাই।

Comments

The Daily Star  | English

One month of interim govt: Yunus navigating thru high hopes

A month ago, as Bangladesh teetered on the brink of chaos after the downfall of Sheikh Hasina, Nobel Laureate Muhammad Yunus returned home to steer the nation through political turbulences.

5h ago