ক্যাম্প ছেড়ে পালাচ্ছে রোহিঙ্গারা, সংগ্রহ করছে বাংলাদেশের পাসপোর্ট

বিভিন্ন উপায়ে ক্যাম্প ছেড়ে পালাচ্ছে বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা। তাদের কেউ সাগর পাড়ি দিয়ে মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টা করছে। আবার কেউ বাংলাদেশের বিভিন্ন গ্রামে ঢুকে বাংলাদেশিদের সঙ্গে মিশে গিয়ে কৌশলে পাসপোর্ট তৈরি করে বিদেশে পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে।
rohingya refugee camps
২০১৭ সালের আগস্টে সেনাবাহিনীর নিষ্ঠুর নির্যাতনের শিকার হয়ে মিয়ানমার ছেড়ে নতুন করে অন্তত ৮ লাখ রোহিঙ্গা কক্সবাজারের বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান করছে। ছবি: এএফপি

বিভিন্ন উপায়ে ক্যাম্প ছেড়ে পালাচ্ছে বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা। তাদের কেউ সাগর পাড়ি দিয়ে মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টা করছে। আবার কেউ বাংলাদেশের বিভিন্ন গ্রামে ঢুকে বাংলাদেশিদের সঙ্গে মিশে গিয়ে কৌশলে পাসপোর্ট তৈরি করে বিদেশে পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে।

রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করছে এমন কয়েকটি এনজিও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা মানবিক সহায়তা পেলেও অনেকে মনে করছেন সহসা তাদের স্বদেশে প্রত্যাবাসন হবে না। তাই ক্যাম্পে বসবাসের একঘেয়েমি জীবন থেকে বের হয়ে তারা স্বাধীনভাবে চলতে চায়। এমন চিন্তায় অনেকে ক্যাম্প থেকে পালিয়ে যাচ্ছে।

আশ্রিত রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা ইন্টার সেক্টর কমিউনিকেশনের (আইএসসিজি) মুখপাত্র সৈকত বিশ্বাস জানান, রোহিঙ্গাদের অনেকে উন্নত জীবনের জন্য দেশের বাইরে যেতে চায়। আবার অনেকের আত্মীয়-স্বজন বিদেশ থাকার কারণে এসব রোহিঙ্গারা সেসব দেশে গিয়ে তাদের সঙ্গে মিলন ঘটানোর জন্য বিদেশ পাড়ি দিতে তৎপর।

এই অবস্থা অব্যাহত থাকলে আরেক ধরনের নতুন সংকট সৃষ্টি হবে বলে আশঙ্কা করছেন এই কর্মকর্তা।

এনজিও সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্র জানিয়েছে, প্রতিদিন ক্যাম্প থেকে রোহিঙ্গারা পালাচ্ছে। রোহিঙ্গাদের নির্দিষ্ট সীমানায় ঘের দিয়ে রাখতে না পারায় তারা বনজঙ্গলসহ বিভিন্ন চোরাপথ দিয়ে সহজে বের হয়ে যাচ্ছে। সাগর পথে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কিছু রোহিঙ্গা পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করলেও অধিকাংশ রোহিঙ্গা এখন কৌশল পাল্টিয়েছে। তারা বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে ঢুকে পড়ছে। এরপর বাংলাদেশিদের সঙ্গে মিশে গিয়ে তাদের সঙ্গে বসবাস করছে। পরে তৈরি করছে পাসপোর্ট। আর উড়াল দিচ্ছে বিদেশে। এ সুযোগে রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প থেকে বের করে বিদেশে পাচার করতে গড়ে উঠেছে ক্যাম্পভিত্তিক দালাল চক্রও।

সূত্র জানায়, সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টাকালে বিজিবি, কোস্টগার্ড ও পুলিশের পৃথক ২১টি অভিযানে গত দেড় মাসে প্রায় ছয়শত রোহিঙ্গাকে আটক করা হয়েছে।  সর্বশেষ গত ৬ জুন কক্সবাজার শহরের লিংকরোড থেকে ১৮ জন রোহিঙ্গাকে আটক করে পুলিশ। এর আগে, গত ৩০ মে সেন্টমার্টিনের দক্ষিণে গভীর সমুদ্রে মালয়েশিয়া পাড়ি দেওয়ার সময় কোস্টগার্ড দুই দালালসহ ৫৮ জনকে আটক করে। এর মধ্যে ২০ জন পুরুষ, ২৬ জন নারী ও ১০ শিশু রয়েছে। তারও আগে ২০টি অভিযানে ৫১৭ রোহিঙ্গাকে আটক করে ক্যাম্পে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। অন্যদিকে ৩২ দালালকে আটক করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

শুধু সাগর পথে রোহিঙ্গারা পালানোর চেষ্টা করছে না, তারা বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে বৈধভাবে বিদেশ পাড়ি দেওয়ারও চেষ্টা করছে। গত ১০ মে রাজধানীর খিলক্ষেত থেকে বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে পালানোর সময় ২৩ জন রোহিঙ্গা ধরা পড়ে। এছাড়া, দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাসপোর্ট করতে গিয়ে আরও অর্ধশত রোহিঙ্গা ধরা পড়েছে।

কক্সবাজার আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক আবু নাঈম নাসিম জানান, পাসপোর্ট পাওয়ার জন্য রোহিঙ্গাদের করা ৩০০ আবেদন জব্দ করা হয়েছে।

তিনি বলেন, রোহিঙ্গা মেয়েরা প্রথমে কিছুদিন স্থানীয়দের সঙ্গে বসবাস করে। পরে তারা স্থানীয় ভাষা রপ্ত করে, স্থানীয়দের মতো ড্রেস পরে। আচার-আচরণ সবকিছু স্থানীয়দের মতো শিখে ফেলে। এরপর স্থানীয়রা মা-বাবা সেজে বিভিন্ন কাগজপত্র সংগ্রহ করার পর পাসপোর্ট অফিসে এসে হাজির হয়। হজে যাবে বা চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাবে বলে পাসপোর্ট নেওয়ার চেষ্টা করে। এভাবে নানা কৌশলে পাসপোর্ট নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে রোহিঙ্গারা।

সূত্র জানিয়েছে, বেশিরভাগ রোহিঙ্গা নারীরা বিদেশ পাড়ি দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে মালয়েশিয়া তাদের পছন্দের প্রথম গন্তব্য। উখিয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নারীদের নিয়ে কাজ করে নারী জাগরণ সংস্থা। এই সংস্থার প্রধান নির্বাহী শিউলি শর্মা বলেন, রোহিঙ্গা নারীদের অনেকেই মালয়েশিয়া গিয়ে বিয়ে করার স্বপ্নে বিভোর। তারা মনে করে যে, মালয়েশিয়া যেতে পারলে তাদের ভালো বিয়ে হবে। এ ধারণা তাদের ঢুকিয়ে দিয়েছে মানবপাচারকারী সিন্ডিকেট। ফলে তাদের অনেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সমুদ্র পথে মালয়েশিয়া যেতে আগ্রহী।

অপর একটি সূত্র জানায়, রোহিঙ্গা ক্যাম্পকে কেন্দ্র করে এখন মানবপাচারকারীদের তৎপরতাও বেড়েছে। তাছাড়া কিছু রোহিঙ্গা আছে, যাদের স্বজন মালয়েশিয়ায় অবস্থান করেছ। তারা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বসবাসরত স্বজনদের মালয়েশিয়া নেওয়ার জন্য যোগাযোগ করে। এক্ষেত্রেও মানবপাচারকারীরা সহায়তা করছে।

শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. আবুল কালাম জানান, একসঙ্গে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। নানা কৌশলে ক্যাম্প থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করছে রোহিঙ্গারা। এমন অনেকে বেরও হয়ে যাচ্ছে। রোহিঙ্গারা যাতে ক্যাম্প থেকে বের হতে না পারে এ জন্য সাধ্যমত প্রচেষ্টা রয়েছে। পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট সবাই সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করছেন। ক্যাম্প থেকে রোহিঙ্গাদের বের হওয়ার বিষয়টি কঠোরভাবে তদারকি করা হচ্ছে।

কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেন বলেন, “রোহিঙ্গারা নিরাপত্তা বাহিনীর চেকপোস্ট এড়িয়ে পাহাড়-জঙ্গলের ভেতর দিয়ে এলাকা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে।”

“তারা এখন স্থানীয় ভাষা শিখে গেছে। পোশাক স্থানীয়দের মতো পরিধান করছে। এছাড়া অনেকে স্থানীয়দের সঙ্গে করে বা স্থানীয়দের ভিড়ে কৌশলে পালানোর চেষ্টা করছে”, বলেন তিনি।

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইকবাল হোসেন জানান, রোহিঙ্গারা স্বেচ্ছায় পাচার হচ্ছে। যারা স্বেচ্ছায় পালিয়ে যেতে চায় তাদের ধরা কঠিন। আর এর মধ্যে মানবপাচারকারীরা সহযোগিতা করলে আরও কঠিন হয়ে পড়ে।

তিনি বলেন, “সাধারণত চেকপোস্ট বসানো হয়েছে রাস্তায়। রোহিঙ্গারা রাস্তা দিয়ে না গিয়ে পাহাড়, জঙ্গল, খাল-বিল দিয়েও পালিয়ে যেতে পারে। এই ক্ষেত্রে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া প্রয়োজন। রোহিঙ্গা ক্যাম্পকে ঘিরে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করা হলে সেখান থেকে রোহিঙ্গারা সহজে বের হতে পারবে না।”

Comments

The Daily Star  | English

One month of interim govt: Yunus navigating thru high hopes

A month ago, as Bangladesh teetered on the brink of chaos after the downfall of Sheikh Hasina, Nobel Laureate Muhammad Yunus returned home to steer the nation through political turbulences.

8h ago