সন্তান হারানো স্বজনের বন্ধু পুলিশ: একটি দৃষ্টান্ত

কল্পনা করুন একটি পরিবারের কথা যারা ছুটি কাটাতে রাজধানী থেকে বাড়ি ফিরছে। বাবা-মায়ের সঙ্গে বছর পাঁচের ছেলেটি সময়মতোই সায়দাবাদ টার্মিনালে গিয়েছে যাতে বাস ধরতে দেরি না হয়ে যায়।
family reunites
ঢাকার যাত্রাবাড়ী থানায় মায়ের সঙ্গে মিলিত হলো কুমিল্লার মেঘনাঘাটে পাওয়া জানরিয়া জানবির। ছবি: সংগৃহীত

কল্পনা করুন একটি পরিবারের কথা যারা ছুটি কাটাতে রাজধানী থেকে বাড়ি ফিরছে। বাবা-মায়ের সঙ্গে বছর পাঁচের ছেলেটি সময়মতোই সায়দাবাদ টার্মিনালে গিয়েছে যাতে বাস ধরতে দেরি না হয়ে যায়।

ছেলেটি খিদে পাওয়ার কথা বলায়, রাস্তার উল্টোপাশের একটি খাবারের দোকানের দিকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় তারা। কিন্তু, ফুটপাত থেকে রাস্তা-লোকে লোকারণ্য সব জায়গা। যত্রতত্র বেপরোয়া যানবাহন, পথচারী, ফুটপাতের দোকানদার, মালপত্রসহ ঘরমুখো বাসযাত্রীদের ভিড়ের মধ্যে মা বুঝতে পারেন একটা সমস্যা হয়েছে। তার হাতে আর ছেলের হাত নেই। ভিড় ঠেলতে গিয়ে কোথাও হারিয়ে গেছে সে। সঙ্গে সঙ্গে খোঁজ শুরু করেও তার সন্ধান পাওয়া যায় না।

অন্যদিকে রাস্তার এক কোণায় দাঁড়িয়ে অপরিচিত মুখের ভিড়ে কাঁদতে শুরু করে ছেলেটি। সৌভাগ্যবশত পাশের এক চায়ের দোকানি ছেলেটিকে দেখতে পেয়ে পাশেই যাত্রাবাড়ী থানায় নিয়ে যায়।

কল্পনা করতে বলা হলেও, বাস্তবে অনেকটা এরকময়ই ঘটেছিলো যাত্রাবাড়ী বাস টার্মিনালে। ওই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কাজী ওয়াজেদ আলী জানান, শিশুটিকে থানায় আনার কিছুক্ষণের মধ্যেই তার বাবা-মাকে খুঁজে বের করেছিলো পুলিশ। ছেলেটিকে যেখানে পাওয়া গিয়েছিলো সেখানে সঙ্গে সঙ্গে মাইকিং করে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিলো। ছেলেটির বাবা খুব দ্রুত চলে আসেন থানায়।

তিনি জানান, শুধুমাত্র যাত্রাবাড়ী এলাকা থেকেই প্রতি মাসে গড়ে পাঁচ থেকে ছয়টি শিশু হারিয়ে যাওয়ার তথ্য আসে তাদের কাছে। হয় অন্য লোকজন এই শিশুগুলোকে থানায় নিয়ে আসেন অথবা বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে হারিয়ে যাওয়া শিশুদের উদ্ধার করা হয়।

“ভিড়ের মধ্যে শিশুদের হারিয়ে যাওয়া খুবই সাধারণ একটি ঘটনা। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, শিশু পাচারকারীরাও এরকমই একটি সুযোগের জন্য বসে থাকে,” বলছিলেন যাত্রাবাড়ী থানার ওসি। এরকম পরিস্থিতিতে করণীয় সম্পর্কে যাত্রাবাড়ী এলাকার লোকজনের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে কাজ করেছে পুলিশ, যোগ করেন তিনি।

মায়ের কোলে বাচ্চাকে ফিরিয়ে দেওয়া নিশ্চিত করতে এ বছরই যাত্রাবাড়ী থানায় নারী ও শিশুবান্ধব একটি ডেস্ক চালু করা হয়েছে। নারী অফিসার ও নারী কনস্টেবলদের এই ডেস্কের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। চালু হওয়ার পর থেকেই এই ডেস্কে দায়িত্ব পালন করছেন উপ-পরিদর্শক (এসআই) লাইজু।

তিনি বলছিলেন, “বাচ্চাকে তার পরিবারের কাছে ফিরতে দেখে ভীষণ আনন্দ লাগে। মেয়েদের বিভিন্ন অভিযোগের ব্যাপারেও আমরা তৎপর থাকি।”

কিন্তু, মাঝে-মধ্যে যে বিপত্তি তৈরি হয় না সেরকমও না।

এসআই লাইজু জানান, গত ১৯ মে যাত্রাবাড়ী এলাকায় এক দোকানদার চার বছর বয়সী একটি বাচ্চাকে তার দোকানের পাশে একা দাঁড়িয়ে কাঁদতে দেখেন। শিশুটিকে থানায় নিয়ে আসা হলেও সে তেমন কিছুই বলতে পারছিলো না। দোকানদার তাদেরকে বলেন, এক নারী ওই শিশুটিকে সেখানে ফেলে গিয়েছিলো।

“এ রকম ক্ষেত্রে ধৈর্য ধরে শিশুটিকে শান্ত করার চেষ্টা করি আমরা। শিশুরা অনেক সময় ভয়ের মধ্যে থাকায় থানায় তাদের জন্য বিভিন্ন খেলনা ও চকলেট এনে রেখেছি আমরা। বাচ্চাটি অসুস্থ থাকায় প্রয়োজনীয় চিকিৎসারও ব্যবস্থা করা হয় থানা থেকেই।”

এরকম ক্ষেত্রে শিশুদের বাবা-মাকে খুঁজে বের করতে পুলিশ যে পথ অনুসরণ করে সে সম্পর্কে বলতে গিয়ে ওসি ওয়াজেদ আলী বলেন, “বিভিন্ন উপায়ে আমরা অভিযান চালাই। প্রথমে শিশুর বাবা-মাকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হয়। এরপর অন্যান্য থানায় খবর পাঠানো হয়। এতে কাজ না হলে, বিভিন্ন ফেসবুক গ্রুপে তথ্য দিয়ে দু-একদিন অপেক্ষা করা হয়।”

“এরপরও সমাধান করা না গেলে, শিশুদেরকে তেজগাঁওয়ে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে হস্তান্তর করা হয়। বাবা-মাকে খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত তাদেরকে ওখানেই রাখা হয়। চার বছরের শিশুটিও এখন সেখানে রয়েছে। পুলিশের চেষ্টাও অব্যাহত রয়েছে,” যোগ করেন তিনি।

ঢাকা মহানগর পুলিশের উইমেন সাপোর্ট এন্ড ইনভেস্টিগেশন (ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার) বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার লুবান মোস্তফা বলেন, প্রতি মাসে নগরীর বিভিন্ন থানার পুলিশ তাদের সেন্টারে ১৫-২০টি শিশুকে নিয়ে আসে। এখান থেকে বিভিন্ন থানায় যোগাযোগ রেখে শিশুদের বাবা-মায়ের খোঁজ করা হয়। এছাড়া বিভিন্ন ফেসবুক গ্রুপ ও ডিএমপির নিউজ পোর্টালে তাদের ব্যাপারে তথ্য দেওয়া হয়। এতেও না হলে, আদালতের মাধ্যমে তাদের বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে পাঠানো হয়।

এতে সময় লাগলেও তারা কখনো আশা ছাড়েন না বলেই জানান ডিএমপির এই নারী কর্মকর্তা।

গত ১৯ এপ্রিল ১০ বছরের এক শিশু রাজধানীর দয়াগঞ্জ বটতলা এলাকায় নিখোঁজ হয়। শিশুটি তার বাবার সঙ্গে জামালপুর থকে ঢাকায় আসছিলো। ভয়ে কাঁপতে থাকা শিশুটি শুধু বলছিলো তাদের বাড়ি জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলায়। সঙ্গে সঙ্গে জামালপুরের পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শিশুটির খোঁজ বের করতে বলে দেওয়া হয়। এর মধ্যেই শিশুটিকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়, ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে। পঁচিশ দিন পর শিশুটির বাবা মজিবুর রহমান তার মেয়ের খোঁজে থানায় আসেন।

মজিবুর দ্য ডেইলি স্টারকে টেলিফোনে বলেন, “ময়নাকে (মেয়ে) পাওয়ার পরের আনন্দ ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। খাবার কেনার জন্য আমরা বাস থেকে নেমেছিলাম। কিন্তু কী যে হলো, ভিড়ের মধ্যে মেয়েকে হারিয়ে ফেলি। সব জায়গায় খুঁজেও তার সন্ধান পাইনি।”

মজিবুর যখন কথা বলছিলেন তখন তার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন ময়না।

বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে ময়নার বাবা আরো বলেন, “পুলিশ যে সাহায্য করেছে তার জন্য সত্যিই আমি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। আমরা তো প্রায় আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম। কিন্তু, তারা (পুলিশ) আশা ছাড়েননি। তারা তাকে নিরাপদে আগলে রেখেছিলেন।”

(সংক্ষেপিত, পুরো প্রতিবেদন পড়তে ক্লিক করুন
Reuniting Families এই লিংকে)

Comments

The Daily Star  | English

One month of interim govt: Yunus navigating thru high hopes

A month ago, as Bangladesh teetered on the brink of chaos after the downfall of Sheikh Hasina, Nobel Laureate Muhammad Yunus returned home to steer the nation through political turbulences.

10h ago