বিচিত্র বাজেট চিত্র
বাজেট এক জটিল অঙ্কের খেলা। যা অধিকাংশ মানুষ বোঝেন না, বা ধরে নেন বুঝবেন না। শুধু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে নয়, পৃথিবীর উন্নত দেশের মানুষের ক্ষেত্রেও এ কথা প্রায় সমভাবে প্রযোজ্য। তারপরও অনিবার্য বাস্তবতা, প্রতিবছর নিয়ম করে বাজেট আসে। দেশের মানুষের শঙ্কা বাড়ে। আয় বাড়লো না, বাজেটের পর ব্যয় তো বেড়ে যাবে! এই দুশ্চিন্তায় আক্রান্ত হওয়ার আগে হাতে আরও কয়েক ঘণ্টা সময় আছে। সেই সুযোগে জেনে নেওয়ার চেষ্টা করি, দেশে বা বিদেশে বাজেটের রীতি, কিছু চিত্র- যা হয়ত কোনো কোনো ক্ষেত্র বেশ বিচিত্র।
অ্যালকোহল আর হালুয়া উৎসব
ব্রিটেনে বাজেট পেশ করেন “চ্যান্সেলর অফ এক্সচেকার”। যেহেতু বাজেট বক্তৃতা দীর্ঘসময় নিতে পারে তাই চাইলে চ্যান্সেলর সঙ্গে অ্যালকোহল রাখতে পারেন। শুধুমাত্র এই একটি দিনই চ্যান্সেলর তার বক্তৃতার সময় সুরায় চুমুক দিতে পারেন। কেনেথ ক্লার্ক ১৯৯৩-৯৭ সালে যখন চ্যান্সেলর ছিলেন তখন তিনি সর্বশেষ এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছিলেন। তিনি হুইস্কি পান করতেন। উইন্সটন চার্চিল ব্রান্ডি, হিউ ডাল্টনের পছন্দ ছিল দুধ আর রাম, হিউ গেইটস্কেলের পছন্দ ছিল কমলার জুস আর রাম। অবশ্য সাম্প্রতিক সময়ে সবাই বিশুদ্ধ পানির উপরই ভরসা রাখছেন।
প্রতিবেশী ভারতে বাজেট ছাপা হওয়ার কাজ শুরু হয় হালুয়া উৎসবের মাধ্যমে। দিল্লীর নর্থ ব্লকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অফিসে অর্থমন্ত্রী নিজে হালুয়া উৎসব উদ্বোধন করেন। বাজেট পেশের সাত থেকে দশদিন আগে এই উৎসব হয়। মন্ত্রণালয়ের প্রায় ১০০ কর্মকর্তা হালুয়া খেয়ে বাজেট মুদ্রণের কাজ শুরু করেন। অর্থমন্ত্রী নিজে সবাইকে হালুয়া খাওয়ান।
বাংলাদেশে যেদিন বাজেট পাশ হয় সেদিন অর্থমন্ত্রী একটা ডিনারের আয়োজন করেন যেখানে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার গণ্যমান্য ব্যক্তিরা উপস্থিত থাকেন। আর বাজেটের দিন অর্থমন্ত্রীকে আমরা চা এবং পানি পান করতে দেখি। তবে বাজেট পেশের দিন কোনো কোনো সংবাদপত্র অফিসে একধরণের উৎসব হয়। পত্রিকা অফিসের পক্ষ থেকে সকল কর্মীদের জন্য ডিনারের ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে।
গোপন কুঠুরি
বাজেটের তথ্য গোপন রাখাটাই রীতি। কারণ বাজেটের তথ্য আগে ফাঁস হয়ে গেলে অসাধু ব্যবসায়ীরা এর সুযোগ নিতে পারেন। তাই বাজেট প্রণয়ন এবং প্রকাশে বেশ গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়।
ভারতে বাজেট মুদ্রণ শুরু হওয়ার পর থেকে, সেই কাজে যুক্ত কর্মীদের নর্থব্লকেই থাকার বন্দোবস্ত করা হয়। নর্থ ব্লকের বেইজমেন্টে সকলকে থাকতে হয় যতক্ষণ পর্যন্ত না অর্থমন্ত্রী বাজেট পেশ করছেন।
মুদ্রণ কাজের সঙ্গে জড়িত সবাইকে একটা নির্দিষ্ট ফোন নাম্বারের মাধ্যমে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে দেওয়া হয়, তাও সীমিত আকারে। সেখানেই তাদের খাবার সরবরাহ করা হয়। চিকিৎসককেও সেখানেই রাখা হয়।
এতো গেলো ভারতে, এবার আসুন দেখি ব্রিটেনের অবস্থা কি?
১৯৪৭ সালে এডওয়ার্ড জন ডালটন তখনও তিনি বাজেট বক্তৃতা শেষ করেননি, তার আগেই দ্য স্টার পত্রিকার সন্ধ্যাকালীন সংস্করণে বাজেট হুবহু ছাপা হয়ে মানুষের হাতে চলে যায়। বাজেট ফাঁস হওয়ার এই দায় নিয়ে পদত্যাগ করেছিলেন ডালটন।
১৯৯৬ সালে কেনেথ ক্লার্কের বাজেট আগেই ফাঁস হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ডেইলি মিরর বাজেট আগাম পেয়েও প্রকাশ না করে নৈতিকতার কথাটি মাথায় রেখে অর্থ মন্ত্রণালয়ে ফেরত পাঠিয়ে দেন।
১৯৮৬ সালে নিউজিল্যান্ডর অর্থমন্ত্রী স্যার রজার ডগলাস পদত্যাগ করার ঘোষণা দেন, কারণ তার অফিসের কর্মচারীরা ভুলবশত বাজেট ডকুমেন্ট সময়ের আগে বিভিন্ন অফিসে পাঠিয়ে দেন।
নিউজিল্যান্ডে বাজেট পেশ করা হয় মে মাসে। সকাল ১০টা ৩০ মিনিটে ২০০ জনের অধিক সাংবাদিক, গবেষক ও অর্থনীতিবিদকে একটি ব্যাঙ্কুয়েট হলে ঢোকানো হয়। দুইটার সময় বাজেট অনুষ্ঠানিকভাবে পেশ করা হয়, তার আগ পর্যন্ত সাংবাদিকরা বাজেট ডকুমেন্ট থেকে সংবাদের হেডলাইন তৈরি করা ছাড়া আর কিছুই করতে পারেন না। এমনকি এই সময় তাদের হাতে কোন মুঠোফোনও থাকে না।
ভুলোমন
১৮৬৯ সালে জর্জ ওয়ান্ট হান্ট হাউস অব কমন্স-এ বাজেট বক্তৃতা শুরু করার সময় বাজেট বাক্স খুলে দেখেন বক্তৃতার কপি বাসায় রেখে এসেছেন!
রাষ্ট্রপ্রধানদের বাজেট পেশ
বাজেট সাধারণত অর্থমন্ত্রী বা অর্থ উপদেষ্টারা সংসদে পেশ করেন। কিন্তু ব্যতিক্রমও আছে। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান সামরিক শাসক হিসাবে তিনটি বাজেট উপস্থাপন করেন।
ভারতে জওহরলাল নেহরু, ইন্দিরা গান্ধী ও রাজীব গান্ধী হলেন তিন প্রধানমন্ত্রী, যারা সংসদে দাঁড়িয়ে নিজেরা বাজেট পেশ করেছেন। এই উদাহরণ ভারতীয় সংসদীয় ইতিহাসে আর নেই।
বাজেটে উদ্ধৃতি
অর্থমন্ত্রীরা সাধারণত বাজেট বক্তৃতার সময় বিখ্যাত ব্যক্তির উক্তি তুল ধরেন।
মনমোহন সিং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং ভিক্টর হুগোকে পছন্দ করতেন। জেটলি এবং পি চিদাম্বরম যথাক্রমে বিবেকানন্দ এবং থিরুভাল্লুভারকে পছন্দ করতেন। আর প্রণব মুখোপাধ্যায় পছন্দ করতেন কৌটিল্য এবং শেক্সপিয়রের উক্তি।
একই উদ্ধৃতি দুইজন অর্থমন্ত্রীর ব্যবহার বিরল। তেমনটিই ঘটেছে বাংলাদেশে। ১৯৮০-৮১ অর্থবছরের বাজেটে এম সাইফুর রহমান বক্তব্য শেষ করেছিলেন এভাবে— “পৃথিবীর একটি সুপ্রাচীন দেশের একটি বিজ্ঞ উক্তির কথা মনে পড়ে, ‘হাজার মাইলের যাত্রা শুরু হয় একটি পদক্ষেপ দিয়েই।’ আসুন আমরা সমবেত হয়ে সেই একটি পদক্ষেপ নেই।”
১৯৯৭-৯৮ অর্থবছরের বাজেট বক্তব্যের শেষে অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া বলেছিলেন, “চীনা ভাষায় একটি প্রবাদে যথার্থই বলা হয়েছে, ‘হাজার মাইলের ভ্রমণ শুরু হয় একটি ক্ষুদ্র পদক্ষেপের মাধ্যমেই।’ আমাদের গন্তব্য যত দুর্গমই হোক না কেন আমরা চলতে শুরু করেছি।”
কোন দেশে কখন বাজেট
দেশ ভেদে বাজেট পেশের সময় ভিন্ন। বাংলাদেশে সাধারণত জুন মাসের প্রথম সপ্তাহ বা প্রথম বৃহস্পতিবার বাজেট পেশ হয়। এবার ব্যতিক্রম ঈদের ছুটির কারণে, তবে বৃহস্পতিবার দিন ঠিক আছে।
ভারতে ২০০০ সাল পর্যন্ত বাজেট পেশ হতো বিকেল ৫টায়, ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ কর্মদিবসে। ২০০১ সালে তা বদলে দেন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী যশবন্ত সিনহা। তিনি সকাল ১১টায় বাজেট পেশ করেন। গত কয়েক বছর ধরে ফেব্রুয়ারির প্রথম দিনে বাজেট পেশ হচ্ছে।
চীন, ব্রাজিল, সংযুক্ত আরব আমিরাত, স্পেনে অর্থবছর শুরু হয় ১ জানুয়ারি আর শেষ হয় ৩০ ডিসেম্বর। ভারত, ইংল্যান্ড, হংকং, কানাডা এবং দক্ষিণ আফ্রিকায় অর্থবছর শুরু হয় ১ এপ্রিল, শেষ হয় ৩১ মার্চ। যুক্তরাষ্ট্র ও থাইল্যান্ডে অর্থবছর শুরু হয় ১ অক্টোবর, শেষ হয় ৩০ সেপ্টেম্বর।
সিংগাপুরে বাজেট পেশ করা হয় সোমবার। ১৯৬৫ সালের ১৩ অক্টোবর প্রথম বাজেট পেশ করা হয়। সিংগাপুরে বাজেটের পরিকল্পনা শুরু হয় সাত বছর আগে থেকে অর্থাৎ ২০১৯ সালের বাজেটের কাজ শুরু হয়েছিলো ২০১২ সালে।
অস্ট্রেলিয়াতে মে মাসের দ্বিতীয় মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৭:৩০ মিনিটে বাজেট পেশ করা হয়। ১৯৯৪ সাল থেকে এই রীতি চলে আসলেও ১৯৯৬ সালে এর ব্যতিক্রম ঘটে কারণ ঐ বছর নির্বাচনের কারণে।
বাজেট বক্তৃতায় অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা
বাজেট বক্তৃতা দিতে গিয়ে বেশ কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার ইতিহাসও পাওয়া যায় বিশেষ করে ব্রিটেনে। ডেরিক হিথকোট আমেরিকার ১৯৬০ সালে বাজেট ঘোষণার সময় অজ্ঞান হয়ে লুটিয়ে পড়েন মেঝেতে।
১৯০৯ সালে বাজেট বক্তৃতার সাড়ে তিন ঘণ্টা পরে লয়েড জর্জের মুখ দিয়ে আর কোন শব্দ বের হচ্ছিল না। তিনি ৩০ মিনিটের বিরতি দিয়ে বক্তৃতা শুর করেন।
টরি ম্যকলয়েড চ্যান্সেলর হিসেবে নিয়োগ পেলেও বাজেট পেশ করার আগেই মৃত্যুবরণ করেন ১৯৭০ সালে।
স্বাভাবিক চিত্র
সেই পরিবারই সুখী পরিবার, যে পরিবার আয় অনুযায়ী সুষ্ঠু সমন্বয়ের মাধ্যমে সংসার পরিচালনা করেন। আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হলে-অপব্যয় বেশি করলে, এক টাকার জিনিসের পেছনে ছয় টাকা খরচ করলে-সেই টাকা ঋণ করলে, আজ বা কাল কোনো না কোনো প্রক্রিয়ায় জটিলতায় পড়তেই হবে। ব্যক্তি-দেশ কেউ-ই এর বাইরে নয়।
একটি দেশ কতটা গোছানো, পরিকল্পিত, জনবান্ধব তারই প্রতিফলন বাজেট। সেই বাজেট অনুযায়ী চলতে পারার নাম সক্ষমতা। বাজেট অনুযায়ী খরচ করতে পারাটা যোগ্যতা, না পারা অযোগ্যতা।
যেসব দেশের বিচিত্র কিছু রীতি বা চিত্রের উল্লেখ থাকলো এ লেখায়, সেসব দেশের ব্যয় ও আয়ের সামর্থ্যের চিত্র কিন্তু স্বাভাবিকই থাকে। জাতি রাষ্ট্র বাংলাদেশের সেই স্বাভাবিক চিত্রের দিকে হাঁটা শিখতে হবে।
Comments