বিদেশমুখী রোগীদের ফেরানোর মিশন নিয়ে বাংলাদেশে এসেছি: দেবী শেঠি
সদা হাস্যোজ্জ্বল দেবী শেঠিকে দেখে প্রথম দর্শনেই ভালো লেগে যায়। চোখের সামনে উপমহাদেশের হৃদরোগ চিকিৎসার জীবন্ত কিংবদন্তী! তিনিই প্রথম এই অঞ্চলে নবজাতকের হার্টের অপারেশন শুরু করেন। দেখলাম তাঁকে নিয়ে মানুষের সে কি উচ্ছ্বাস!
গত শনিবার তিনি চট্টগ্রামে আসেন একটি হাসপাতালের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। অনুষ্ঠানের অব্যবহিত পরেই ডা. শেঠি বসেন সাংবাদিকদের সঙ্গে। মাত্র ১৫ মিনিটের আলাপচারিতায় তিনি কি চমৎকারভাবেই না বলে গেলেন হৃদরোগ নিয়ে এই অঞ্চলের মানুষের উদ্বেগ এবং তা নিরসনের উপায় সম্পর্কে। সেই আলোচনায় উঠে এলো ইউরোপ-আমেরিকার তুলনায় এই অঞ্চলের মানুষের হৃদরোগের ধরনের পার্থক্যের বিষয়টিও।
ডা. শেঠি বলেন, ইউরোপ-আমেরিকায় বেশিরভাগ হৃদরোগী পঁয়ষট্টিঊর্ধ্ব কিন্তু এই অঞ্চলে তরুণ-যুবকদের মধ্যে হৃদরোগের প্রবণতা বেশি। সেখানে ছেলে-মেয়েরা তাদের বাবা-মাকে হাসপাতালে নিয়ে যায় হৃদরোগের চিকিৎসা করানোর জন্য। আর এখানে ঘটে উল্টোটা।
তিনি বলেন, জিনগত কারণে এই অঞ্চলের মানুষের হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি ইউরোপ-আমেরিকার মানুষের তুলনায় তিনগুণ বেশি। তাছাড়া অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, ব্যায়াম ও কায়িক শ্রমবিমুখতাও প্রধান কারণগুলোর অন্যতম।
আরেকটা প্রধান কারণ হলো এই অঞ্চলের মানুষ কেবল অসুস্থ হলেই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। দেবী শেঠি বলেন, ইউরোপ-আমেরিকায় এই চর্চাটা আছে যে মানুষ নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করান। ফলে তারা রোগাক্রান্ত হওয়ার আগেই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে পারেন। তিনি বলেন, মানুষের উচিত প্রতিবছর না হলেও অন্তত প্রতি দুই বছরে একবার স্বাস্থ্যের কিছু রুটিন পরীক্ষা করানো।
তাঁর মতে, হার্ট অ্যাটাক অনুমানযোগ্য। “আমরা অনেকসময় দেখি যে সুস্থ লোক হঠাৎ হার্ট অ্যাটাকে বা স্ট্রোকে মারা যাচ্ছেন। আসলে তিনি কতটা সুস্থ ছিলেন? তিনি যদি রুটিন পরীক্ষাগুলো করতেন, যেমন-ইসিজি, ইকোকার্ডিওগ্রাম অন্তত বছরে একবার বা দুই বছরে একবার, রক্তে শর্করা এবং লিপিডের পরিমাণ যদি পরীক্ষা করে দেখতেন, তাহলে অবশ্যই চিকিৎসকেরা এই ব্যাপারে তাঁকে সতর্ক করতে পারতেন এবং প্রতিরোধমূলক চিকিৎসা দিতে পারতেন।
ডা. শেঠিকে জিজ্ঞেস করলাম, হার্টের চিকিৎসা তো বেশ ব্যয়বহুল। গরিব রোগীদের পক্ষে এই সুযোগ গ্রহণ করা কতটা সম্ভব? তিনি বললেন, হৃদরোগের চিকিৎসা আগের তুলনায় এখন অনেক সাশ্রয়ী। “বিশ বছর আগে হৃদরোগে অপারেশনের জন্য ভারতে একজন রোগীর গড় খরচ পড়ত দেড় লক্ষ রুপি। এখন তা কমে হয়েছে এক লক্ষ রুপি।”
জানতে চাইলাম তিনি যেমন কর্নাটক সরকারের সঙ্গে যৌথভাবে গরিব রোগীদের চিকিৎসার জন্য নামমাত্র প্রিমিয়ামে স্বাস্থ্যবিমা চালু করেছেন, সেরকম বিমা বাংলাদেশেও চালু করা যায় কিনা। তিনি বললেন, অবশ্যই করা যায়।
“আমাদের ওখানে একজন কৃষক প্রতিমাসে মাত্র পাঁচ রুপি প্রিমিয়াম দিয়ে স্বাস্থ্যবিমার সুযোগ গ্রহণ করছেন। কারও হৃদযন্ত্রের অপারেশনের প্রয়োজন হলে তিনি ওই বিমার আওতায় বিনা খরচে চিকিৎসা পান। বাংলাদেশেও গরিবদের জন্য প্রতিমাসে পাঁচ টাকা প্রিমিয়ামে স্বাস্থ্যবিমা চালু করা যায়। এই ব্যাপারে সরকার ও বেসরকারি উদ্যোক্তারা যৌথ উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারেন।”
বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর প্রচুর রোগী ভারতে চিকিৎসার জন্য যাচ্ছেন। এর কারণ কী? জবাবে ডা. শেঠি বলেন, ভারতে একই রকমের অনেকগুলো বিশেষায়িত হাসপাতাল আছে। ফলে রোগীদের সামনে অনেক বিকল্প থাকে। আজকাল রোগীরা যাচাই-বাছাই করতে চান। সেটা যেমন স্বাস্থ্যসেবার মানের বিষয়ে, তেমনি খরচের বিষয়েও। কিন্তু বাংলাদেশে এখনও রোগীদের সামনে পর্যাপ্ত বিকল্প নেই। তবে বাংলাদেশের চিকিৎসকেরা অত্যন্ত মানসম্পন্ন। তাই রোগীদের বিদেশে যাওয়ার প্রয়োজন নেই।
তিনি বলেন, ভারত এবং বাংলাদেশে চিকিৎসাপদ্ধতি একইরকম। যেটুকু পার্থক্য, তা হলো, ভারতে রোগীদের সামনে অনেক বিকল্প থাকার ব্যাপারটি। বাংলাদেশেও সম্প্রতি অনেক হাসপাতাল হচ্ছে। “আমি বাংলাদেশে এসেছি একটিমাত্র মিশন নিয়ে। তা হলো, আমি চাই এখানকার কোনো রোগীকে যেন ভারতে বা অন্য কোনো দেশে চিকিৎসার জন্য যেতে না হয়।”
শেঠি বলেন, চিকিৎসকদের রোগীদের প্রতি এবং নিজের পেশার প্রতি নিবেদিতপ্রাণ হতে হবে। ভালো চিকিৎসক হতে হলে তিনটা জিনিস জরুরি—রোগী, নিবেদিতপ্রাণ আর ত্যাগের মানসিকতা। বিশ্বব্যাপী সেরা চিকিৎসকেরা, যারা নিজেদের জাদুকরী আঙ্গুলের সাহায্যে সেবা দিয়ে রোগীদের কাছে স্মরণীয় হয়ে আছেন, তাঁদের বেশিরভাগই দরিদ্র পরিবার থেকে এসেছেন।
দেখতে দেখতে সময় ফুরিয়ে এলো। ডা. শেঠি চলে যাবেন ফ্লাইট ধরতে। অনেক জরুরি কাজ রেখে ছুটে এসেছেন তিনি চট্টগ্রামে খানিকটা সময়ের জন্য। এই দেশের রোগীদেরকে ভরসা দেওয়ার জন্য।
Comments