‘কেউই হয়তো ভাবেন না যে তিনি মারা যাবেন’
‘মৃত্যু নিয়ে ভাবনা আমার মনে হয় সবারই হয়। কিন্তু, কেউই বোধ হয় ভাবেন না যে তিনি মারা যাবেন’- কথাটা কয়েক বছর আগে ‘সাপ্তাহিক’র সঙ্গে দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন তিনি। পেশায় প্রকৌশলী বা বুয়েটের অধ্যাপক হিসেবে নয়, পরিচিতি পেয়েছিলেন ‘আবাসন’ ব্যবসায়ী ‘নগর চিন্তক-গবেষক-পরিকল্পক’ হিসেবে। আবাসন ব্যবসাও যে সততা-ন্যায্যতার সঙ্গে করা যায়, মানুষকে না ঠকিয়ে করা যায়, তারও অন্যতম দৃষ্টান্ত তিনি।
বলছি তৌফিক এম. সেরাজের কথা। তিনি ‘ছিলেন’ আবাসন খাতে অন্যতম সুনামের অধিকারী ব্যবসা প্রতিষ্ঠান শেলটেক’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক। ‘ছিলেন’ লিখতে বাধ্য হচ্ছি, কারণ শারীরিকভাবে তিনি আর নেই। যাচ্ছিলেন ঢাকা থেকে বার্সেলোনা, দোহা হয়ে। উড়োজাহাজ দোহার মাটি স্পর্শ করার কয়েক মিনিট আগেই সম্ভবত তিনি সবকিছু ছেড়ে চলে গেছেন। উড়োজাহাজের ল্যাভাটরিতে (ওয়াশরুম) অচেতন অবস্থায় পাওয়া যায় তাকে।
নিজের মৃত্যুর কথা ভাবতে পেরেছিলেন তৌফিক এম. সেরাজ? পেয়েছিলেন সেই সময়? হয়ত তিনি স্বস্তিবোধ করছিলেন না। সেকারণেই হয়ত ল্যাভাটরিতে গিয়েছিলেন। জানি না, সবই অনুমান। সঠিক করে বলতে পারছেন না সঙ্গী-বন্ধু পোশাকশিল্প ব্যবসায়ী কুতুবউদ্দিন আহমদও। তারা একই সঙ্গে বার্সেলোনা যাচ্ছিলেন। উড়োজাহাজে কয়েক আসন দূরত্বে বসেছিলেন দুই বন্ধু। উড়োজাহাজ অবতরণের আগে ঘুম ভাঙ্গে কুতুবউদ্দিন আহমদের। দেখেন আসনে তৌফিক এম.সেরাজ নেই।অবতরণের মুহূর্তে যা স্বাভাবিক নয়। এয়ার হোস্টেসদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে, তারা ল্যাভাটরিতে সন্ধান পান অচেতন তৌফিক এম. সেরাজের।
তৌফিক এম. সেরাজ ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী হিসেবে গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুল থেকে এসএসসি পাশ করেন। ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করে ভর্তি হন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট)। ১৯৮২ সালে মাস্টার্স শেষ করে বুয়েটে প্রভাষক হিসেবে শিক্ষকতা জীবন শুরু করেন। ১৯৮৩ সালে কমনওয়েলথ বৃত্তি নিয়ে ইংল্যান্ডের লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যান পিএইচডি করার জন্যে। ১৯৮৭ সালে দেশে ফিরে আবার বুয়েটে শিক্ষকতা শুরু করেন।
পরিবারের কাউকে না জানিয়ে ১৯৮৮ সালে বুয়েট থেকে পদত্যাগ করেন। জানালে পরিবারের কোনো সদস্যই পদত্যাগে সম্মতি দিতেন না। এমনকী, বুয়েটও সেই সময় তাকে ছাড়তে চায়নি।
তারপরও তিনি ছেড়ে দিয়েছেন। সব সময়ই একটি বড় প্রশ্ন হিসেবে সামনে আসে, বুয়েটের এমন সম্মানজনক শিক্ষকতা পেশা ছেড়ে দিলেন কেনো? প্রশ্নটি যতো গুরুত্ব দিয়ে সামনে আসে, তিনি নিজে কখনো বিষয়টিকে অতো গুরুত্বপূর্ণ মনে করেননি। একই গণ্ডি, প্রতিদিন একই রকম কাজ তিনি করতে চাননি। শিক্ষকতা পেশার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা রেখেই তিনি একথা বলেছেন।
চ্যালেঞ্জিং কাজের মধ্যে নিজেকে জড়াতে চেয়েছেন। প্রাইভেট সেক্টরে নিজে কিছু একটা করতে চেয়েছিলেন।
তার পিএইচডি থিসিসের বিষয় ছিল ‘বিকেন্দ্রীকরণ: ছোট শহরের ভূমিকা’। নগর চিন্তা-পরিকল্পনার বিষয়টি মননে গেঁথে গিয়েছিলো।
নিজের পড়াশোনার জ্ঞানকে বাস্তবে কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন তিনি। শিক্ষকতা পেশার মাধ্যমে একাডেমিকভাবে শিক্ষার্থীদের শেখানোর চেয়েও তার কাছে বাস্তব প্রয়োগের ক্ষেত্রে কাজ করা বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছিলো। বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় নীতি-নির্ধারণকে প্রভাবিত করতে চেয়েছিলেন তৌফিক এম. সেরাজ। পিএইচডি করে আসার পর স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে তার থিসিস পেপার বই আকারে প্রকাশ করা হয়। থিসিসে দেখানো বিকেন্দ্রীকরণের পদ্ধতির কিছু প্রয়োগও শুরু হয়েছিলো। উপজেলা পদ্ধতি প্রবর্তনের ক্ষেত্রে তার গবেষণা অনুসরণ করা হয়েছিলো। তার নিজের কথায় ‘‘ঢাকায় জনসংখ্যার বাড়তি চাপ আছড়ে পড়তে লাগল। ১৯৮০ সালের আগেই ‘অপরিকল্পিত বিকাশের’ পথে হাঁটা শুরু করলো ঢাকা। আমার পিএইচডির বিষয়বস্তু ছিলো এই সময়ের পটভূমি ও এর সমাধান। গবেষণা করে দেখিয়েছিলাম যে, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছোট-ছোট শহরের বিকাশই পারে আবাসন সংকটের সমাধান দিতে। এতে বড় শহরগুলোর জনসংখ্যাই কেবল নিয়ন্ত্রণে থাকবে না, পাশাপাশি এই ব্যবস্থা সমগ্র দেশের তথা বিভিন্ন অঞ্চলের সুষম বিকাশও নিশ্চিত করতে সক্ষম। মানুষ যেনো নিজের এলাকায় বা তার খুব কাছেই সুযোগ-সুবিধাগুলো পেতে পারেন। তাকে যেনো চিকিৎসা, শিক্ষা বা রোজকার কোনো দরকারে রাজধানীর দিকে ছুটতে না হয়। আমি তখনকার বাস্তব সংকটে সমাধানটাই থিসিসে পেশ করেছিলাম। তখন থেকে পরিকল্পনামাফিক এরকম ছোট শহর গড়ে তুলতে পারলে এতোদিনে সেগুলোও মাঝারি আকারের শহর হয়ে যেতো। আজ ঢাকার ওপর এরকম চাপ পড়তো না।” (সাপ্তাহিক, ৯ আগস্ট ২০১২)
প্রতিনিয়তই তিনি নগর নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করেছেন, বই লিখেছেন। তার লেখা গুরুত্বপূর্ণ বইগুলোর মধ্যে ‘নাগরিক সমস্যা ও নগর পরিকল্পনা’, ‘রিয়েল এস্টেট ডেভেলপমেন্ট’, ‘সিলেকটেড আর্টিকেলস অন প্লানিং এন্ড হাউজিং’ এবং ‘প্রাইভেট সেক্টর হাউজিং’।
নিজের একাডেমিক জ্ঞানের বাস্তব প্রয়োগের ক্ষেত্র ও জীবন-জীবিকা, অর্থনৈতিক সচ্ছলতা বিবেচনায় তিনি আবাসনখাতকে ব্যবসা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন।
বুয়েটের শিক্ষকতা পেশা যে বছর তিনি ছাড়েন, সে বছরই গড়ে তোলেন শেলটেক। তার মানে পরিকল্পনাটা আগে থেকেই মাথায় ছিলো। আবাসন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পুঁজি নিয়ে এগিয়ে এসেছিলেন বন্ধু কুতুবউদ্দিন আহমেদ, স্কয়ার গ্রুপের স্যামুয়েল এইচ চৌধুরী এবং তপন চৌধুরী। চারজনের অংশীদারিতে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে তৌফিক এম সেরাজ গড়ে তুললেন ‘শেলটেক (প্রা) লিমিটেড’।
স্কয়ার গ্রুপের অন্যান্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান অনেক বড় হয়ে যাওয়ায় ২০০৮ সালে স্যামুয়েল এইচ চৌধুরী এবং তপন চৌধুরী শেলটেক থেকে বেড়িয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তাদের ব্যক্তিগত সুসম্পর্ক অক্ষুণ্ণ থাকে। শেলটেক শুরু থেকেই এককভাবে পরিচালনা করেছেন তৌফিক এম. সেরাজ। পরিণত করেছেন বৃহৎ কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানে। কর্মজীবনে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন বৃহৎ আকারের এলজিইডির স্বপ্নদ্রষ্টা ইঞ্জিনিয়ার কামরুল ইসলাম সিদ্দিকীর দ্বারা। নিজের কর্মক্ষেত্রকেও বিস্তৃত-বৈচিত্র্যপূর্ণ করে গড়ে তোলার প্রাণান্তকর চেষ্টা ছিলো দৃশ্যমান।
প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় তার কাছে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল ‘পেশাদারিত্ব’। তিনি বিশ্বাস করতেন- পেশাদারিত্বই সবকিছু, পেশাদারিত্ব সেখানেই আছে- যেখানে আছে স্বচ্ছতা, দায়িত্বশীলতা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের কর্তৃত্ব।
তিনি বলতেন, প্রথম দুটো সবাই বোঝেন। কিন্তু, কর্তৃত্বের প্রশ্নটি আমাদের এখানে পরিষ্কার নয়। প্রতিষ্ঠানগুলোয় কর্মকর্তাদের অথরিটি দেওয়া হয় না। প্রতিষ্ঠান হয়ে যায় একজন সর্বস্ব। একজনের যতো যোগ্যতাই থাকুক না কেনো, তার দিনও তো নির্দিষ্ট সময় দিয়ে বাঁধা। ফলে ভালো কাজ বেশি করতে চাইলে অনেকের সামর্থ্য-দক্ষতা যুক্ত করার ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা দিতে হবে। দশটি সিদ্ধান্ত নিলে হয়ত একটি ভুল হবে, কিন্তু দেখা যাবে এতেই লাভ। নতুন সংগঠক যেমন পাওয়া যাবে, তেমনি ব্যয়ও কমবে। প্রতিষ্ঠানে কাজের গতি বাড়বে। কর্মীরা চাকরি নয়, প্রতিষ্ঠানকে নিজের মনে করতে শিখবেন।
মেধা-সততা-শ্রম দিয়ে শেলটেকের মতো একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করে নজির রেখে গেছেন তৌফিক এম. সেরাজ। আবাসন ব্যবসায়ীদের প্রতিষ্ঠান ‘রিহ্যাব’ তারই চিন্তার ফসল। পরবর্তীতে আর সেই সুনাম অক্ষুণ্ণ থাকেনি রিহ্যাবের। নিজেকে তিনি সরিয়ে নিয়েছিলেন রিহ্যাব থেকে।
স্ত্রী ড. জেবা সেরাজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়র শিক্ষক। তাদের দুই মেয়ে। তৌফিক এম সেরাজরা তিন ভাই-বোন বুয়েট থেকে পাস করেছেন। মা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বায়োকেমিস্ট্রির অধ্যাপক এবং বাবার শেষ কর্মস্থল ছিলো নদী গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক পদে। বুয়েটের অধ্যাপনা ছেড়ে আবাসন ব্যবসায় যোগদানে, পরিবারের অন্য সদস্যদের মতো বা তার চেয়ে একটু বেশি ব্যথিত হয়েছিলেন তৌফিক এম সেরাজের বাবা। সন্তানের সাফল্যে নিশ্চয় তার সেই বেদনা স্থায়ী হয়নি।
শেলটেক ভবন পান্থপথে, স্কয়ার হাসপাতালের উল্টোদিকে। এই স্কয়ার হাসপাতাল ভবন শেলটেকের একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্মাণ। শুধু নির্মাণে সীমাবদ্ধ নয়, মীরের সরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণের মতো বিশাল প্রকল্পের পরামর্শক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছে শেলটেক। রাজউকের ডিটেল্ড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) প্রণয়নের ক্ষেত্রেও ভূমিকা ছিলো। শেলটেকের সুনাম-সমৃদ্ধি ক্রমবর্ধণশীল। ভবিষ্যতের শেলটেক পরিচালনায় পরবর্তী প্রজন্মকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন। বড় মেয়ে আমেরিকা থেকে পড়াশোনা করে শেলটেকে যোগ দিয়েছেন।
বলেছিলেন, ‘’কাউকে না কাউকে তো দায়িত্ব নিতেই হবে। তাদের হাতেই সবকিছু ছেড়ে দেবো।’’
১৯৫৬ সালে পৃথিবীতে এসেছিলেন, চলে গেলেন কিছুটা অসময়ে। মাত্র ৬৩ বছর বয়সে।
শব্দ করে হাসি দেওয়া এবং কথা বলার মানুষ তৌফিক এম সেরাজ দৃশ্যমানভাবে ছিলেন সুস্বাস্থ্যের অধিকারী।
কর্মচঞ্চল মানুষটি এভাবে চলে গিয়ে, দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ার কথা কী ভেবেছিলেন?
Comments