বগুড়া উপ-নির্বাচন: এখন পর্যন্ত বিরাজ করছে সুষ্ঠু পরিবেশ
রাত পোহালেই বগুড়া-৬ (সদর) আসনের উপ-নির্বাচন। প্রার্থীদের প্রচার-প্রচারণা শেষ হয়েছে গত শুক্রবার সকাল ৯টায়। এই নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীরা বলছেন তারা সবাই সমানভাবে, একটা সুন্দর এবং নিরপেক্ষ পরিবেশে প্রচার-প্রচারণা সম্পন্ন করতে পেরেছেন।
অবাধ নির্বাচনের স্বার্থে সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টির জন্য সরকারের সদিচ্ছাকে প্রায় সব দলের প্রার্থী এবং ভোটাররা সাধুবাদ জানিয়েছেন। তারা বলছেন সরকারের সদিচ্ছা থাকলে এমন পরিবেশ সারা দেশেই যেকোনো নির্বাচনে নিশ্চিত করা সম্ভব।
বিএনপি থেকে শুরু করে প্রায় সব দলের প্রার্থীরা বলছেন, বগুড়ার এই আসনে এবার ভোটের চিত্র সম্পূর্ণ আলাদা। স্থানীয় প্রশাসন এবং পুলিশ নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করেছে এবং সব প্রার্থীকে প্রচার-প্রচারণায় সমানভাবে সহযোগিতা করেছে।
গত ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে, বগুড়ার সাতটি নির্বাচনী এলাকায়, ১২ ডিসেম্বরের থেকে ২২ ডিসেম্বরের মধ্যে নাশকতার অভিযোগে ১২টি মামলা হয়েছিল। বেশিরভাগ মামলার বাদী ছিলেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও পুলিশ। মামলাগুলোয় বিএনপির বহু সক্রিয় নেতা-কর্মীকে আসামি করা হয়েছিল। অনেকেই তখন গ্রেপ্তার এবং হয়রানির শিকার হতে হয়। এমনকি নির্বাচনের দিন গ্রেপ্তার আতঙ্কে ভোট দিতে যাননি বিএনপির অনেক নেতা-কর্মী।
ভোটের দিন সহিংসতায় প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছিল এখানে। ভোটগ্রহণ শেষ হবার পর দেখা গেছে অনেক গরমিল। ঘোষিত ফলাফলে দেখা যায়, তিন আসনের পাঁচটি কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছে। তবে এলাকাগুলোয় গিয়ে জানা যায়, অনেক ভোটার ৩০ ডিসেম্বরের আগেই মারা গেছেন, কেউবা দেশের বাইরে থাকেন, কিংবা জেলের ঘানি টানছেন।
কিন্তু এবারের উপ-নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ এবং সুষ্ঠু হবে বলেই মনে করছেন সব প্রার্থী।
এবার বগুড়া সদর আসনে উপ-নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন মোট সাত জন প্রার্থী। তারা হলেন, আওয়ামী লীগ থেকে টি জামান নিকেতা, বিনপি থেকে গোলাম মোহাম্মদ সিরাজ, জাতীয় পার্টি থেকে নুরুল ইসলাম ওমর, বাংলাদেশ কংগ্রেস থেকে মো. মনসুর রহমান, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ থেকে মো রফিকুল ইসলাম এবং স্বতন্ত্র দুই প্রার্থী হলেন মো. মিনহাজ এবং সৈয়দ কবির আহমেদ। এর মধ্যে সৈয়দ কবির আহমেদ ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে কয়েক দিন আগে সংবাদ সম্মেলন ডেকে প্রচারণা থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেন। তবে নির্বাচন কমিশন বলছে, তার প্রার্থিতা বহাল রয়েছে।
পাশাপাশি এবার প্রথমবারের মতো ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিনে ভোট হবে বগুড়ায়। গত পাঁচ দিন ধরে নির্বাচন কমিশন প্রায় ৪৫ লাখ টাকা খরচ করেছে শুধু ভোটারদের ইভিএম মেশিনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য। বিভিন্নভাবে প্রচারণা ছাড়াও গত শনিবার ১৪১টি ভোট কেন্দ্রেই একটা মহড়া ভোটের আয়োজন করেছে নির্বাচন কমিশন। তবে ভোটারদের তাতে তেমন কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
বিএনপির প্রার্থী গোলাম মোহাম্মদ সিরাজ বলেন, “এবার উপ-নির্বাচনের সমগ্র এলাকায় খুব উৎসব মুখর পরিবেশে সব প্রার্থীই তাদের প্রচারণা চালাতে পেরেছেন। এর পেছনে আসলে সরকারের সদিচ্ছাই প্রধান কারণ। সরকারের সদিচ্ছা থাকলে যেকোনো নির্বাচনই অবাধ এবং সুষ্ঠু হওয়া সম্ভব বলে আমি মনে করি।
গতবারের তুলনায় প্রশাসন এবং পুলিশ এবার অনেকটা নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করেছে বলেই ভোটের প্রচার-প্রচারণা ভালো হয়েছে বলে তিনি জানান।
ইভিএম সম্পর্কে জানতে চাইলে বলেন, “আসলে সরকারের সদিচ্ছা থাকলে ইভিএমেও অবাধ-নিরপেক্ষ নির্বাচন হওয়া সম্ভব। তবে গত দুইটি জাতীয় নির্বাচনে জনগণ তাদের ভোটাধিকার হারিয়ে ফেলেছেন। সরকার যদি ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দেয় এবং ইভিএম মেশিন ভালো কাজ করে তাহলে এই নির্বাচন ভালোই হবে।”
আরেকজন স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. মিনজাহ বলেন, “এবার ভোটের পরিবেশ খুব ভালো মনে হচ্ছে। একটা উৎসবমুখর পরিবেশ আছে। আশা করছি উপ-নির্বাচনে ভোটারদের উপস্থিতি বেশি হবে। প্রশাসন এবং আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এই পর্যন্ত নিরপেক্ষ পরিবেশ তৈরি করেছে। সরকারের সদিচ্ছা ছিল বলেই এটা সম্ভব হয়েছে।”
মো. মিনহাজ আশা করছেন এবারের ভোট শতভাগ সুষ্ঠু হবে।
আর একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী সৈয়দ কবির আহমেদ, তিনি ট্রাক মার্কায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। ভোটের পরিবেশ সম্পর্কে তার মনোভাবও প্রায় একই রকম। তবে আশঙ্কা যে, এবার ভোটার উপস্থিতি অনেক কম হতে পারে।
কবির বলেন, ভোট দিতে যাওয়াকে কেন্দ্র করে ভোটারদের মধ্যে একটা আতঙ্ক কাজ করছে। গত কয়েকটি জাতীয় নির্বাচনে ভোটারদের অভিজ্ঞতা খুব একটা সুখকর নয়। কেন্দ্রে মারামারি, ভোট দিতে না পারা এসব কারণে তারা কিছুটা বিচলিত। তবে এবার নির্বাচন কমিশন শতভাগ সুষ্ঠু ভোটের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে জানা যাচ্ছে, এখানকার অনেক ভোটার ভোট দেওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। বিশেষ করে বিএনপির সমর্থক ভোটাররা। গত ৩০ ডিসেম্বর তারা বিপুল ভোটে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে নির্বাচিত করেছিলেন। কিন্তু ঠিক কী কারণে শপথ নিলেন না তা জনগণকে জানাননি, দুঃখ প্রকাশের প্রয়োজন বোধ করেননি।”
আওয়ামী লীগের প্রার্থী টি জামান নিকেতাও ঠিক একই কথা বললেন।
“এবার ভোটের প্রচার-প্রচারণায় আমরা অনেক সহনশীল ছিলাম। বিএনপির নেতা-কর্মীরা ঝামেলা করতে চাইলেও আমরা তা এড়িয়ে চলেছি। তবে এবার সব প্রার্থীই সমানভাবে প্রচারণা চালাতে পেরেছেন।”
এছাড়া ইভিএম সম্পর্কে মানুষের ভেতর যে ভয় কাজ করছে তা ভাঙানোর চেষ্টা করেছি, ইভিএম নিয়ে সচেতনতা তৈরির চেষ্টা করেছি, বলেন টি জামান নিকেতা।
জাতীয় পার্টির প্রার্থী নুরুল ইসলাম ওমরও প্রায় একই কথা বলেছেন। ভোটের প্রচারণায় খুব ভালো পরিবেশ ছিল বলে তিনি জানান।
গত ৩০ ডিসেম্বর বগুড়া সদর আসনে বিপুল ভোট জয়লাভ করেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শপথ না নেওয়ায় গত জাতীয় সংসদের স্পিকার বগুড়া -৬ আসনটি শূন্য ঘোষণা করেন।
২০১৪ সালে এই আসনে জাতীয় পার্টির নুরুল ইসলাম ওমর বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর পেয়েছিলেন ২০৫৯৮৭ ভোট এবং নুরুল ইসলাম ওমরের ভোট ছিল ৩৯৯৬১।
বিভিন্ন দলের প্রার্থী এবং ভোটারদের সাথে কথা বলে জানা গেছে যে সুষ্ঠু এবং আবাদ, নিরপেক্ষ ভোটের জন্যে যে ধরনের পরিবেশ তারা আগে দেখেছেন, এবার উপ-নির্বাচনেও তারা সেই পরিবেশ লক্ষ্য করছেন।
প্রশাসনের নিরপেক্ষতা, ক্ষমতাশীল দলের প্রার্থীর সহযোগিতা, বিশেষ করে মাঠ পর্যায়ে পুলিশের ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা করছেন সবাই। ইভিএম নিয়ে তরুণ এবং শিক্ষিতদের ভেতর কিছুটা আগ্রহ দেখা গেলেও সাধারণ মানুষ কিছুটা দ্বিধান্বিত।
মোদ্দা কথা হলো, যদি একটি আসনের উপ-নির্বাচনের পরিবেশ নিরপেক্ষ করা যায় তবে কেন দলীয় সরকারের অধীনে সারাদেশে ৩০০ আসনে নিরপেক্ষ পরিবেশ বজায় রাখা সম্ভব নয়?
মানুষ তাদের ভোটাধিকার ফিরে পেতে চায় এবং ভয়-ডরহীন পরিবেশে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে তা প্রয়োগ করতে চায়। দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সরাসরি অংশগ্রহণ করতে চায়। তাই সুন্দর এবং নিরপেক্ষ পরিবেশ এবং সাধারণ মানুষের ভোটাধিকার অক্ষুণ্ণ রাখাকেই সরকারের অন্যতম দায়িত্ব বলে ভাবছেন বগুড়ার ভোটার সাধারণ।
মোস্তফা সবুজ: দ্য ডেইলি স্টারের নিজস্ব প্রতিবেদক, বগুড়া
Comments