‘তুই জানোয়ার, তুই জানোয়ার’
কোপাচ্ছে, রক্ত বের হচ্ছে। মানুষটি বাঁচার জন্য আকুতি জানাচ্ছেন, দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করছেন, লোকজন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছেন। স্ত্রীর গগনবিদারী চিৎকারে আকাশ বাতাস ভারি হয়ে উঠেছিলো, কিন্তু কেউ এগিয়ে এলেন না।
বাংলা চলচ্চিত্রে এ ধরনের চিত্র আমরা এক সময় হরহামেশাই দেখতাম। কিন্তু, বাস্তবে আমরা এ ধরনের ঘটনা দেখেছি কী না তা আমার জানা নেই। অবিশ্বাস্য হলেও এই ঘটনা ঘটেছে আমার সোনার বাংলায়।
ঘটনার বিবরণে জানা যায়- গতকাল (২৬ জুন) সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বরগুনা শহরের কলেজ রোডে স্ত্রীর সামনে রিফাতকে কুপিয়ে জখম করে একদল যুবক। ওই হামলার একটি ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়ার পর দেশজুড়ে শুরু হয় আলোচনা। সেখানে দেখা যায়, কয়েকজন যুবক চড়াও হয়েছেন রিফাতের উপর। তাদের মধ্যে দুজন রামদা হাতে রিফাতকে একের পর এক আঘাত করে চলেছেন। রিফাতকে বাঁচানোর জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছিলেন তার স্ত্রী। কিন্তু, পারেননি।
রিফাতের স্ত্রীর চিৎকারে আশপাশের কেউ এগিয়ে আসেননি। হামলাকারী যুবকরা রিফাতকে রক্তাক্ত করে সবার সামনে দিয়েই চলে যায়।
পরে রিফাতকে উদ্ধার করে বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে চিকিৎসকের পরামর্শে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে তার মৃত্যু হয়।
এ হামলার জন্য বরগুনা পৌরসভার ক্রোক এলাকার নয়ন বন্ড নামে এক যুবককে দায়ী করেন রিফাতের স্ত্রী। এছাড়াও রিফাত ফারাজী, রাব্বি এবং আকন নামের কয়েকজনের কথাও তিনি বলেছেন। বরগুনার ওসি আবির মোহাম্মদ হোসেন বলেন, রিফাতের স্ত্রী স্থানীয় একটি কলেজের ছাত্রী। দুই মাস আগে তাদের বিয়ে হয়।
মোটা দাগে এই হলো ঘটনা। সারাদেশ দেখছে- তরুণ একটি প্রাণ, কীভাবে কেড়ে নিলো সন্ত্রাসীরা। তা দেখার মতো মানসিক শক্তি আমার নেই। তাই পুরোটি দেখিনি। নিশ্চয়ই আমার মতো অনেকেই দেখতে পারেননি বা পারবেন না। কিন্তু, একজন স্ত্রীকে তা দেখতে হয়েছে। নাহ, ভাবতে পারছি না।
রিফাত আর আয়েশা সিদ্দিকা যখন বিয়ে করেন তখন নিশ্চয়ই একজন আরেকজনকে বলেছিলেন কেউ কাউকে ছেড়ে যাবেন না, একে অন্যের বিপদে এভাবে এগিয়ে আসবেন। এটিই তো হওয়ার কথা ছিলো! স্বামীকে বাঁচাতে গিয়ে স্ত্রী আয়েশা নিজেও বরণ করতে পারতেন করুণ পরিণতি! আহা রে, মেয়েটির সেসময়ের অসহায়ত্বের কথা ভেবে বুকের ভেতরটা শূন্য মনে হচ্ছে! মেয়েটি কতোটা চেষ্টা করেছে, কতোটা কষ্ট সহ্য করে নিজের চোখে প্রাণপ্রিয় মানুষটিকে কাতরাতে দেখেছে।
কথায় কথায় আমরা বলি- বাঙালি বীরের জাতি, বাঙালির বুক ভরা সাহস। এ ঘটনা দেখি কি আপনারা বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন বাঙালি বীরের জাতি? মানুষ ঘটনাটি দেখেছেন, কেউ এগিয়ে আসেননি। তার মানে আমরা কাপুরুষ জাতি! তা না হলে বিশ্বজিতের পরে এ ধরনের ঘটনা আমরা রুখে দিতে পারতাম।
রিফাতকে হত্যা করা হলো আর আমরা কী করছি। শোক প্রকাশ করছি, আহা-উঁহু করছি। হ্যাঁ, একটি কাজ আমরা করছি আর তা হলো আমরা ফেসবুকে নিন্দার ঝড় তুলছি।
কিন্তু, যদি রিফাত আর আয়েশা রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতেন তবে যারা রিফাতের হত্যার সময় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলেন তারাই হয়তো এগিয়ে আসতেন সেই যুগলকে আটক করার জন্য, মারার জন্য, বিচার করার জন্য।
মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের প্রসিদ্ধ কবি, বাংলা ভাষার প্রথম মানবতাবাদী কবি চণ্ডীদাস এই দৃশ্য দেখলে তিনি তার বিখ্যাত উক্তি ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’ এর জায়গায় হয়তো লিখতেন ‘সবার উপর ভাইরাল সত্য, মানুষ নয়!’
এইতো গত ২৩ জুন ছিলো কবি নবারুণ ভট্টাচার্যের জন্মদিন। তার কবিতা আজকের দিনে মনে হয় সবচেয়ে বেশি প্রাসঙ্গিক, যদিও তিনি সেটি লিখেছিলেন ১৯৭২ সালে। কবিতার কয়েকটি বাক্য এই রকম:
‘এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না
এই রক্তস্নাত কসাইখানা আমার দেশ না
এই জল্লাদের উল্লাসমঞ্চ আমার দেশ না
এই বিস্তীর্ণ শ্মশান আমার দেশ না…’
হুমায়ূন আহমদ তার নাটকে একটি সংলাপ তোতা পাখির মুখ দিয়ে বলিয়েছিলেন ঘৃণা প্রকাশ করতে। সংলাপটি পরে শাহবাগ আন্দোলনের সময় ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। সংলাপটি ছিলো ‘তুই রাজাকার, তুই রাজাকার’। আর আজ সেই পিশাচদের কাজ দেখে মনে হচ্ছে তাদের বলি, ‘তুই জানোয়ার, তুই জানোয়ার’।
Comments