রিকশা বিতর্ক

তুমুল জনপ্রিয়তা পাওয়া ‘অশিক্ষিত’ সিনেমার বিখ্যাত গান “ঢাকা শহর আইসা আমার আশা ফুরাইছে” খন্দকার ফারুক আহমেদ ও শাম্মী আকতারের কণ্ঠে এতোটাই জনপ্রিয়তা পেয়েছিল যে যারা ঢাকা শহরে কখনো আসেননি তারা কল্পনায় ঢাকার একটা চিত্র দেখতে পেতেন।

তুমুল জনপ্রিয়তা পাওয়া ‘অশিক্ষিত’ সিনেমার বিখ্যাত গান “ঢাকা শহর আইসা আমার আশা ফুরাইছে” খন্দকার ফারুক আহমেদ ও শাম্মী আকতারের কণ্ঠে এতোটাই জনপ্রিয়তা পেয়েছিল যে যারা ঢাকা শহরে কখনো আসেননি তারা কল্পনায় ঢাকার একটা চিত্র দেখতে পেতেন।

সময়ের বিবর্তনে সেই স্বপ্নের ঢাকা শহর আজ যেন দুঃস্বপ্নের নগরীতে পরিণত হয়েছে।  শখ করে তেমন কেউ আর হয়ত বসবাসের অনুপযোগী এই নগর দেখতে আসেন না। ষাট বা সত্তুরের দশকের ঢাকা আজ যেন রূপকথা। বুক ভরে দম নেওয়ার জায়গা আজ ঢাকায় খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।

সারা বিশ্বের মানুষের কাছে ঢাকার পরিচিতি জনবহুল শহর, যানজটের শহর, নোংরা শহর সহ নানা ধরনের নেতিবাচক বিশেষণে। ইতিবাচক দিকে ঢাকা হলো মসজিদের শহর আর আর কিছু আপাতত মনে পড়ছে না। হ্যাঁ তবে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে ঢাকা হলো রিকশার শহর।

পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়ছে, বাড়ছে জলবায়ু উদ্বাস্তু মানুষের সংখ্যা। সারা বিশ্বের জন্য এক বিশাল হুমকি জলবায়ু পরিবর্তন। পৃথিবীর বড় বড় সব বিজ্ঞানীরা বলছেন গাছ লাগাতে হবে, জ্বালানি তেলের ব্যবহার কমাতে হবে, করতে হবে আরও অনেক কিছু। কারণ পরিবেশ বাঁচলেই তো মানুষ বাঁচবে।

পরিবেশ বাঁচানোর এই আন্দোলনে পৃথিবীর সব দেশ যুক্ত হয়েছে নিচ্ছে বিভিন্ন পদক্ষেপ। বিশ্বের বহু শহর এখন ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারকে নিরুৎসাহিত করছে, উৎসাহিত করছে অযান্ত্রিক যানবাহন যেমন বাইসাইকেল।

আর আমরা যেন উল্টো হাঁটছি। ঢাকা শহরের গুরুত্বপূর্ণ তিনটি সড়কে রিকশা চলাচল বন্ধ। ঢাকা শহরের উন্নয়ন হচ্ছে এই যানবাহনের কথা চিন্তা থেকে সরিয়ে রেখেই। সব উন্নয়ন যেন শুধু ছোট গাড়ির জন্য। ফ্লাইওভার আর ফ্লাইওভার। সাপের শরীরের মতো সারা ঢাকা শহর যেন ফ্লাইওভারে পেঁচিয়ে যাচ্ছে। গণপরিবহন খুব কমই ব্যবহার করে এসব উড়াল সেতু।

পরিবেশ থেকে এবার আসি অর্থনীতিতে। ২০১৬ সালে রিকশা নিয়ে দুই পর্বের একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন করেছিলাম প্রায় এক মাস মাঠে ঘুরে। সেই সময়ে করা প্রতিবেদনেরই কিছু তথ্য তুলে ধরতে চাই। তাহলে বোঝা যাবে রিকশার ভূমিকা আমাদের অর্থনীতিতে কতটা।

রিকশা দেশের অর্থনীতিতে ৩৭৪ বিলিয়ন টাকার মতো অবদান রাখে। এই টাকা সরাসরি ১৫ লক্ষ রিকশা চালকের সংসারে এবং রিকশাকে ঘিরে বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের জীবন জীবিকার সঙ্গে জড়িত। দেশের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ বিনায়েক সেন বলেছিলেন নিঃসন্দেহে রিকশাই যোগাযোগ খাত থেকে অর্থনীতিতে সবচেয়ে বেশি টাকার যোগান দেয়। কিন্তু সেটা কত তা তিনি বলেননি।

রিকশা শুধু কিন্তু একটা শিল্প নয়। এই ব্যবসার সঙ্গে ছোট বড় ৪১ ধরনের ব্যবসা জড়িত। কি খটকা লাগছে? আমারও লেগেছিল। ঢাকা শহরের রাস্তার পাশে যে ছোট ছোট টং দোকান বা ভাতের দোকান--এই সব দোকানের মূল ক্রেতা রিক্সা চালকেরা। আপনি যে বাসায় দুই জন তিন জন গৃহকর্মী রাখেন বাসার কাজ করার জন্য, তাদের ৯০ শতাংশই রিকশা চালকের স্ত্রী।

এবার আসি রিকশার অবৈধ অর্থনীতিতে। ১৯৮৬ সালে যখন এরশাদ সরকার ক্ষমতায় তখন ঢাকা শহরে সর্বশেষ রিকশার লাইসেন্স দেওয়া হয়। তখন ৭৯,৭৫৪টি রিকশা আর ৮০০০ ভ্যানের অনুমতি ছিল ঢাকায় চলাচলের জন্য। তারপর থেকে আর নতুন করে কোনো রিকশার অনুমোদন দেওয়া হয়নি, এমনকি যেসব রিকশা-ভ্যানের অনুমতি ছিল, সেগুলোও আর নবায়ন করা হয়নি। আর এই সুযোগে রিকশাকে পুঁজি করে গড়ে উঠেছে এক ধরনের শোষক শ্রেণি। অনুমোদন নাই তাই বলে কিন্তু তথাকথিত ‘লাইসেন্স‘ ছাড়া কোনো রিকশা আপনি রাস্তায় পাবেন না। তাও আবার একটা না দুইটা লাইসেন্স লাগে। একটা লাইসেন্স দেয় রিকশা-ভ্যান শ্রমিকলীগ, ঢাকা সিটি রিকশা-ভ্যান মালিক কল্যাণ সোসাইটি, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা ফোরাম, ঢাকা মহানগর রিকশা শ্রমিকলীগ, বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধা সমন্বয় পরিষদসহ এরকম প্রায় ৫০টির মতো সংগঠন। রিকশাওয়ালারা বলেন, এই লাইসেন্স থাকলে পুলিশ ধরে না।

আরেকটা লাইসেন্স দেয় রিকশা মালিক ও গ্যারেজ মালিকদের বিভিন্ন সংগঠন। যেমন ঢাকা রিকশা এন্ড ভ্যান ওনার্স ফেডারেশন, বাংলাদেশে রিকশা মালিক ফেডারেশন, বাংলাদেশ রিকশা এন্ড ভ্যান মালিক ফেডারেশন। এই লাইসেন্স থাকলে রিকশা চোরেরা রিকশা চুরি করে না।

তার মানে, রিকশার লাইসেন্সের অনুমতি না থাকলেও, একধরনের অসাধু গোষ্ঠী কিন্তু ঠিকই বছরের পর বছর টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।

তাতে কি? সময়ের প্রয়েজনে ঢাকায় যেমন মানুষের সংখ্যা বেড়েছে সেই সঙ্গে বেড়েছে যানবাহন। আর যানবাহনের মধ্যে রিকশার সংখ্যা বেড়েছে সবচেয়ে বেশি। শুধু মেগাসিটি ঢাকাতেই রয়েছে প্রায় দশ লাখের বেশি রিকশা।

হঠাৎ করে ঢাকার বড় কয়েকটি রাস্তা থেকে রিকশা তুলে দেওয়ার ফলে একটা বড় অংশের রিকশা চালক বেকার হয়ে পড়বেন। বাংলাদেশে যেখানে বেকারের সমস্যা তীব্র সেখানে রিকশার মতো এতো সহজলভ্য এবং সুবিধাজনক কর্মসংস্থানের আর কোনো উপায় বা খাত আছে, সেটা চিন্তার বিষয়। গ্রামের একজন মানুষ মোটামুটি কোনো ধরনের জামানত ছাড়াই রিকশার প্যাডেল ঘুরিয়ে নিজের জীবনের চাকা ঘুরাচ্ছে। সমাজে রিকশা শ্রমিকদের মতো এত কষ্ট করে আর কোনো শ্রমজীবী মানুষ অর্থ উপার্জন করেন না। এবং এই খেটে খাওয়া মানুষেরা সমাজের দুর্নীতি বা সন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িত সেরকম নজিরও আমাদের সামনে খুব কম।

রিকশা তুলে দেওয়ার দাবির পক্ষে আরেকটি যুক্তি হলো যানজট নিরসন। ঢাকার যানজট অসহনীয়, সেটা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু রিকশার কারণে যে যানজট, প্রমাণ করা দুঃসাধ্য ব্যাপার। এই তত্ত্ব বিদেশি সাহায্য সংস্থা বলার চেষ্টা করেছে, জোরালো যুক্তি দিতে পারেনি।

ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কতৃর্পক্ষের (ডিটিসিএ) একটি সূত্রের মতে ঢাকা শহরে প্রাইভেট কার বা ব্যক্তিগত গাড়ির যে সংখ্যা, সেটা হিসাব কষলে নগরীর সড়কের ৪০ শতাংশ জায়গাই ব্যক্তিগত গাড়ির দখলে। পক্ষান্তরে বাসের যে সংখ্যা, তার হিসাব কষলে সবচেয়ে বেশি যাত্রী পরিবহনকারী এসব বাহন চলে মাত্র ছয় শতাংশ জায়গা নিয়ে।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের তথ্য মতে, রাজধানীতে গণপরিবহন চলার উপযোগী সড়কের বেশির ভাগ ব্যক্তিগত গাড়ির দখলে। ৪৪ শতাংশ সড়কে ফুটপাত নেই। ৮০ শতাংশ ফুটপাত রক্ষণাবেক্ষণ নিম্নমানের। সড়কের ৯৫ শতাংশ জায়গায় পারাপারের ব্যবস্থা নেই।

পরিবহন বিশেষজ্ঞদের মতে শহরের মোট সড়কের ৫০ শতাংশ জায়গাজুড়ে ব্যক্তিগত গাড়ি চললে তা যাত্রীর ১২ শতাংশ বহন করতে পারে। অন্যদিকে ৫০ শতাংশ জায়গাজুড়ে বাস চললে ৮৮ শতাংশ যাত্রী পরিবহন করা যায়।

হ্যাঁ এটা সত্য যে রিকশা, যানচালিত গাড়ির গতি কমিয়ে দেয়। সে কারণে রিকশাকে মূল সড়কের যন্ত্রচালিত যানবাহনের সঙ্গে চলাচল করতে দেওয়া যাবে না। রিকশা বা সাইকেলের জন্য আলাদা লেনের যে দাবি সেটা সরকার বিবেচনা করতে পারে। কিন্তু হঠাৎ এধরনের সিদ্ধান্ত যানজট কতটুকু কমাবে সেটা হয়তো সময়ই বলে দিবে কিন্তু জনগনের ভোগান্তি যে বাড়াবে তা বলাই যায়।

তুলে না দিলেও,পর্যায়ক্রমে রিকশা হয়ত এমনিতেই উঠে যাবে। রিকশা সারাজীবন চলবে, এমন যুক্তি দেওয়া যায় না। কিন্তু বর্তমান সময়ে লক্ষ লক্ষ রিকশা চালক কী করে জীবনধারণ করবেন, চিন্তাটা বিবেচনায় নেওয়া জরুরি। হয়ত বলা হবে, তারা গ্রামে ফিরে যাবেন। গ্রামে কাজের লোক পাওয়া যায় না। যুক্তি হিসেবে সামনে আনা হতে পারে, ধান কাটার মৌসুমের শ্রমিক সংকটের বিষয়। শহুরে সুবিধাপ্রাপ্ত শিক্ষিত শ্রেণির আংশিক যৌক্তিক ও আংশিক কল্পনামিশ্রিত এই তথ্য যে প্রকৃত সত্যের প্রতিফলন নয়, তা কে বোঝাবে! কে বোঝাবে যে, গ্রামে কাজ থাকে-মজুরের সংকট থাকে কয়েক মাস, এবং কয়েক মাস কাজ থাকে না। কিন্তু ক্ষুধা থাকে। ক্ষুধা নিয়ে রিকশার প্যাডেল মেরে জীবনধারণ যিনি বা যারা করেন, তারাও এদেশের মানুষ। তাদের কর্মহীন করার আগে বিকল্প ভেবে নিন।

Comments

The Daily Star  | English

DMCH doctors threaten strike after assault on colleague

A doctor at Dhaka Medical College Hospital (DMCH) was allegedly assaulted yesterday after the death of a private university student there, with some of his peers accusing the physicians of neglecting their duty in his treatment

4h ago