শিক্ষকের কাছ থেকে আমরা গোয়েন্দা তৎপরতা আশা করি না: আনু মুহাম্মদ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) শৃঙ্খলাবিধিতে সংযোজিত নতুন দুটি উপধারাকে ‘বিতর্কিত’ ও ‘নীপিড়নমূলক’ উল্লেখ করে তা বাতিলের দাবি জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকরা।
গতকাল (৮ জুলাই) বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে ‘কর্মরত সাংবাদিকবৃন্দ’ এর ব্যানারে আয়োজিত মানববন্ধন থেকে এ দাবি জানানো হয়।
এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনলাইন ও দৈনিক পত্রিকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত প্রায় ৪০ জন সাংবাদিক অংশ নেন এবং অন্তত পাঁচটি রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন একাত্মতা পোষণ করে।
সম্প্রতি গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তথ্য প্রকাশের ব্যাপারে বিধি-নিষেধ দিয়ে ছাত্র-ছাত্রী শৃঙ্খলাবিধি হালনাগাদ করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এতে শৃঙ্খলাবিধির দুটি ধারা ক্যাম্পাসের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মহলে ক্ষোভ ও উদ্বেগ সৃষ্টি করে। কেউ কেউ এটিকে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের বাতিলকৃত ৫৭ ধারা ও নতুন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ ধারার অনুকরণ হিসেবেও চিহ্নিত করেন।
বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাসান আল মাহমুদের সঞ্চালনায় মানববন্ধনে সংহতি জানান অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ।
এ সময় তিনি বলেন, ‘মত প্রকাশ’ এবং ‘তথ্য’ এ দুইয়ের প্রতি ক্ষমতাবানরা সবসময় ভীত থাকেন। কারণ যদি মত প্রকাশ ও তথ্য প্রকাশের সুযোগ থাকে তাহলে তাদের ক্ষমতা বা স্বৈরতন্ত্র বাধাগ্রস্ত হবে।
“রাষ্ট্র যখন মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করে তখন তার প্রভাব প্রতিষ্ঠান উপরে পড়ে,” উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, “আমরা দেখেছি, এই বিশ্ববিদ্যালয়র শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের ঐতিহ্য আছে। এখানে মত প্রকাশের জন্য বহুদিন ধরে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা তাদের আন্দোলন চালিয়ে গেছেন। আজকে সেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সরকারের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে একই রকম কাজ করছে।”
তিনি মনে করেন, “বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন চালান শিক্ষকরা, শিক্ষকরা পুলিশ হতে পারেন না। শিক্ষকের কাছ থেকে আমরা গোয়েন্দা তৎপরতা আশা করি না। শিক্ষকরা ছাত্রদের অভিভাবক। যে সকল সাংবাদিক রয়েছেন তাদেরও অভিভাবক। আর অভিভাবক হিসেবে তাদের যে মত প্রকাশের স্বাধীনতা রয়েছে, সে অধিকার দেওয়া শিক্ষকদের দায়িত্ব। বিশ্ববিদ্যালয়ে যে সব ধরনের দুর্নীতি হয় তা জানানোর জন্য প্রশাসনের উচিত সাংবাদিকদের উৎসাহ দেওয়া।”
“তথ্য প্রবাহের পথে বাধা সৃষ্টি হলো দুর্নীতিবাজদের নিরাপত্তা দেওয়ার নামান্তর। তাই আমি মনে করি, শিক্ষার্থীদের সাথে শিক্ষকদের স্বার্থে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি রক্ষা করার শর্তে এই অধ্যাদেশ বাতিল করা হবে,” যোগ করেন আনু মুহাম্মদ।
জার্নালিজম এন্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী শাহিনুর রহমান শাহিন বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয় মুক্তচিন্তার বিকাশ এবং লালন-পালনের যথাযথ স্থান। এই উপধারা দুটি ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে ভীতি ও শঙ্কা তৈরি করবে, যা শুভ নয়। ক্যাম্পাসে কর্মরত সংবাদকর্মীদের কাজের ক্ষেত্র সংকুচিত করবে এবং সাংবাদিকরা নিগ্রহের শিকার হতে পারেন।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক রাইয়ান বলেন, “এটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ধারা, যা সাংবাদিকদের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরকে চেপে ধরতে চেষ্টা করবে।” অবিলম্বে তিনি ধারা দুটি বাতিলের জোর দাবি জানান।”
শাখা সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি আশিকুর রহমান বলেন, “এখানে আমরা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রতিধ্বনি দেখতে পাচ্ছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব নিবর্তনমূলক তৎপরতা রয়েছে সেগুলোর বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের অভিব্যক্তিকে এটা সংকুচিত করবে। যেহেতু প্রশাসন তাদের মতো করেই সত্য-অসত্য প্রতিপাদন করবে। ফলে এটার অপব্যবহারের সম্ভাবনা রয়েছে।”
সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ দিদার বলেন, “এই উপধারা দুটি ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে ভীতি ও শঙ্কা তৈরি করবে, যা শুভ নয়। প্রশাসন কোনোদিন এভাবে শিক্ষার্থীদের দমিয়ে রাখতে পারে নি, পারবেও না।”
সাধারণ ছাত্র অধিকার পরিষদ জাবি শাখার আহবায়ক শাকিলুজ্জামান বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কোনো সাংবাদিককে শাস্তি দিতে পারে না। যদি কেউ ‘মিথ্যা’ কিংবা ‘বিকৃত’ তথ্যে প্রকাশ করেন, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উচিত প্রচলিত আইনের মাধ্যমে প্রতিবাদ জানানো।”
হালনাগাদকৃত শৃঙ্খলাবিধির যে ধারাটি সবচেয়ে বেশি ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে তাতে বলা হয়েছে- “কোনো ছাত্র/ছাত্রী অসত্য এবং তথ্য বিকৃত করে বিশ্ববিদ্যালয় সংক্রান্ত কোনো সংবাদ বা প্রতিবেদন স্থানীয়/জাতীয়/আন্তর্জাতিক প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক সংবাদ মাধ্যমে/সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ/প্রচার করা বা উক্ত কাজে সহযোগিতা করতে পারবে না।” শৃঙ্খলা বিধিতে ৫-এর ঞ নম্বর ধারা হিসেবে সংযুক্ত হয়েছে এটি।
ধারাটি সম্পর্কে উদ্বিগ্ন শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও গণমাধ্যমকর্মীরা বলছেন, কোনটি অসত্য কিংবা বিকৃত তথ্য তা নির্ধারণ করার ক্ষমতা যেহেতু প্রশাসনের হাতে ফলে প্রশাসনের বিরুদ্ধে যায় এমন যেকোনো তথ্য বা প্রতিবেদনকেই প্রশাসন অসত্য বলে চিহ্নিত করতে পারবে। প্রতিবাদী শিক্ষার্থী ও গণমাধ্যমকর্মীদের বিরুদ্ধে এটা একটা অস্ত্র হিসেবে কাজ করবে।
অপরটি ৫-এর (থ) নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, “বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ছাত্র/ছাত্রী, শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীর উদ্দেশে টেলিফোন, মোবাইল ফোন, ই-মেইল, ইন্টারনেটের মাধ্যমে কোনো অশ্লীল বার্তা বা অসৌজন্যমূলক বার্তা প্রেরণ অথবা উত্ত্যক্ত করবে না।”
শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বলছেন, এখানেও সমস্যার বিষয় হচ্ছে প্রশাসন যেকোনো যৌক্তিক দাবি বা ক্ষোভকে অসৌজন্যমূলক হিসেবে সংজ্ঞায়িত করার ক্ষমতা রাখবে। যেহেতু এখানে কোনো নির্দিষ্ট সংজ্ঞা বলে দেওয়া নেই। ফলে এটিরও অপপ্রয়োগের সুযোগ থাকবে।
গত ৫ এপ্রিল অনুষ্ঠিত বিশেষ সিন্ডিকেট সভায় অনুমোদন পেয়েছে ধারা দুটি। জানাজানি হওয়ার পর এ নিয়ে শিক্ষার্থীদের ভেতরে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত গণমাধ্যমকর্মী, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেকেই মনে করছেন, ধারা দুটি স্বাধীন মতপ্রকাশ ও মুক্ত সাংবাদিকতা চর্চাকে রুদ্ধ করার জন্যই প্রণয়ন করা হয়েছে।
সংশোধিত বিধিতে ধারা দুটি লঙ্ঘন করার শাস্তির কথা বলা হয়েছে- লঘু শাস্তি হিসেবে সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা, সতর্কীকরণ এবং গুরু শাস্তি হিসেবে আজীবন বহিষ্কার, বিভিন্ন মেয়াদে বহিষ্কার, সাময়িক বহিষ্কার ও পাঁচ হাজার টাকার ঊর্ধ্বে যেকোনো পরিমাণ টাকা জরিমানা করা হবে।
Comments