‘যাদের বাড়িতে পানি উঠে নাই তারাই রিলিফ পাইতেছেন’

“বানের পানিতে কষ্ট করে বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে অমানবিকভাবে দিনাতিপাত করতেছি। কিন্তু, আমরা রিলিফ পাইতেছি না। যাদের বাড়িতে পানি উঠে নাই তারাই রিলিফ পাইতেছেন,” এমন অভিযোগ করলেন লালমনিরহাট সদর উপজেলার বাগডোরা গ্রামের বানভাসি আহেদা বেগম।
Lalmonirhat flood victims
১৬ জুলাই ২০১৯, লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলায় বাড়ি-ঘর ভেঙে নিরাপদ আশ্রয়ে যাচ্ছেন বানবাসী মানুষ। ছবি: স্টার

“বানের পানিতে কষ্ট করে বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে অমানবিকভাবে দিনাতিপাত করতেছি। কিন্তু, আমরা রিলিফ পাইতেছি না। যাদের বাড়িতে পানি উঠে নাই তারাই রিলিফ পাইতেছেন,” এমন অভিযোগ করলেন লালমনিরহাট সদর উপজেলার বাগডোরা গ্রামের বানভাসি আহেদা বেগম।

জেলার হাতীবান্ধা উপজেলার তিস্তাপাড়ের ডাউয়াবাড়ী গ্রামের বানভাসি গনি মিয়া (৬৫) অভিযোগ করে বলেন, “বানভাসি না হয়েও মেম্বার-চেয়ারম্যানের পছন্দের লোকজন সরকারি রিলিফ পেয়েছেন। আমাদের কষ্ট কেউ আর দেখেন না।”

গত নয় দিনেও বানের পানি তেমন না কমায় চর ও নদী তীরবর্তী অনেক বানভাসি পরিবার ঘর-বাড়ি সরিয়ে ছুটছেন নিরাপদস্থানে। বানের পানিতে ভেসে গেছে অনেকের ঘর, আসবাবপত্র, হাঁস-মুরগি ও গবাদি পশু। অনেকে বাড়ি-ঘর নৌকায় তুলে ছুটছেন আশ্রয়ের খোঁজে।

“বানের পানি কমতেছে না। ছোট ছেলে-মেয়েদের নিয়ে ঝুঁকির মধ্যে বানের পানিতে আর কতোদিন থাকা যায়? তাই বাড়ি-ঘর ভেঙে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যাইতেছি,” এমনটি জানালেন আদিতমারী উপজেলার তিস্তাপাড়ের চর নরসিংহ গ্রামের বাসভাসি নজরুল ইসলাম।

“আমার মতো অনেকেই বাড়ি-ঘর ভেঙে নিরাপদ জায়গায় ছুটতেছেন,” এমনটি জানিয়ে নজরুল বললেন, তার বেশ কয়েকটি হাঁস-মুরগি ও গো-খাদ্য খড়ের গাদা বন্যার পানিতে ভেসে গেছে।

এদিকে, গেলো ১২ ঘণ্টায় শিমুলবাড়ী পয়েন্টে ১৫ সেন্টিমিটার কমে লালমনিরহাটে ধরলা নদীর পানি এখনো বিপদসীমার ২৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে আর তিস্তার পানি কমে বিপদসীমার ২০ সেন্টিমিটার নীচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আজ (১৬ জুলাই) সকালে বন্য পরিস্থিতির এ সংবাদ জানায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

”আশা করছি, আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তিস্তাপাড়ের বন্যা উপদ্রুত এলাকাগুলো থেকে বানের পানি পুরোপুরি সরে যাবে তবে ধরলাপাড়ের পানি নামতে আরো কিছু সময় লাগবে,” জানান জেলার পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী বজলে করিম।

নদীর পানি কিছুটা কমলেও কমেনি বানভাসিদের দুর্ভোগ। এখনো তারা পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছেন। অনেকে রয়েছেন বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র ও রাস্তায়। রয়েছেন খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সঙ্কটে। দুর্গতদের কেউ কেউ খাবার যোগার করলেও চুলার ব্যবস্থা না থাকায় রান্নার অভাবে তারা খেতে পারছেন না। আবার কেউ কেউ চুলার ব্যবস্থা করলেও করতে পারছেন না খাবার সংগ্রহ।

লালমনিরহাট সদর উপজেলার জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের প্রকৌশলী আহসান হাবিব দাবি করে বলেন, তাদের লোকজন বন্যাদুর্গত এলাকায় ঘুরে ঘুরে বানভাসিদের মধ্যে পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট বিতরণ করছেন আর বানভাসিদের জন্য অস্থায়ীভাবে সুপেয় পানি ও টয়লেটের ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন।

কিন্তু, বাস্তবতা ভিন্ন। বন্যাদুর্গত এলাকায় তাদের কোনো লোককে কাজ করতে দেখা যায়নি।

“আমরা বিশুদ্ধ পানির সঙ্কটে আছি। কিন্তু, কেউ আমাদের খোঁজ নিতেছেন না। দিতেছেন না কোনো বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট,” এমনটি জানালেন লালমনিরহাট সদর উপজেলায় তিস্তাপাড়ের রাজপুর গ্রামের বানভাসি উপেন্দ্র রায়ের। “বানের পানিতে টয়লেট তলিয়ে যাওয়ায় তারা বাধ্য হয়েই যত্রতত্র মলত্যাগ করছেন,” এমনটিও জানালেন উপেন্দ্র।

গত রাতে লালমনিরহাট জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনে ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক আহসান হাবিব জানান, এ পর্যন্ত সরকারিভাবে জেলার পাঁচ উপজেলার ২০টি ইউনিয়নে ১৬ হাজার ৯১৬টি বানভাসি পরিবারের মধ্যে ১ হাজার ৪০০ কার্টুন শুকনো খাবার, ৩০০ মেট্রিক টন চাল ও নগদ ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা বিতরণ করা হয়েছে।

কিন্তু, ত্রাণ না পাওয়ার অভিযোগ অনেক বানভাসি মানুষের। তারা জানান, ত্রাণ বিতরণে রয়েছে ইউনিয়ন পর্যায়ে জনপ্রতিনিধিদের স্বজনপ্রীতি, রাজনীতিপ্রীতি ও ভোটের রাজনীতি। তাই সরকারি ত্রাণের সুযোগ থেকে বাদ পড়ে গেছেন অনেক বানভাসি মানুষ।

ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক আহসান হাবিব জানান, জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে বানভাসিদের তালিকা প্রস্তুত ও ত্রাণ বিতরনে কিছুটা অব্যবস্থা দেখা দিয়েছে। তাই এখন থেকে স্কাউটস সদস্যদের কাজে লাগিয়ে ত্রাণ বিতরনের কাজ করা হবে।

“যে সব বানভাসি মানুষ নদীর কারণে আশ্রয়হীন হয়ে পড়ছেন আমরা সরকারিভাবে তাদের আর্থিক সাহায্য দিচ্ছি,” উল্লেখ করে তিনি জানান জনস্বাস্থ্য বিভাগকে বন্যাদুর্গত এলাকায় সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

Comments