‘গণপিটুনিতে নিহত যুবক নিজের মেয়েকে দেখতে গিয়েছিলেন’

Siranj Narayanganj
২১ জুলাই ২০১৯, নারায়ণগঞ্জে ছেলেধরা সন্দেহে নিহত সিরাজের লাশ সিদ্ধিরগঞ্জের সাইলোগেইট বটতলা এলাকায় জানাজা নামাজের জন্য রাখা হয়। ছবি: স্টার

“গত আট মাস আগে এক মাত্র মেয়েকে নিয়ে অন্য ছেলের সঙ্গে পালিয়ে যায় স্ত্রী। এরপর থেকেই একা হয়ে যান বাক-প্রতিবন্ধী সিরাজ। বাক-প্রতিবন্ধী হওয়ায় দুঃখ বুঝানোর তেমন কেউ ছিলো না। স্ত্রীকে ভুলে গেলেও মেয়েকে ভুলতে পারেননি তিনি। তাই তাদের চলে যাওয়ার পর থেকে প্রতিদিনই মেয়ের খোঁজ নিতে চেষ্টা চালিয়ে গেছেন সিরাজ। এক পর্যায়ে দুই মাস আগে সিদ্ধিরগঞ্জের মিজমিজি আলামিননগর এলাকায় কাজ করতে গিয়ে রাস্তায় মেয়ে মিনজুকে দেখতে পান সিরাজ। সেই থেকে তিন-চারদিন পরপরই সকালে স্কুলে যাওয়ার রাস্তায় মেয়েকে দেখতে যেতেন সিরাজ। এ ধারাবাহিকতায় গত ২০ জুলাই সকালে মেয়েকে দেখতে যান সিরাজ। আর সেই দেখাই হয় বাবা-মেয়ের শেষ দেখা।”

আজ (২১ জুলাই) দুপুরে সিদ্ধিরগঞ্জের সাইলোগেইট বটতলা এলাকায় নামাজে জানাজার জন্য রাখা সিরাজের লাশের পাশে বসে দ্য ডেইলি স্টারকে কথাগুলো বলেন তারই ছোট ভাই আলম।

এর আগে গতকাল সকালে সিদ্ধিরগঞ্জের মিজমিজি পাগলাবাড়ির সামনে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে অজ্ঞাত পরিচয় (২৫) এক যুবক নিহত হন। পরে রাতে ফেসবুকে ছবি দেখে থানায় গিয়ে লাশ শনাক্ত করে নিহতের পরিবার। তারা জানায়, সিরাজ ছেলেধরা নয় বরং বাক-প্রতিবন্ধী।

আলম বলেন, “আমার ভাই ছেলেধরা না। নিজের মেয়ের সঙ্গে লুকিয়ে দেখা করতে গিয়েছিলো। নিজের কাছে টাকা ছিলো না। তাই একটি মোবাইলের দোকান থেকে ১০০ টাকা ধার করে মেয়ের জন্য বিস্কুট, চিপস নিয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু, স্ত্রী শামসুন্নাহার তার বর্তমান স্বামীকে দিয়ে মানুষকে ভুল তথ্য দিয়ে সিরাজকে হত্যা করেছে।”

নিহত সিরাজ ভোলার লালমোহন উপজেলার মুগিয়া বাজার এলাকার আব্দুর রশিদের ছেলে। তিনি রাজমিস্ত্রির সহকারী হিসেবে কাজ করতেন। চারভাই ও তিন বোনের মধ্যে সিরাজ বড়।

আলম জানান, জন্মের পর থেকেই সিরাজ কথা বলতে পারে না। পরে ১০ বছর আগে একই এলাকার শামসুন্নাহারের সঙ্গে সিরাজের বিয়ে হয়। গ্রামে কাজ না পাওয়ায় ২০১৫ সালে স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে নারায়ণগঞ্জে আসেন তিনি। সিদ্ধিরগঞ্জের সাইলোগেইট এলাকায় মোহর চানের বাড়িতে ভাড়ায় পরিবার নিয়ে বসবাস করতে শুরু করেন সিরাজ। নিজে কখনো রাজমিস্ত্রির সহকারী আবার কখনো দিনমজুর হিসেবেই কাজ করতেন। আর স্ত্রী শামসুন্নাহার বাসাবাড়িতে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতেন। আটমাস আগে স্থানীয় বিদ্যুৎমিস্ত্রি আব্দুল মান্নান ওরফে সোহেলের সঙ্গে পরকীয়ায় জড়িয়ে একমাত্র মেয়ে মিনজুকে নিয়ে পালিয়ে যান শামসুন্নাহার। এই পাঁচ মাস আগে সিরাজকে তালাকের চিঠি পাঠায় তার স্ত্রী।

স্থানীয় বাসিন্দা আলাউদ্দিন বলেন, “বোবা হলেও ইশারায় সব কথা বলতে পারতো। আমাদের বুঝতে কষ্ট হলেও সবই বুঝতাম। মোখলেসের মোবাইলের দোকান থেকে টাকা নেওয়ার সময় আমি সামনে ছিলাম। তখন নিজেই হাতের ইশারা বুঝিয়েছে মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছে। মেয়েকে দেখতে যাবে তাই অনেক খুশি ছিলো সিরাজ। কিন্তু, মানুষ এমন নির্মমভাবে তাকে হত্যা করতে পারলো?”

তিনি আরো বলেন, “ভিডিওতে দেখছি কী নির্মমভাবে সিরাজকে মেরেছে। মারতে মারতে মাটিতে শুয়েই ফেলেছে। মাটিতে যখন সে ছটফট করছিলো তখন কয়েকজন যুবক প্রাণটা যায় না কেনো তাই একের পর এক লাথি মেরেই চলেছে। মরে যাওয়ার পর লাশটা টেনে হেঁচড়ে প্রায় ১০০ গজ দূরে ফেলে রাখে। অবিলম্বে এ নির্মম হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচার করতে হবে। অপরাধী যেই হোক তাকে শাস্তি দিতে হবে।”

সিরাজের আরেক ছোটভাই কালাম বলেন, “যে মেয়েটাকে উদ্ধার করা হয়েছে সেটা ভাইয়ের মেয়ে মিনজু। থানার ওসিকে ছবি দেখিয়েছি। আমাদের মোবাইলের ছবি আর উদ্ধারকৃত মেয়ের সঙ্গে মিল রয়েছে। আমার ভাই কথা বলতে পারে না তাই সবাইকে বুঝিয়ে বলতে পারে নাই। ভাইকে না মেরে থানায় দিলেও সত্যটা বের হয়ে যেতো। আমার ভাইকে এভাবে মরতে হতো না।”

অভিযোগের বিষয়ে জানতে শামসুন্নাহারের বর্তমান স্বামী আব্দুল মান্নান সোহেলের মোবাইলে যোগাযোগ করলে তার ফোন নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়।

সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহীন শাহ পারভেজ জানান, ২০ জুলাই সকালে গণপিটুনির ঘটনায় নিহত ও আহতের পৃথক দুটি ঘটনায় দুটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। সিরাজ হত্যা মামলায় ৭৬ জনের নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাত আরো ২০০ জনকে আসামি করা হয়। আর শারমিন আহতের ঘটনায় ২০ জনকে জ্ঞাত ও ১৫০ জনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়। এই শারমিনও মানসিক প্রতিবন্ধী। দুইটি মামলায় অভিযান চালিয়ে ১৪ জনকে গ্রেপ্তার করে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করে আদালতে পাঠানো হয়েছে। তদন্ত শেষে বিস্তারিত বলা যাবে।

সিরাজ হত্যা মামলার বাদী এসআই সাখাওয়াত হোসেন জানান, সিরাজের ভাইয়েরা দাবি করছে উদ্ধারকৃত মেয়েটি তাদের ভাতিজি। তবে এক নারী দাবি করছেন তার মেয়ে। এ নিয়ে তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষে বিস্তারিত বলা যাবে।

এদিকে আজ দুপুরে শহরের চাষাঢ়ায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নারায়ণগঞ্জের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও বর্তমান ছেলে ধরা গুজব ছড়ানোকে কেন্দ্র করে এক ব্রিফিংয়ে জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) হারুন অর রশিদ বলেন, “গত ২০ জুলাই সিদ্ধিরগঞ্জে ৩০ বছরের যে যুবককে গণপিটুনিতে মারা হয়েছে সে বাকপ্রতিবন্ধী ছিলো। ছেলেধরা বিষয়টি গুজব ছিলো। আর এই গুজবে এলাকাবাসী জড়িত।”

“যারা এই গুজব ছড়াচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে,” উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, “ইতোমধ্যে কয়েকজনকে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদেরকে আইনের আওতায় আনা হবে।”

“এলাকার কিছু গণ্যমান্য ব্যক্তি নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য এই গুজব ছড়াচ্ছেন” বলেও মন্তব্য করেন এসপি হারুন। বলেন, “আমরা তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। সেই তদন্ত অনুসারে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

Comments

The Daily Star  | English

Bangladesh women defend SAFF title with 2-1 win against Nepal

Bangladesh retained the title of SAFF Women's Championship with a 2-1 win against Nepal in an entertaining final at the Dasharath Stadium in Kathmandu today. 

11m ago