উন্নয়ন চ্যালেঞ্জ এখন আরও কঠিন
বাল্য বিবাহ, অল্প বয়সে গর্ভধারণ, পরিবার পরিকল্পনায় ধীর অগ্রগতি ও তরুণদের কর্মসংস্থানের সংকট দেশের জনসংখ্যা ও উন্নয়ন সমস্যাগুলোকে আরও প্রকট করে তুলেছে বলে এক আলোচনাসভায় মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। গতকাল রোববার টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনের ওপর আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে তারা বলেন, নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংসতা, সুশাসনের অভাব, মাতৃমৃত্যুর উচ্চহার ও শহরাঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আওতার বাইরে থাকার মতো বিষয়গুলো চ্যালেঞ্জগুলোকে আরও কঠিন করে তুলছে।
দ্য ডেইলি স্টার ও জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) যৌথভাবে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে দ্য ডেইলি স্টার সেন্টারে এই গোলটেবিল বৈঠক আয়োজন করে। অর্থনীতিবিদ, সরকারি-বেসরকারি ক্ষেত্রের প্রতিনিধি, জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞ ও মানবাধিকার সংশ্লিষ্টরা এতে অংশ নেন। জনসংখ্যা ও উন্নয়ন নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্মেলনে (আইসিপিডি) গৃহীত কর্ম পরিকল্পনা নিয়ে মূলত এই আলোচনা হয়। বিশ্বব্যাপী জীবন মানের উন্নয়নের লক্ষ্যে ১৯৯৪ সালে কায়রোতে ওই আন্তর্জাতিক সম্মেলন হয়েছিল।
বক্তারা বলেন, কায়রো সম্মেলনে অংশ নিয়ে বাংলাদেশ গৃহীত কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পূরণেও ওই কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রয়োজন রয়েছে।
গোলটেবিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্স বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক মাইনুল ইসলাম বলেন, আইসিপিডি’র ২৫ বছরে বাংলাদেশ বেশ কিছু ক্ষেত্রে সাফল্য দেখিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারাবাহিকতা, প্রাথমিক শিক্ষায় লৈঙ্গিক সমতা ও শিশু মৃত্যুর হার হ্রাসের মতো বিষয়গুলো রয়েছে। ১৯৯৪ সালের তুলনায় দেশে বাল্য বিবাহের হার কমে এলেও এখনও কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানো যায়নি বলেও জানান তিনি।
তিনি বলেন, ২০১৪ সালে এসে অল্প বয়সে গর্ভধারণের হার মাত্র দুই শতাংশ কমে ৩১ শতাংশে এসেছে। অন্যদিকে ১৯৯৩-৯৪ তে যেখানে গর্ভনিরোধক ব্যবহারের মাত্রা (সিপিআর) ছিল মাত্র ৪২.৬ শতাংশ ২০১৪ সালে এসে তা বেড়ে ৬২ শতাংশ হয়েছে। ২০১৫ সালে সিপিআর ৭২ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও গত বেশ কয়েক বছর ধরে এক্ষেত্রে অগ্রগতি থমকে রয়েছে। সেই সঙ্গে বয়স্ক জনগোষ্ঠীর আকার বৃদ্ধি ও তরুণদের কর্মসংস্থানের অভাব অভীষ্ট লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জ দেখছেন এই অধ্যাপক।
তিনি বলেন, শিক্ষা, চাকরি বা প্রশিক্ষণের বাইরে রয়েছে দেশের মোট তরুণদের ২৯.৮ শতাংশ। আয়ের বৈষম্য কমানোতেও কোনো অগ্রগতি নেই। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড এর মধ্য দিয়ে যাচ্ছে দেশ। কিন্তু এর সুফল তোলার জন্য আর বেশি সময় অবশিষ্ট নেই।
বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে সামাজিক আন্দোলনকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করছেন মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম। তিনি বলেন, নিরাপত্তাহীনতা বোধ থেকে অনেক অভিভাবক মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে দেন। অতীতে মানুষের বাড়ি বাড়ি প্রচারণা জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।
সে ধরনের প্রচারণা এখন আবার চালানো হলে ইতিবাচক ফল পাওয়া যেতে পারে বলে মনে করছেন তিনি।
“মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে শুধু জন্মনিরোধক সামগ্রী বিতরণ করলেই জনসংখ্যার বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। এর পাশাপাশি প্রজনন স্বাস্থ্য ও শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।”
পরিবার পর্যায়ে নীতি নির্ধারণী ক্ষেত্রে নারীদের উন্নীত করার ওপরও জোর দেন শাহীন আনাম।
বাংলাদেশে নিযুক্ত ইউএনএফপিএ’র প্রতিনিধি আসা টরকেলসন জাতিসংঘের বরাতে বলেন, সন্তান জন্মদানের সময় মাতৃমৃত্যুর হার কমিয়ে আনাতে ২০৩০ সালের মধ্যে ব্যয় ৬ গুণ বাড়াতে হবে। এর লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বিশ্বব্যাপী বেশ কয়েক বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন হবে।
দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদক ও প্রকাশক মাহফুজ আনাম বলেন, গত কয়েক দশকে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে অসাধারণ সাফল্য পেয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু নীতি নির্ধারকরা এখন আর এই বিষয়টিকে সেভাবে গুরুত্ব দিচ্ছেন না। বিষয়টি গুরুত্ব হারানোর জন্য সংশ্লিষ্টদের আত্মতুষ্টিকে দায়ী করেন তিনি।
তবে পরিকল্পনা কমিশনের জ্যেষ্ঠ সচিব ও সদস্য শামসুল আলমের ভাষ্য, জনসংখ্যার বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের বিষয়টিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। টোটাল ফার্টিলিটি রেট কমছে না। এই বিষয়টি কিভাবে সুরাহা করা যায় তা নিয়ে সরকারের মধ্যে উদ্বেগ রয়েছে।
পাওয়ার এন্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দের অভাবে রয়েছে। যা অবস্থা চলছে তাতে মানুষ মনে করছে অপরাধীরা শাস্তির আওতায় আসছে না বিধায় মানুষ ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হবে।
ইংরেজি থেকে অনূদিত। মূল প্রতিবেদনটি পড়তে ক্লিক করুন এই লিংকে।
Comments