নারায়ণগঞ্জে ছেলেধরা সন্দেহে আটক ৭ ব্যক্তির ৫ জনই প্রতিবন্ধী
নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় গত তিন দিনে ছেলেধরা সন্দেহে সাত ব্যক্তিকে আটক করে পুলিশে দিয়েছে এলাকাবাসী। এর মধ্যে বাক-প্রতিবন্ধী এক যুবক গণপিটুনিতে নিহত এবং অপর এক নারী গুরুতর আহত হয়েছেন। এ ঘটনায় দুটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।
তবে পুলিশের দাবি, ছেলেধরা সন্দেহে আটক সাত ব্যক্তির মধ্যে পাঁচ জনই প্রতিবন্ধী। ঠিক ভাবে কথা বলতে না পারায় এবং ভয়ে এ ধরণের ঘটনার শিকার হয়েছে।
সিদ্ধিরগঞ্জ মিজমিজ পাগলাবাড়ির সামনে গত শনিবার সকালে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে মো. সিরাজ (২৮) নামের এক বাক-প্রতিবন্ধী ব্যক্তি নিহত হন।
এ ঘটনায় নিহতের বাবা আব্দুর রশিদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, “আমার ছেলে কানে শোনে না। মুখে কথা বলতে পারে না। ছেলেকে বিয়ে দিয়েছিলাম কিন্তু বউ ছেলের কথা শুনতো না। ছেলেকে মারধর করতো। পরে ওকে শহরে পাঠিয়ে দিই। ভেবেছিলাম শহরে গিয়ে কাজ করলে সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু শহরের আসার পর আমার ছেলের সংসারটা শেষ হয়ে গেছে। এখন ছেলেটাকেও শেষ করে দিয়েছে মানুষ।”
তিনি বলেন, “কণ্যাশিশুকে নিয়ে আমার ছেলের বউ আরেক জনের সঙ্গে চলে গেছে। আর মেয়ে মেয়ে করে আমার ছেলেটা পাগল হয়ে গেছে। আজকে মেয়ের জন্যই আমার ছেলেকে মরতে হয়েছে। নিজের মেয়েকে দেখতে না গেলে আর এমনটা হতো না। আমি ছেলে হত্যার বিচার চাই।”
একই দিনে সিদ্ধিরগঞ্জের পাইনাদী শাপলা চত্বর এলাকায় ছেলেধরা সন্দেহে শারমিন (২০) নামে এক নারীকে গণপিটুনি দেয় এলাকাবাসী। পরে পুলিশ তাকে আটক দেখিয়ে চিকিৎসার জন্য আশঙ্কাজনক অবস্থায় শহরের খানপুর ৩০০ শয্যা হাসপাতালে ভর্তি করে।
শারমিনের বিষয়ে তার মা তাসলিমা বেগম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, “শারমিন আমার বড় মেয়ে। বিগত চার বছর ধরে সে মানসিক সমস্যায় ভুগছে। সে প্রায়ই বাচ্চা দেখলে কাছে ডেকে আদর করে। বিভিন্ন সময় কাউকে কোনো কিছু না বলে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। শনিবার সকাল ছয়টায় আবারও কাউকে কিছু না বলে বাসা থেকে বের হয়ে যায়। পরে জানাতে পারে পাইনাদি নতুন মহল্লা এলাকায় একটি বাচ্চাকে আদর করতে থাকে। কিন্তু অজ্ঞাত শতাধিক লোক মিলে ছেলেধরা সন্দেহে হত্যার উদ্দেশ্যে আমার মেয়েকে মারধর করে রক্তাক্ত জখম করে।”
তিনি বলেন, “চিকিৎসার পর এখন শারমিন সুস্থ আছে। তবে যারা বিচার বিবেচনা ছাড়া এভাবে মানুষের ওপর হামলা করে আমি তার বিচার চাই।”
সিদ্ধিরগঞ্জ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সেলিম দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, গুজবে নিরীহ দুজন প্রতিবন্ধী মানুষকে মারধর করা হয়েছে। একজন মারা গেছেন। আরেকজনকে পুলিশ উদ্ধার করেছে। ঠিকভাবে কথা বলতে না পারায় ও ভয়ে এ ঘটনার শিকার হয়েছেন তারা।
তিনি বলেন, “এ ঘটনায় দুটা মামলা হয়েছে। বাক-প্রতিবন্ধী যুবক সিরাজ হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার আট জনকে একদিনের রিমান্ড শেষে আজ আদালতে পাঠানো হয়েছে। তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে তদন্ত করা হচ্ছে। তদন্ত শেষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
ফতুল্লা মডেল থানার পরিদর্শক হাসানুজ্জামান জানান, গত দুই দিনে নারীসহ দুজনকে পুলিশে দিয়েছে স্থানীয়রা। এদের কেউ গুরুতর আহত নন। একজন ফুল ব্যবসায়ীকে সন্দেহ করে মারধর করে পুলিশে দেয়। পরে জানা যায়, তিনি ভালো মানুষ। ফুল বেচে জীবনযাপন করেন। তাই তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। রাস্তায় পাগলের মতো ঘুরে বেড়ানো এক নারীকে ধরে পুলিশে দেয় জনতা। পরে ওই নারীকেও ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
আড়াইহাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নজরুল ইসলাম জানান, গত দুই দিনে দুজন নারীসহ তিনজনকে ছেলেধরা সন্দেহে পুলিশে দেয় এলাকাবাসী। তবে তাদের মারধর করা হয়নি। তার মধ্যে দুজন মানসিক প্রতিবন্ধী রয়েছেন। পরে তাদেরকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও মোতালিব (৪০) নামে এক ব্যক্তির চুল বড় ও চলাফেরা সন্দেহজনক হওয়ায় তাকে আটক করে পুলিশ দেয়। পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায় তিনি ভালো ও সুস্থ লোক। তাই তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
এদিকে, মঙ্গলবার দুপুরে চাষাড়া হকার্স মার্কেটের সামনে জেলার সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও ছেলেধরাকে কেন্দ্র করে গুজবের বিষয়ে প্রেস ব্রিফিংয়ে জেলা পুলিশ সুপার হারুন অর রশীদ বলেন, “আমরা বিভিন্ন ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে মাইকিং করেছি যে, ছেলেধরাকে কেন্দ্র করে কেউ আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না। ছেলেধরাকে কেন্দ্র করে কেউ গুজব ছড়ালে সেই গুজবে কান দেবেন না। যারাই এ ঘটনায় শিকার হয়েছেন, তাদের অধিকাংশই বাক ও মানসিক প্রতিবন্ধী।”
তিনি আরও বলেন, “ইতিমধ্যে আমাদের একটি টিম নিযুক্ত করা হয়েছে, তারা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেবে। নিজের হাতে আইন তুলে নিয়ে কাউকে হত্যা করা অপরাধ। এ হত্যার কারণে সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় মামলা হয়েছে। অনেককেই মামলার আসামি করা হয়েছে। আমরা তদন্ত করছি। সেই তদন্তে যারা দোষী হবে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”
Comments