সঞ্চয় কমায় কমছে বিনিয়োগ

আয়কর
স্টার অনলাইন গ্রাফিক্স

আয়েশা আমিন একজন গৃহিনী। প্রতিমাসেই তার লক্ষ্য থাকে সংসারের খরচ বাবদ স্বামীর দেওয়া টাকা থেকে হাজার পাঁচেক টাকা বাঁচিয়ে তা সঞ্চয় করবেন।

তিনি সেই টাকা তার দুই বছরের ছেলের নামে স্থানীয় একটি ব্যাংকে ডিপোজিট পেনশন স্কিমে (ডিপিএস) জমা রাখেন। একজন গৃহিনী হিসেবে তার কোনো স্বাধীন উপার্জন নেই। তাই এভাবেই তিনি ভবিষ্যতে ছেলের বিদেশে উচ্চশিক্ষার খরচ জমানোর চেষ্টা করছেন।

কোনো কোনো মাসে তিনি সাত হাজার টাকাও জমিয়েছেন। কিন্তু, মাসের খরচ বাঁচিয়ে সেই পরিমাণ টাকা জমানো এখন তার পক্ষে আর সম্ভব হচ্ছে না। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল তার প্রথম জাতীয় বাজেটে যে পরিমাণ কর আরোপ করেছেন তার ফলেই তার এমন দশা হয়েছে।

বাজেটে গৃহস্থালি অনেক পণ্যের ওপর উচ্চহারে কর আরোপ করা হয়েছে। সেই তালিকায় রয়েছে আমদানিকৃত গুড়া দুধ, চিনি, মসলা, সয়াবিন তেল, সরিষা তেল ও মোবাইল ফোন ব্যবহার। এছাড়াও, রান্নার গ্যাসের দাম বাড়িয়ে বাড়ানো হয়েছে ব্যয়ের বোঝা। মধ্যবিত্ত পরিবারের আর সব মানুষের

মতো আয়েশাও পড়েছেন সেই বাড়তি বোঝার চাপে। কোপ পড়েছে তার সঞ্চয়ে।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস) এর হিসাব মতে, দেশের মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশ মধ্যবিত্ত। মধ্যবিত্ত পরিবারে সঞ্চয় কমে যাওয়ার মানে হলো বিনিয়োগের একটি বড় অংশ হারিয়ে যাওয়া।

অর্থনীতিতে বলা হয়, সঞ্চয়ের পরিধি এবং বিনিয়োগের পরিধি একই। কেননা, বিনিয়োগের অর্থ আসে সঞ্চয় থেকে। মানুষ বেশি বেশি সঞ্চয় করলে ব্যাংকগুলো সেই টাকা বেশি বেশি প্রতিষ্ঠানে লগ্নি করতে পারে।

যে অর্থনীতিতে সঞ্চয়ের পরিমাণ কম সেই অর্থনীতি আসলে দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগের পরিবর্তে স্বল্পমেয়াদী ভোগের পথ বেছে নেয়। বিনিয়োগের টাকায় ঘাটতি দেখা দিলে ভবিষ্যতে অর্থসঙ্কটও দেখা দেয়।

অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সম্পর্কে হ্যারড-ডোমারের যে মডেল তাতে বলা হয়েছে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার নির্ণয় করে যেসব মূল সূচক, সঞ্চয়ের হার এর অন্যতম।

সেই তত্ত্ব মতে, একটি দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নির্ভর করে সেই দেশের শ্রম ও মূলধনের পরিমাণের ওপর। উচ্চহারে সঞ্চয়ের মাধ্যমে বিনিয়োগের যে টাকা আসে তা মূলধন তৈরিতে ভূমিকা রাখে। এর ফলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটে।

এতে আরও বলা হয়েছে, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির নিম্নহার এবং উন্নয়নের সঙ্গে মানুষের সঞ্চয়ের নিম্নহারের সম্পর্ক রয়েছে। এতে, নিম্নহারের বিনিয়োগ, কম উৎপাদন ও স্বল্প সঞ্চয়ের একটি দুষ্টচক্র সৃষ্টি হয়।

মডেলটির মতে, অর্থনৈতিক উন্নয়ন নির্ভর করে সঞ্চয় বাড়ানোর মাধ্যমে বিনিয়োগ বাড়ানোর কৌশলের ওপর। আর সেই বিনিয়োগকে দক্ষতার সঙ্গে কাজে লাগাতে হয় প্রযুক্তিগত উন্নতির সহায়তা নিয়ে।

দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগের পরিমাণ নির্ধারণে সঞ্চয় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, তাই স্বল্পমেয়াদে দ্রুত সঞ্চয় বেড়ে গেলে তা ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতা সঙ্কুচিত করে দেয়। এর ফলে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেওয়ারও সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়।

দেশে পণ্য ক্রয়ের অধিকাংশ ক্ষেত্রে গত তিন বছর যে চমৎকার প্রবৃদ্ধি ছিলো তা এখন নিম্নমুখী। তাই এখনই সঞ্চয় বাড়ানোর নীতি অনুসরণ করা দরকার, যাতে দেশের অর্থনীতির পালে হাওয়া লাগে।

একই সঙ্গে মনে রাখতে হবে, হঠাৎ সঞ্চয় বেড়ে যাওয়ার মানে এই নয় যে একই ধারায় বিনিয়োগ বাড়বে। কেননা, ব্যাংকগুলো তাদের সঞ্চয়ের প্রবৃদ্ধি দেখালেও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে টাকা লগ্নি করতে তারা গড়িমসি করবে। ততোক্ষণে দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক ভাব দেখা দিবে।

অপরদিকে, অর্থনৈতিক মন্দার সময় প্রতিষ্ঠানগুলো বিনিয়োগ করতে নাও চাইতে পারে। যদি না ব্যাংকগুলো সুদের হার কমিয়ে টাকা বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী আশদীন হোসেন ছয়মাস আগে পাওয়া তার খণ্ডকালীন চাকরির বেতনের অর্ধেক টাকা সরিয়ে রাখেন। তিনি সেই টাকা রাখেন স্থানীয় একটি ব্যাংকে। সেখানে তিনি উচ্চহারে সুদ পান। সেই জমানো টাকা থেকে তিনি একটি দামি মোবাইল ফোন কেনার আশা করেন।

কিন্তু, ব্যাংক তার সুদ থেকে আয়ের ১৫ শতাংশ কর হিসেবে কেটে নিয়েছে। তার প্রতি খুবই অন্যায় আচরণ করা হয়েছে। কেননা, আশদীনের বার্ষিক আয় এখনও আড়াই লাখ টাকার অনেক নিচে।

শুধু তাই নয়। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট সচল রাখতে অ্যাকাউন্ট মেইন্টেনেন্স ফির ওপর তাকে আরও ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হবে।

তাই আক্ষেপ করে তিনি বলেন, “আমি এখন ব্যাংকে টাকা রাখার কোনো যৌক্তিকতা খুঁজে পাই না। এর চেয়ে বরং আমার বিছানার তোষকের নিচে টাকা রাখাই ভালো।”

তিনি যখন জানতে পারেন যে আমদানিকৃত মোবাইল ফোনের ওপর আরোপিত শুল্ক ১৫ থেকে ২০ শতাংশ বাড়ানোর ফলে এর দাম চলতি অর্থবছর থেকে আরও বেড়ে গেছে তখন তার সঞ্চয় করার বাকি আগ্রহটুকুও নষ্ট হয়ে যায়।

এছাড়াও, নতুন বাজেটে হঠাৎ করে আশদীন দেখলেন যে আয়েশার মতো তারও টাকা সঞ্চয় করার ক্ষমতা কমে গেছে। কেননা, তিনি প্রায়শই যেসব পণ্য কিনতেন বা সেবা নিতেন যেমন রাইড-শেয়ারিং, মোবাইল ফোন ব্যবহার ইত্যাদির দাম বেড়ে গেছে।

১৮ বছর বয়সী এই শিক্ষার্থীর ভাষায়, “এমন পরিস্থিতিতে আমি এখন মাসে ৩ হাজার টাকা সঞ্চয় করতে পারলেই খুশি।”

আয়েশাও তাই ভাবেন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি বললেন, “সরকারের এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষার জ্বালা সবসময় মধ্যবিত্তকেই নিতে হয়।”

জিনা তাসরীন, সিনিয়র সাব-এডিটর, দ্য ডেইলি স্টার

Comments

The Daily Star  | English

JP central office vandalised, set ablaze

A group of unidentified people set fire to the central office of Jatiyo Party in Dhaka's Kakrail area this evening

1h ago