সম্ভাবনার বাংলাদেশ ও বেকারত্ব
বাংলাদেশের বেকারত্বের সমস্যা নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে লিখতে ইচ্ছে হচ্ছিলো। বেশ কিছু সময় বেকার ছিলাম বলেই বোধ হয় নিজের মধ্যে এমন তাড়না।
অন্য আর সবকিছুর মতোই এই বেকারত্ব নিয়ে বাংলাদেশ দুটি ভাগে বিভক্ত। একটি বিশেষ গোষ্ঠীর মানুষ মনে করেন বাংলাদেশে বেকারত্বের কোনো সমস্যাই নেই, এতো এতো কর্মসংস্থান যে তুলনামূলক কম লাভের কাজ করার লোকই নাকি খুঁজে পাওয়া যায় না। আবার অপরদিকে আরেক দল মনে করে দেশে দিন দিন বেকারত্বের সমস্যা গুরুত্বর হচ্ছে। শিক্ষিত, স্বল্প শিক্ষিত এবং অশিক্ষিত বেকার ধীরে ধীরে বেড়েই চলছে।
আমি দ্বিতীয় দলের পক্ষে, তবে এর পেছনের কারণ না ভেবে এক তরফা দোষ চাপানোর পক্ষে নই।
কয়েক বছর আগে দেশে সামিট ও কনফারেন্সের ধুম পড়ে গিয়েছিলো। সেখানে গেলে মানুষ অনুপ্রেরণা নিয়ে ঘরে ফিরতে পারতো। কিন্তু, গত কয়েক বছরে সেই অনুপ্রেরণাদায়ক সামিট বা সম্মেলনগুলোর জায়গা করে নিচ্ছে চাকরি মেলা বা জব ফেয়ার। অনেকেই অনেক নামে ডাকেন। বিগত কয়েক বছরে এমন বেশ কয়েকটি শীর্ষ স্থানীয় চাকরির মেলার আয়োজকদের সাথে কাজ করার সুযোগ হয়েছে আমার। সেখানে দেখা এবং সেখান থেকে শিক্ষা নেওয়া কিছু বিষয় তুলে ধরার জন্যই আজকে লিখতে বসা।
এই চাকরির মেলাগুলো বেশ ঘটা করেই আমাদের তরুণ শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষত যারা সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশুনার পাট চুকিয়ে বের হয়েছেন তাদের জন্য আয়োজন করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে এসব শিক্ষার্থীদের জন্য সরাসরি একটি সুযোগ তৈরি করে দেওয়াই নাকি উদ্দেশ্য। প্রতিটি মেলাতেই বিশেষত শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলো অংশগ্রহণ করে। উদ্দেশ্য এবং চেষ্টা দুটিই শতভাগ দেখা গেলেও আসলে কতোটুকু লাভবান হচ্ছে আমাদের তরুণরা- এসব কার্যক্রম থেকে তা গুরুত্ব দিয়ে দেখার প্রয়োজন আছে।
লাভের অংক খুব বেশি হবে বলে আমার মনে হয় না। এর পেছনে বেশকিছু কারণ রয়েছে। এর মধ্যে একটি হলো, অংশগ্রহণকারী অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানই মেলাগুলোতে কোনো ধরণের ‘খালি পদ’ বা সুযোগ ছাড়াই শুধুমাত্র নাম দেখানোর জন্য আসে। এরা এসে শত শত সিভি নিয়ে যায়, যা অনেকাংশেই সরাসরি তাদের স্টোর রুম বা ময়লার ঝুড়িতে জায়গা পায়। কিছু অসাধারণ যদি পেয়েও যায়, হয় সেটা রেখে দেয় ভবিষ্যতের জন্য, নয়ত তৎক্ষণাৎ কোনো রকমে তাকে একটা সুযোগ করে দেয়। আর দ্বিতীয়ত, হাতে গোনা অল্পকিছু আয়োজকই রয়েছেন যারা তরুণদেরকে এসব আয়োজনের জন্য প্রস্তুত করার প্রয়োজন বোধ করেন। একজন শিক্ষার্থী এই মেলায় এসে সরাসরি চাকরিদাতার সাথে কথা বলার সুযোগ পায়, কিন্তু জানে না কী বলবে বা কীভাবে বলবে। তাদের এ ব্যাপারে তৈরি করাও যে একটি দায়িত্বের মধ্যে পড়ে সে ধারণা আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা সেসব আয়োজক- কারো মধ্যেই তেমন লক্ষ্য করা যায় না। সবাই যেনো রয়েছেন নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাভিত্তিক সফলতা নিয়ে।
সম্প্রতি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ালেখার মান নিয়ে করা আমার নিজস্ব একটি জরিপের কিছু ফলাফল তুলে ধরছি।
শিক্ষার্থীদের জিজ্ঞাসা করেছিলাম, বিশ্ববিদ্যালয় তাদেরকে চাকরির বাজারের জন্য তৈরি করায় কতোটা ভূমিকা রাখছে বলে তারা মনে করেন? আশঙ্কাজনকভাবে প্রায় ৭০ শতাংশ (৩৬ দশমিক ৪ শতাংশ না, ৩৪ দশমিক ১ শতাংশ হয়ত) শিক্ষার্থীই মনে করে তাদের চাকরি বাজারের জন্য তৈরিতে তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তেমন কোনো অবদান নেই অথবা এ ব্যাপারে তার নিশ্চিত নয়।
এছাড়াও তাদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিলো যে, তাদের পাঠ্যসূচি একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কতোটা সহায়ক, এখানেও প্রায় ৭৫ শতাংশ (৫৪ দশমিক ৫ শতাংশ না, ২০ দশমিক ৫ শতাংশ হয়ত) শিক্ষার্থীর মতামত আশঙ্কাজনক।
জরিপে জানা যায়, আমাদের দেশের অধিকাংশ শিক্ষার্থীর মতেই আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোতে নেই, নিজেকে উপস্থাপন করার প্রস্তুতি, প্রয়োজনীয় সফটওয়ারের ব্যবহার, নৈতিকতা ও মূল্যবোধ, সমস্যা সমাধান, দলীয় কাজ ও সূক্ষ্ম চিন্তাবিষয়ক কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। এছাড়াও একটি বৃহৎ অংশ মনে করে- দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় সবচেয়ে বড় বাধা হলো আমাদের পাঠ্যসূচি এবং শিক্ষকের মান।
এই জরিপের ফলাফল তুলে ধরার একটা বড় উদ্দেশ্য হলো, আমি কেনো এই দ্বিতীয় দলের পক্ষে সেটা প্রমাণ করা। কারণ এই জরিপে অংশ নেওয়া ৬৮ দশমিক ৩ শতাংশ (৩১ দশমিক ৭ শতাংশ স্নাতক এবং ৩৬ দশমিক ৬ শতাংশ স্নাতকোত্তর) শিক্ষার্থী হলেও ৭৫ দশমিক ৬ শতাংশ শিক্ষার্থী বেকার।
এছাড়াও রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার, ঘুষসহ নানাবিধ কারণে আমাদের বেকারত্বের সমস্যা ধীরে ধীরে ঘনীভূত হচ্ছে।
শিক্ষার্থীদের যোগ্যতার পাশাপাশি এই বেকারত্বের আরেকটা কারণ রয়েছে। আর সেটি হলো, কাজের অভাব এবং আমাদের শিক্ষার্থীদের মধ্যে উদ্ভাবনী শক্তি বাস্তবায়নে সহযোগিতার অভাব। এই সহযোগিতার অভাবটি যথাযথ কর্তৃপক্ষের এবং আমাদের তরুণদের মধ্যে নিজস্ব সমন্বয়ের অভাবের কারণে তৈরি হয়।
একটু ব্যাখ্যা করা যাক। ধরুন, আপনার কাছে দেশের যানজট দূর করার জন্য কোনো উদ্ভাবনী পরিকল্পনা আছে।
প্রথমত, বিপদ হবে, তা বাস্তবায়ন করতে আপনি অর্থের অভাবে পড়বেন। পাশাপাশি আপনাকে আসল জায়গায় তা বাস্তবায়নের সুযোগ দেওয়া হবে না এবং দিন শেষে আপনার ঐ পরিকল্পনাটি খাতা-কলমে অথবা সর্বোচ্চ কোনো একটা পাইলট বা প্রাথমিক পর্যায়ে থেকে যাবে।
দ্বিতীয়ত, যদি আপনি কিছু অর্থ এবং সুযোগ পেয়ে যান দেখবেন আপনার সাথে কেউ নেই। এই পরিকল্পনার কথা জানাজানি হওয়া মাত্র প্রায় একই ধরণের কোনো পরিকল্পনা নিয়ে অন্য কেউ একজন আবার অর্থ আর সুযোগের খোঁজে নেমে গেছে। এভাবে একই সমস্যা সমাধানের হাজার উদ্ভাবনী পরিকল্পনা এবং তরুণ উদ্যোক্তা খুঁজে পাবেন, তবে তাদের পরিকল্পনার বাস্তবায়ন খুঁজে পাবেন না। সবাই কিছু না করে বসে থাকবে, তবু সবাই এক সাথে একটি সম্মিলিত পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবে না।
বাংলাদেশের বেকারত্ব সমস্যার প্রভাব শুধুমাত্র যে আমাদের চাকরি বাজারের উপরই পড়ছে তা কিন্তু না। আপনি যখন এতো সংখ্যক জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগাতে পারবেন না, তখন তারা জীবনযাপনের জন্যই হোক, আর সময় কাটানোর জন্য হোক, নিজের কাজ নিজে খুঁজে নিবে। যা কী না সমাজে অপরাধ, অরাজকতা বৃদ্ধি করবে।
একটা গল্প বলি, দুই বছর আগে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং করা এক ছেলে আট মাস আগে বাড়ি থেকে এসেছে চাকরির সন্ধানে। দুই মাস খুঁজে কিছু পায়নি এবং বাসা থেকে বারবার এ ব্যাপারে চাপ ও প্রশ্ন আসার কারণে সে বলতে বাধ্য হয়েছে যে তার একটা চাকরি হয়েছে। কিন্তু, এরপর আরো ছয় মাস পার হয়ে যাওয়ার পরেও সে কোনো কাজ যোগার করতে পারেনি। কিন্তু, প্রত্যেক মাসে একজন চাকরিজীবী হিসেবে বাড়িতে টাকা পাঠানোসহ নিজের থাকা, খাওয়ার ব্যবস্থাও করতে হচ্ছে। চাকরি পাওয়ার ভরসায় তার জন্য বিয়ের কথাবার্তাও চলছে।
এই গল্পটি বাস্তব, এবং আপনাদের আশেপাশে তাকালে অনেক খুঁজে পাওয়ার কথা। শুধু একবার নিজেকে এই চরিত্রটির জায়গায় কল্পনা করে দেখুন কী অসহায় তার দিন যাপন।
এই সমস্যা আমাদের ভবিষ্যতের জন্য গুরুতর অশনি সংকেত। এর সমাধানের জন্য অতি দ্রুত সংশ্লিষ্ট সবাইকে এক সঙ্গে নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। যেখানে দেশের শিক্ষার্থীরা বলছে- তাদের পাঠ্যসূচি সময়ের সাথে তাল মেলানোর যোগ্যতা রাখে না, পাশাপাশি তাদেরকেও যোগ্য করে তুলছে না, সেখানে এই পাঠ্যসূচিতে পরিবর্তন, পরিবর্ধন আবশ্যিক। শিক্ষার্থীদের ক্লাসরুম থেকেই যেনো চাকরিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করা যায়, সে জন্য প্রয়োজন পাঠ্যসূচিতে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের অবস্থান। এছাড়াও, শিক্ষাব্যবস্থাকে রাজনীতিমুক্ত করণের পাশাপাশি এর সামগ্রিক পরিবেশ শিক্ষাবান্ধব হওয়া জরুরি।
যে একটি বিষয় নিয়ে আলাদাভাবে বলতে হয় তা হচ্ছে, আমাদের শিক্ষকদের মান। একজন শিক্ষকের কাজ শুধুমাত্র ক্লাসে এসে বক্তব্য দেওয়া না। বক্তব্য থেকে শেখা যায় তবে বক্তব্য আর পাঠদান এক জিনিস না। পাঠদান হতে হবে অংশগ্রহণমূলক ও আলোচনাভিত্তিক। পাওয়ার পয়েন্টের উপর ভিত্তি করে মুখস্থ নির্ভর শিক্ষা থেকে আদর্শ শিক্ষার্থী তৈরি হয় না। পাঠদান হওয়া দরকার অনুপ্রেরণাদায়ক। অনুপস্থিতির কারণে ফেল করা থেকে বাঁচার জন্য ক্লাসে না এসে সবাই শেখার জন্যে যেনো ক্লাসে আসেন সে ব্যাপারে আমাদের শিক্ষকদের সচেতনতা জরুরি।
আমার দুটি ক্লাসের উদাহরণ দিতে পারি এখানে। আমার একটি ক্লাস ছিলো যেখানে পাবলিক স্পিকিং শেখানো হতো। এক ঘণ্টা ২০ মিনিটের প্রতি ক্লাসে শিক্ষক এসে অন্তত ১ ঘণ্টা নিজে কথা বলতেন, বাকি সময় আনুষঙ্গিক বিষয়ে কথা বলতে পার হয়ে যেতো। পুরো সেমিস্টারে একজন শিক্ষার্থী মাত্র ১০ মিনিট কথা বলা ও একবার তার বক্তৃতার বিষয় নিয়ে লেখার সুযোগ পেয়েছে। অথচ ঐ বিষয়ের উদ্দেশ্য না কী ছিলো শিক্ষার্থীদের কথা বলা ও বিষয়ভিত্তিক লেখার মান বৃদ্ধি করা। ক্লাসে শিক্ষক আনুমানিক ৭০ শতাংশ সময় বক্তব্য দেওয়া শেখালেও শিক্ষার্থীদের ইংরেজিতে বক্তব্য দেওয়ার বিধি ছিলো। বাংলায় একজন অসাধারণ বক্তাও হয়ত ভাষার কারণে পিছিয়ে পরবেন।
অপরদিকে, আমার আরেকটি ক্লাস ছিলো মিডিয়াতে ব্যবহৃত গল্পের ব্যাখ্যা করা এবং তা বুঝতে পারা নিয়ে। টানা তিন ঘণ্টার ক্লাসে অনেক সময় বিরতিহীনভাবেই সবাই বসে থাকতো, আলোচনা হতো। শিক্ষার্থীদের আলোচনা থেকেই উঠে আসতো কীভাবে একই জিনিস মানুষ ভিন্ন ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করে। এরপর শুধু ব্যাখ্যা করার সে পদ্ধতিগুলোকে সংজ্ঞায়ন করা হতো। সিনেমার প্রতি কম আগ্রহী একজনও হয়ত সেখান থেকে অনেক তথ্য ও ধারণা নিয়ে বের হয়েছেন।
বেকারত্ব আছে কী নেই, সে নিয়ে আমাদের বিতর্ক অমূলক। বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে; সাথে আমাদের দেশও। এই এগিয়ে যাওয়ার পথে অন্যতম বাধা হয়ে আছে এবং থাকবে এই বেকারত্ব- এ কথা স্বীকার না করায় কোনো বীরত্ব নেই। এ সমস্যা সমাধানে এখনই কার্যকরী কোনো সমাধান নিতে না পারলে আজ থেকে কয়েকবছর পর আমরা পিছিয়ে পরবো আরো অনেক দূরে।
মুতাসিম বিল্লাহ, সমাজকর্মী
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)
Comments