ব্রয়লার মুরগিতে সীমাবদ্ধ যাদের কোরবানির আনন্দ

হাঁড়িতে রান্না করা রয়েছে ব্রয়লার মুরগি। ঈদের দিনে মাংস বলতে এটুকুই জুটেছে লাভলি বেগমের পরিবারের। ছবি: স্টার

একটা ছোট অ্যালুমিনিয়মের হাড়ির তলায় ঠেকে আছে কয়েক টুকরো রান্না করা মাংস। গরু বা খাসির নয়, ব্রয়লার মুরগীর মাংস। এটুকুতেই মোহাম্মদ পলাশের কোরবানি ঈদের আনন্দ সীমাবদ্ধ।

রাজশাহী শহরের উপকন্ঠে পবা উপজেলার বালিয়ায় একটি আম বাগানের পূর্ব দিকে এক সারি টিনের ঘর। এগুলোর একটির মালিক মোহাম্মদ পলাশ। তিনি জানালেন ওই জায়গাটিতে যে ৩৫টি পরিবার বাস করে তাদের অবস্থা তার থেকে ভিন্ন কিছু নয়।

সকাল ১১টার দিকে যখন রাজশাহী শহর থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে বালিয়ার দিকে যাচ্ছিলাম, তখন দেখা গেল, শহরের প্রতিটি বাড়িতে, রাস্তার ওপরে, সুউচ্চ বিল্ডিংগুলোর গ্যারেজে একই স্থানে একাধিক পশু কোরবানি হচ্ছে। মনে হচ্ছিল যেন এক ধরনের প্রতিযোগিতা চলছে। শহর থেকে যত দূরে যাচ্ছিলাম কোরবানির সংখ্যাও কমছিল। এবং বালিয়া গ্রামের মোহাম্মদ পলাশদের ওই বসতিতে গিয়ে দেখা গেল একটি পশুও কোরবানি করা হয়নি সেখানে।

এই বসতির সকলেই দিনমজুর। কেউ রাজমিস্ত্রির সাথে কাজ করেন কেউ ভ্যান বা রিক্সা চালান।

এই ৩৫ পরিবারের কেউই কোরবানি দিতে পারেননি। তাদের অনেকেই অতীতেও কখনো কোরবানি করতে পারেননি। কিন্তু আগে সমাজের অবস্থাপন্ন পরিবারগুলোর সঙ্গে তারা অন্তত ঈদের দিনটাতে মিশে যেতেন। অন্যের কোরবানির পশুর চামড়া ছাড়ানো ও মাংস কাটার কাজ করে মাংসও পেতেন। আনন্দের ভাগাভাগিতে ভালই কাটত তাদের ঈদ।

তখন তারা বাস করতেন শহরের জিয়া নগরে যেখানে একটি আইটি পার্ক নির্মাণের জন্য প্রায় এক হাজারেরও বেশি পরিবারকে উচ্ছেদ করা হয়েছে গত জানুয়ারিতে। উচ্ছেদের পর তাদের কাউকে ৫০,০০০ কাউকে ৭০,০০০ টাকার চেক ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

ওই বসতিতে গিয়ে দেখা গেল আটত্রিশ বছর বয়স্ক মোহাম্মদ পলাশ একটি আম গাছে হেলান দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়েছিলেন। হাত দিয়ে ইশারা করতেই কাছে এলেন।

আপনার ঈদ কেমন চলছে জানতে চাইলে তিনি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। পরে বললেন, “আলাদা কিছু না, অন্যদিনের মতোই।”

ঈদের আগের দিন বালিয়া বাজারে মাইকিং করে ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছিল, বাজারদরের চেয়ে কমে। সেখান থেকে তিনি নব্বই টাকা দরে দুই কেজি ওজনের একটা মুরগি কিনে এনেছেন। মুরগির কিছু অংশ প্রতিবেশিদের বিলিয়ে বাকিটা নিজেদের জন্য রান্না করেছেন।

“আগে যেখানে ছিলাম সেখানে অবস্থাপন্ন মানুষদের সাথে একই সমাজভুক্ত ছিলাম। কিন্তু নতুন জায়গায় এসে আমরা কোন সমাজের অন্তর্ভুক্ত হতে পারিনি।”

জিয়ানগরে বসবাস করার সময় আদালত চত্বরে একটা চায়ের দোকান ছিল তার। উচ্ছেদের দিন যখন তার বাড়ি বুলডোজার দিয়ে ভাঙা হচ্ছিল তখন তিনি স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। সুস্থ হলে তিনি জানতে পারেন তার চায়ের দোকানটিও উচ্ছেদ হয়েছে। সেই থেকে তিনি বেকার।

“ক্ষতিপূরণের টাকা দিয়ে একটা জমিও কেনা যায় নাই। এখন যে জমিতে বাস করছেন সে জন্য লাগবে দেড় লাখ টাকা। জমির মালিক ভালো বিধায় এখানে বসবাস করতে পারছি।”

“বেঁচে থাকার চেষ্টাই আমাদের কাছে প্রধান। কোরবানি করা একটা দুঃস্বপ্ন,” পলাশ বলছিলেন।

ওই বসতির একদল নারী এক কোনে দাঁড়িয়ে গল্প করছিলেন। তারা জানান তাদের বাড়ির পুরুষেরা শহরে গেছেন, কোরবানিতে কসাইয়ের কাজ করে মাংস আনবেন সেই আশায় তারা অপেক্ষা করছিলেন।

বালিয়া থেকে শহরের দিকে নবগঙ্গা গ্রামে একটি জায়গায় ৪২টি জেলে পরিবার বাস করে। সেখানে গিয়ে জানা গেল দু-একজন বাদে তাদের অনেকেরই পরিবারে ব্রয়লার মুরগিতেই কোরবানির আনন্দ সীমাবদ্ধ।

লাভলি বেগম দেখালেন একটি হাড়িতে সেমাই রান্না করে ঢাকনা দিয়ে ঢেকে রেখেছেন। একটি বাটখারা দিয়ে ঢাকনা চাপা দিয়ে রেখেছেন যাতে বিড়াল না মুখ দেয়। আরেকটি হাড়িতে রেখেছেন মুরগির মাংস।

তার স্বামী ও তিন মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে ভাত আর মুরগির মাংস দিয়ে সকালের নাস্তা করেছেন। তিন মেয়ে পদ্মা পাড়ে বাড়ির সামনে খেলছিল। স্বামী আনোয়ার হোসেন বিদ্যুৎ গেছেন তাদের সমাজের কোরবানিতে কাজ করার জন্য।

আরেক জেলে মিনারুলের বাড়িতে ঈদ উপলক্ষে তার মেয়ে-জামাই বেড়াতে এসেছে। মিনারুল তার স্ত্রীকে নিয়ে যে ঘরে থাকেন সেই ঘরটি মেয়ে-জামাইয়ের জন্য ছেড়ে দিয়েছেন। কিন্তু এর বেশি তার কী করার আছে? তিনিও একটা ব্রয়লার মুরগি কিনেছেন।

মিনারুল বলছিলেন, প্রতিদিন নৌকা নিয়ে পদ্মায় মাছ ধরতে গিয়ে তাদের খরচ হয় কমপক্ষে ৩০০ টাকা। কিন্তু বেশিরভাগ দিনই তাদের মাছ ছাড়াই ফিরে আসতে হয়। আবার যেদিন কিছু ধরা পড়ে, সেদিন মাছ বিক্রি করে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকার বেশি পাওয়া যায় না। এ টাকায় কোনো মতে তাদের সংসার চলে।

মিনারুল বলেন পদ্মায় যখন ইলিশ আসে তখন মাছ ধরা নিষেধ থাকে, আবার যখন নিষেধাজ্ঞা উঠে যায় তখন আর পদ্মার ইলিশের দেখা মেলে না।

তিনি জানান, পিওলি বা বাঁশ-পাতা মাছ ধরার জন্য কারেন্ট জাল লাগে, কিন্তু এ জাল ব্যবহারে আবার নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।

রাজশাহীর পদ্মায় নতুন নৌ-পুলিশ কার্যক্রম শুরু করাতে তাদের হয়েছে আরেক অসুবিধা। তিনি বলেছেন ঈদের কয়েকদিন আগে নৌ-পুলিশ তাদের দপ্তরে জেলেদেরকে ডেকে নিয়ে বলেছেন যে লাইফ জ্যাকেট ব্যবহার করতে হবে।

“আমরা গরীব মানুষ আমরা ঠিক মতো খেতেই পাই না। লাইফ জ্যাকেট কিনব কিভাবে?”

মিনারুল বলেছেন কোরবানি ঈদে তাদের একটি সুবিধাও আছে।

সেটি হল এলাকায় যারা পশু কোরবানি করেন তারা তাদের কোরবানির পশুর মাংসের তিন ভাগের এক ভাগ সমাজপ্রধানকে দেন। এবং সমাজ প্রধান যারা কোরবানি দিতে পারে না তাদের তালিকাভুক্ত করে তাদের পরিবারের সদস্যসংখ্যা অনুপাতে ওই মাংস ভাগ করে দেন।

Comments

The Daily Star  | English
Nat’l election likely between January 6, 9

EC suspends registration of AL

The decision was taken at a meeting held at the EC secretariat

9h ago