অবৈধভাবে বালু উত্তোলনে মারা যাচ্ছে রত্নাই নদী
মাত্র দুইশ মিটার পশ্চিমে রত্নাই নদীতে জলস্রোত বহমান থাকলেও পূর্বদিকে খণ্ড-বিখণ্ড হয়েছে নদীটি। জলস্রোত বহমান রত্নাইয়ের স্রোত থেমে গেছে এখানে।
স্থানীয় কিছু অসাধু স্বার্থান্বেষী মানুষ কয়েকটি ড্রেজার মেশিন বসিয়ে রাতদিন বালু উত্তোলন করছেন। লালমনিরহাট সদর উপজেলার দুড়াকুটি গ্রামে রত্নাই নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের কারণে ভাঙছে নদীর পাড়। ফলে নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে কৃষকের আবাদি জমি।
শুধু তাই নয়, অবৈধভাবে উত্তোলন করা বালু পরিবহনের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে কয়েকটি ট্রাক। আর ট্রাকগুলো চলাচলের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধ কেটে তৈরি করা হয়েছে রাস্তা। স্থানীয়রা প্রতিবাদ করার সাহস পান না। কেউ যদি সাহস করে প্রতিবাদ করেন, তাহলে তাকে দেওয়া হয় অস্ত্রের হুমকি।
দুড়াকুটি গ্রামের কৃষক সুরত আলী জানান, গেল একমাস ধরে প্রকাশ্যে ৭-৮টি ড্রেজার মেশিন বসিয়ে রত্নাই নদী থেকে সারাক্ষণ বালু উত্তোলন করছে একটি চক্র। সরকারি দলের রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় তারা দুঃসাহসী হয়ে উঠেছে। এসব বন্ধে প্রশাসনেরও তেমন কোনো জোরালো ভূমিকা নেই।
“নদী পাড়ে আমার তিন বিঘা জমি ভেঙেছে, কিন্তু আমি নিরুপায়। বালু উত্তোলকদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সাহস নেই আমার,” বলেন সুরত আলী।
একই গ্রামের কৃষক এলাহী মিয়া জানান, তার বিঘা পরিমাণ আবাদি জমি ইতিমধ্যে বিলীন হয়ে গেছে নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের কারণে।
“আমরা স্থানীয় ভূমি তহশিলদারকে জানিয়েছি, কিন্তু তিনি নিশ্চুপ থাকেন রহস্যজনক কারণে। প্রশাসনের হস্তক্ষেপ ছাড়া এ অবৈধ কাজ ঠেকানো সম্ভব নয়,” বলেন তিনি।
স্থানীয় দিনমজুর মহির আলী অভিযোগ করে বলেন, “প্রতিবাদ করায় বালু উত্তোলকরা মিলে বাড়িতে ঢুকে আমাকে মারতে এসেছিলো। ধারালো অস্ত্র উঁচিয়ে হুমকি দিয়ে বলেছে- এরকম সাহস দেখালে আমাকে চরম মূল্য দিতে হবে।”
“আমরা নিরুপায়, অসহায়। নদী থেকে অবৈধভাবে বালু তুলছে, বাঁধ কেটে রাস্তা করছে। সব কিছুই প্রকাশ্যে হচ্ছে,” এমনটি জানিয়ে তিনি আরও বলেন, “অবৈধভাবে বালু উত্তোলন আর বাঁধ কাটার ফলে আমাদের বন্যার সময় চরম কষ্ট করতে হয়।”
“বাঁধ কাটার কারণে আমাদের চলাচলে কষ্ট হচ্ছে আর বন্যার সময় বাড়ি ঘরে পানি উঠে। আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি,” বলেন ওই গ্রামের বাসিন্দা আসমা বেগম।
তিনি আরও বলেন, “ড্রেজার মেশিনের বিকট শব্দে বাড়িতে ঠিকমতো থাকতে পারি না, রাতেও শান্তিতে ঘুমাতে পারি না।”
স্থানীয় নুর হোসেন জানান, অবৈধভাবে বালু উত্তোলন হত্যা করছে প্রিয় রত্নাই নদীকে। প্রভাবশালীদের নোংরা প্রভাবে খণ্ড-বিখণ্ড হচ্ছে রত্নাই। বহমান রত্নাই অনেকটাই নিরীহ হয়ে যাচ্ছে।
“নদী না বাঁচলে আমরা বাঁচবো কী করে। নদীকে বাঁচাতে হবে, কিন্তু কার হাতে এই দায়িত্ব,” এমন প্রশ্ন তুলে তিনি জানান, প্রভাবশালী বালু উত্তোলকদের ভয়ে স্থানীয়রা কম্পিত। তাই হচ্ছে না কোনো প্রতিরোধ।
“স্থানীয় ভূমি তহশিলদার রফিকুল ইসলাম জড়িয়ে গেছেন বালু উত্তোলকদের সঙ্গে। তাই ব্যবস্থা গ্রহণে তিনি কোনো ভূমিকা রাখছেন না। উপরন্তু ভ্রমমাণ আদালতের অভিযানের আগেই তিনি বালু উত্তোলকদের মেশিন সরিয়ে ফেলার বার্তা পৌঁছে দেন”, এমন অভিযোগ স্থানীয় বাসিন্দা আদম আলীর।
তিনি জানান, প্রায় এক কিলোমিটার জুড়ে রত্নাই নদী থেকে নির্বিঘ্নে অবৈধভাবে ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে।
বালু উত্তোলক সিন্ডিকেটের একজন দুড়াকুটি গ্রামের জব্বার আলীর সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, তিনি একাই নন আরও দশজন রয়েছেন বালু উত্তোলনের সঙ্গে।
“লালমনিরহাট- মোগলহাট সড়কের কাজ হচ্ছে। সেখানে অনেক বালুর প্রয়োজন। তাই নদী থেকে বালু উত্তোলন করে দেশের উন্নয়নে সহযোগিতা করছি,” বালু উত্তোলক এক জনের এমন মন্তব্যের ব্যাপারে তার কাছে জানতে চাওয়া হলে বিষয়টি স্থানীয় ভূমি তহশিলদার জানেন বলে উল্লেখ করেন তিনি।
মোগলহাট ইউনিয়নের ভূমি তহশিলদার রফিকুল ইসলাম অভিযোগ অস্বীকার করে জানান, তিনিও বালু উত্তোলকদের কাছে অসহায়। নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের তথ্য সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে।
লালমনিরহাট সদর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) জি আর সারোয়ার জানান, গেল ৬ আগস্ট সন্ধ্যায় তিনি ভ্রমমাণ আদালত চালিয়ে দুটি ড্রেজার মেশিন নষ্ট করে দিয়েছেন। তবে ঘটনাস্থলে কোনো বালু উত্তোলনকারীকে পাওয়া যায়নি।
এ ঘটনার পরদিন থেকেই পুরোদমে রত্নাই নদী থেকে ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু উত্তোলন চালু করা হয়েছে, এমন প্রশ্নে তিনি জানান, বিষয়টি তিনি জানেন না। ইউনিয়ন ভূমি তহশিলদারের সংশ্লিষ্টতা থাকার বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে। রত্নাই নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধ করে নদীকে রক্ষা করবেন বলেও জানান তিনি।
লালমনিরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী বজলে করিমের সঙ্গে কথা হলে তিনি এ বিষয়ে অবগত নন বলে জানান। তবে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন ও বাঁধ কেটে রাস্তা তৈরির ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করবেন বলে জানান।
তিনি বলেন, “বাঁধ কেটে রাস্তা তৈরি করলে সেটা হবে বন্যা ও নদী ভাঙ্গনের জন্য চরম হুমকি।”
ড্রেজার মেশিনে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধ করে রত্নাই নদীকে রক্ষা করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
এস দিলীপ রায়, দ্য ডেইলি স্টারের লালমনিরহাট সংবাদদাতা
Comments