প্রশাসন ও সাধারণ: দায় নিয়ে দায়িত্বহীনতা

নানা রকম সমস্যায় জর্জরিত বাংলাদেশ, তার সঙ্গে নানা মতে বিভক্ত এর জনগণ। প্রত্যেকটি বিষয় নিয়ে কথা বলতে চাওয়া জনগণ দিন শেষে হয়ে যায় নিভে যাওয়া আগুনের ধুঁকতে ধুঁকতে জ্বলা কয়লার মতো। কোথায় যেনো এক তীব্র শক্তি আছে কিন্তু জ্বলে উঠছে না। তাই কেনো যেনো সমাধা হতে হতেও শেষ হয় না আমাদের সমস্যাগুলো। কোথায় যেনো একটু ঘাটতি, একটু বুঝতে পারার অভাব, একটু পরিকল্পনার অভাব, যার ফলাফল, যেখান থেকে শুরু ঘুরে এসে সেখানেই শেষ।
father with dengue patient
রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত সন্তানকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন বাবা। ছবি: স্টার ফাইল ফটো

নানা রকম সমস্যায় জর্জরিত বাংলাদেশ, তার সঙ্গে নানা মতে বিভক্ত এর জনগণ। প্রত্যেকটি বিষয় নিয়ে কথা বলতে চাওয়া জনগণ দিন শেষে হয়ে যায় নিভে যাওয়া আগুনের ধুঁকতে ধুঁকতে জ্বলা কয়লার মতো। কোথায় যেনো এক তীব্র শক্তি আছে কিন্তু জ্বলে উঠছে না। তাই কেনো যেনো সমাধা হতে হতেও শেষ হয় না আমাদের সমস্যাগুলো। কোথায় যেনো একটু ঘাটতি, একটু বুঝতে পারার অভাব, একটু পরিকল্পনার অভাব, যার ফলাফল, যেখান থেকে শুরু ঘুরে এসে সেখানেই শেষ।

আমাদের দেশে কোনো সমস্যা হলেই একদল গণহারে প্রশাসনের দোষ দিতে থাকেন, আরেকদল খুঁজতে থাকেন জনসাধারণের উপর দোষ চাপিয়ে কী করে প্রশাসনের উপর থেকে চাপ কমানো যায়। দুর্নীতি, যানজট, জলাবদ্ধতা থেকে শুরু করে সর্বশেষ সংযোজন এডিস বা ডেঙ্গু সমস্যা। প্রশাসন ও জনসাধারণের এই দোষারোপের প্রবণতা অনেক পুরনো।

এখানে প্রশ্ন হলো: এই সমস্যা তৈরিতে অবদান ও সমাধানের দায়িত্ব কার? প্রশাসন নাকি জনসাধারণের।

২০১০ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের একটি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানে তরুণদের জন্য নেতৃত্বের গুণাবলী এবং মানুষের ব্যবহারিক ও সামাজিক পরিবর্তনে প্রয়োজনীয় ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও করণীয় নিয়ে প্রশিক্ষণের সঙ্গে জড়িত থাকার সুবাদে এই প্রশ্নের উত্তর নিয়ে অনেক আলোচনা করার সুযোগ হয়েছে। আমাদের প্রশিক্ষণের অন্যতম আলোচ্য বিষয় ছিলো, সামাজিক সমস্যা সমাধানে প্রশাসন ও ব্যক্তি পর্যায়ে নেতৃত্ব চর্চার নানান দিক। চলমান ডেঙ্গু সমস্যাটিকে উদাহরণ হিসেবে নিয়ে সেই আলোচনার কিছু সারাংশ ও শিক্ষা এই লেখায় তুলে ধরতে চাই। উদ্দেশ্য একটাই, আমাদের সমস্যাগুলোর সমাধান করে যেনো আমরা সুন্দর একটি দেশ গড়তে পারি।

সমাজে নানা সময় ঘটে যাওয়া সব ধরণের সমস্যাকে দুভাগে ভাগ করা যায়:

১. টেকনিক্যাল: যে ধরণের সমস্যা অভিজ্ঞ লোকের দ্বারা কিছু কারিগরি সহায়তার মাধ্যমের সমাধান করা যায়। এই ধরনের সমাধানকে বলা হয় টেকনিক্যাল সলিউশন বা ফিক্স অর্থাৎ কারিগরি সমাধান। যেমন, একটি ঘরে যদি লাইট নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে একজন অভিজ্ঞ লোক এনে একটি নতুন লাইট লাগিয়ে নিলেই সমস্যার সমাধান হয়ে গেলো। এ ধরণের সমাধান বা সহায়তা দেওয়া মূলত প্রশাসনের কাজ।

২. এডাপ্টিভ: এগুলো এমন সমস্যা যেগুলোর জন্য শুধুমাত্র অভিজ্ঞ লোক কিংবা কারিগরি সহায়তা যথেষ্ট না। এ ধরণের সমস্যায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে যেমন কারিগরি সহায়তা দিতে হয়, তেমনি এর জন্য সমস্যায় অংশীদার সব মানুষের ব্যবহারিক পরিবর্তনও প্রয়োজন। সমস্যায় জড়িত প্রত্যেকে যদি নিজেদের ব্যবহারিক পরিবর্তন না করেন তাহলে এ ধরণের সমস্যা কখন পরিপূর্ণভাবে সমাধান করা যায় না।

নেতৃত্ব চর্চার জন্য মূলত আমরা দ্বিতীয় ধরণের সমস্যা নিয়ে বেশি কথা বলি। কারণ এই সমস্যা তৈরি ও সমাধানে প্রশাসন ও জনসাধারণ দুই পক্ষই প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ভূমিকা পালন করে।

আমাদের দেশে বর্তমানে ডেঙ্গু নিয়ে যে সমস্যা ও আতঙ্ক দেখা দিয়েছে তা এই দ্বিতীয় ধরণের সমস্যার মধ্যে পড়ে। কারণ ডেঙ্গু নিয়ে বর্তমান পরিস্থিতি তৈরিতে উল্লেখিত দুই পক্ষের বড় অবদান রয়েছে। পাশাপাশি এর সমাধানের জন্যও দুই পক্ষকেই নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করতে হবে।

যখন একটি সমস্যা সামনে আসে তখন সেটির সঠিক পর্যালোচনা দরকার হয়। এর পরে ধাপেই সেই পর্যালোচনার উপর ভিত্তি করে সমাধান নির্ণয় করতে হয়। সমস্যাটি পর্যালোচনায় মূলত দেখতে হয় যে, সমস্যাটিতে কতোটা কারিগরি সহায়তা দেওয়া দরকার আর কতোটা ব্যবহারিক পরিবর্তন প্রয়োজন। এই জায়গাটিতে এসেই মূলত আমরা এবং আমাদের প্রশাসন বড় ভুলটি করে। সমস্যাটির গভীরতা যাচাই করা জরুরি। ঘোরতর জটিল সমস্যায় মানুষের ব্যবহারিক পরিবর্তনের কথা বলা কার্যকরভাবে নেতৃত্ব চর্চায় অমার্জনীয় অপরাধ। এসময় তাৎক্ষণিক কিছু কারিগরি সমাধান দিয়ে সমস্যাটিকে সহনীয় পর্যায় নিয়ে আসতে হয়।

ডেঙ্গু তথা এডিস মশার এই সমস্যা এই মুহূর্তে ঘোরতর জটিল পর্যায় রয়েছে। এই অবস্থায় মানুষের ব্যবহারিক পরিবর্তনের কথা বলা মানে মানুষের কাছে নিজের গ্রহণযোগ্যতা হারানো এবং নিজের কাজকে অবহেলা করার সুযোগ তৈরি করা। এই ধরণের জটিল সমস্যায় তাৎক্ষণিক কারিগরি সহায়তা দিয়ে কিছু সময় কিনতে হয়, যেনো সমস্যার স্থায়ী সমাধানে কাজ করার জন্য আরো বেশি সুযোগ তৈরি হয়। যখন ডেঙ্গু নিয়ে মানুষ চরম মাত্রার আতঙ্কিত তখন প্রশাসনের উচিত ছিলো, সবচেয়ে ভালো মশার ওষুধ ছিটিয়ে, জরুরিভিত্তিতে অভিজ্ঞ ও সাধারণের মিশ্রণে একটি বাহিনী গঠন করে সাথে সাথে মাঠে নেমে যাওয়া। যাতে করে এডিস মশার জন্মস্থান দ্রুত ধ্বংস করা যায়। এ জায়গাটিতে বারবার আমাদের প্রশাসন ভুল করে বসে। গত বছরও যখন চিকুনগুনিয়া নিয়ে মানুষ আতঙ্কে। আমাদের তুলনামূলক সফল মেয়র প্রয়াত আনিসুল হক বলে বসলেন- মানুষের বাসায় বাসায় গিয়ে মশারি টাঙ্গাতে পারবেন না। সমস্যার গভীরতা না বুঝে এটি তার বলা সবচেয়ে অচিন্তিত মন্তব্য বলে আমার বিশ্বাস।

এরপর তৃতীয় ধাপ হচ্ছে মানুষকে এই সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য নিজেদের ব্যবহারিক পরিবর্তনের জন্য আহবান করা। এই আহবানের জন্য প্রশাসনের গ্রহণযোগ্যতা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তৃতীয় ধাপের কাজ প্রথম ধাপে করার কারণে আমাদের প্রশাসনের গ্রহণযোগ্যতা অনেক দীর্ঘসময় ধরে হুমকির মুখে। যে কারণে প্রশাসন যখনই জনসাধারণকে ব্যবহারিক পরিবর্তনের আহবান করে লম্বা হাতার জামা পরা, রাস্তায় ময়লা না ফেলে ঝুড়িতে ফেলা, ভাতের বদলে আলু খাওয়া, গাছ লাগানো, পাবলিক বাস ব্যবহার করাসহ যাবতীয় ভালো কাজ করতে বলে, মানুষ তখন সেটিকে প্রশাসনের দায়িত্বহীনতা ও ফাঁকিবাজি হিসেবে ধরে নেয়।

সহজ ভাষায় বললে, ডেঙ্গু মশার জন্য মানুষকে নিজ বাড়ি ও পরিবেশ পরিষ্কার রাখাসহ যাবতীয় ব্যবহারিক পরিবর্তনের আহবান জানানোর আগে প্রশাসনের উচিত কিছু কারিগরি সহায়তা প্রদান করে মানুষকে ভরসা দেওয়া যাতে সাধারণ মানুষ বুঝতে পারেন যে প্রশাসন এই সমস্যার ব্যাপারে আন্তরিক। এতে করে মানুষ প্রশাসনের উপর বিশ্বাস রাখতে পারবে। তখন তাদের আহবানে সাধারণ মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাড়া দিবে।

অপরদিকে, জনসাধারণকেও মনে রাখতে হবে যে, যে ধরণের সমস্যায় ব্যবহারিক পরিবর্তন প্রয়োজন সেখানে শুধুমাত্র প্রশাসনিক কারিগরি সহায়তা যথেষ্ট না। ঐ সহায়তা সমস্যাটিকে সাময়িকভাবে দূর করতে পারলেও অচিরেই সে সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করে ফিরে আসবে। তাই সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য শুরু থেকেই নিজেদের অবস্থান থেকে সম্ভব সক্রিয় অংশগ্রহণ করা জরুরি।

তাই এই দায় নিয়ে দায়িত্বহীন বক্তব্য ও কর্মকাণ্ড বন্ধ করে প্রত্যেকটি সমস্যার সমাধানে নিজস্ব অবদান ও করণীয় পর্যালোচনা করে সম্মিলিতভাবে সুচিন্তিত পদক্ষেপ নিয়ে সমস্যার স্থায়ী সমাধানের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।

পরিশেষে, বর্তমানে প্রচলিত একটি প্রবণতার তীব্র নিন্দা জানাতে চাই। গত কয়েকবছর থেকে দেখা যাচ্ছে, আমাদের দেশে কোনো একটি সমস্যা তৈরি হলেই আমাদের দায়িত্ববান মানুষজন কিছু চূড়ান্ত দায়িত্বহীন মন্তব্য করেন। ধাক্কা দিয়ে বিল্ডিং ফেলে দেওয়া, কথায় কথায় বিরোধী রাজনৈতিকদের দায় দেওয়া, জঙ্গি/শিবির ট্যাগ লাগানোসহ চূড়ান্ত পর্যায়ের হাস্যরস তৈরি করার সাথে নতুন যোগ হয়েছে ফোটোসেশন।

ব্যক্তিগতভাবে আমার ১০ বছর বয়সী ভাগিনা ডেঙ্গুজ্বরে ভুগে অনেক কষ্ট পেয়েছে। আমার প্রতিবেশী খালা হঠাৎ করেই মারা গেছেন। খবরে জেনেছি ৮ মাসের বাচ্চা পেটে নিয়ে এক মায়ের মৃত্যু হয়েছে, মৃত্যু হয়েছে চিকিৎসক, সাংবাদিক, পুলিশসহ সব ধরণের শ্রেণিপেশার সাধারণ নিরীহ মানুষের। তাদের মৃত্যুশোক ও হাজার মানুষের অসীম ভোগান্তি নিয়ে এমন দায়িত্বহীন মন্তব্য ও ফোটোসেশন সরাসরি ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। আমাদের দেশে যেখানে ভুল করে ক্ষমা চাওয়ার দৃষ্টান্ত বিরল সেখানে অবশ্য এদের শাস্তি আশা করা আরো গর্হিত অপরাধ!

সচেতন হন, সবাইকে নিয়ে সুস্থ থাকুন।

মুতাসিম বিল্লাহ, সমাজকর্মী

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

3 quota protest leaders held for their own safety: home minister

Three quota protest organisers have been taken into custody for their own safety, said Home Minister Asaduzzaman Khan

10m ago