একক প্রচেষ্টায় বাল্যবিবাহমুক্ত হলো পুরো উপজেলা
রাত নেই দিন নেই, বৃষ্টি কিংবা রৌদ্র- যেখান থেকেই বাল্যবিবাহের খবর আসে, সেখানেই তিনি হাজির হন। মেয়েদের পরিবারকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে বিয়ে বন্ধ করেন। এটুকু করেই থেমে থাকেন না। বাবা-মাসহ ওই মেয়েদের পড়ালেখার জন্য প্রেরণাও যুগিয়ে যাচ্ছেন। ব্যক্তিগতভাবে কোন কোন শিক্ষার্থীর লেখাপড়ার খরচও দিচ্ছেন।
তিনি নেত্রকোনার বারহাট্টা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফরিদা ইয়াসমিন। গত দুই বছরের নিরন্তর প্রচেষ্টায় এই উপজেলা এখন বাল্যবিবাহমুক্ত।
বারহাট্টা উপজেলাকে বল্যবিবাহমুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। মঙ্গলবার বেলা ১১টার দিকে বারহাট্টা শেখ রাসেল মিনি স্টেডিয়ামে উপজেলা প্রশাসন আনুষ্ঠানিকভাবে এই ঘোষণা দেয়। এতে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তা, কাজী, ইমাম, ধর্মীয় নেতা, সমাজকর্মী, শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার লোকজনকে প্রধান অতিথি হয়ে শপথবাক্য পাঠ করান জেলা প্রশাসক মঈনউল ইসলাম। এর আগে ইউএনও ফরিদা ইয়াসমিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছাড়াও বক্তব্য দেন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত এসএম আশরাফুল আলম, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. মাঈনুল হক, সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার শাহ আব্দুল কাদের, বেসরকারি সংস্থা নারী প্রগতির কর্মকর্তা সুরজিত ভৌমিক, বাল্যবিবাহ থেকে রক্ষা পাওয়া বারহাট্টা সিকেপি পাইলট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শরিফা আক্তার প্রমুখ।
উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, নেত্রকোনার ১০টি উপজেলার মধ্যে বাল্যবিবাহমুক্ত হওয়া প্রথম উপজেলা বারহাট্টা। এর পেছনে ওই উপজেলার বর্তমান নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফরিদা ইয়াসমিনের অবদান সবচেয়ে বেশি। গত এক বছর আট মাসে তিনি উপজেলায় ৫৮টি বাল্যবিবাহ বন্ধ করেছেন। এর মধ্যে চারজন অসচ্ছল পরিবারের স্কুল থেকে ঝরে পড়া মেয়েদেরকে খরচ যুগিয়ে লেখাপড়া চালিয়ে যেতে সহযোগিতা করছেন।
ফরিদা ইয়াসমিন গত ২০১৭ সালের ৯ মে বারহাট্টা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হিসেবে যোগদান করেন। এর সপ্তাহ খানেক পর সদর ইউনিয়নের একটি মাদ্রাসা পড়ুয়া মেয়ের বাল্যবিবাহের অভিযোগ আসে। তিনি প্রথমে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও পুলিশ পাঠিয়ে বিয়েটি বন্ধ করেন। কিন্তু দেখা গেল, রাতের আঁধারে অন্যত্র নিয়ে গিয়ে বিয়ে ঠিকই হয়েছে। এতে তিনি উপলব্ধি করেন উপজেলায় আর কোন বাল্যবিবাহ হতে দেওয়া যাবে না।
ফরিদা ইয়াসমিন জানান, যোগদানের পর চলতি বছরের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত ৫৩টি বাল্যবিবাহ বন্ধ করেছেন তিনি। এর মধ্যে সিংধা, বাউসী ও সদর ইউনিয়নের চারটি মেয়ের পরিবার হতদরিদ্র হওয়ায় তিনি নিজ খরচে তাদের লেখাপড়া চালিয়ে যেতে সহযোগিতা করছে। এ ছাড়া উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে অন্যান্য ছাত্রীর পরিবারকেও সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছেন। চলতি বছরের ১৫ জানুয়ারির পর থেকে এখন পর্যন্ত আর বাল্যবিবাহ হয়নি। তাই এই উপজেলাকে আনুষ্ঠানিকভাবে বাল্যবিবাহমুক্ত ঘোষণা করা হলো।
ফরিদা ইয়াসমিন মনে করেন, শুধু আইন প্রয়োগ করে বাল্যবিবাহ বন্ধ করা কঠিন। সবাইকে সচেতন করা গেলেই বাল্যবিবাহ বন্ধ করা সম্ভব। তিনি বেসরকারি সংস্থাসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সঙ্গে মতবিনিময়, শপথ বাক্য পাঠ, লিফলেট, লাল কার্ড দেখানো, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও কাজিদের নিয়ে আলোচনা, গ্রামে উঠান বৈঠক, গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বাল্যবিবাহের কুফল-সংবলিত পোস্টার লাগানোর ব্যবস্থা করেন। সাতটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সচিবদের স্পষ্ট নির্দেশ দেওয়া হয় বাল্যবিবাহের উদ্দেশ্যে কেউ যেন বয়স বাড়িয়ে জন্মনিবন্ধন করাতে না পারে। গত জুন মাস থেকে একটি ফান্ড গঠন করে ২০টি স্কুলে ৪৮টি বাইসাইকেল দেওয়া হয়। মঙ্গলবারও দেওয়া হয়েছে ২১টি বাইসাইকেল। সাইকেলে চড়ে শিক্ষার্থীরা এখন স্কুলে যাওয়া-আসার পাশাপাশি বাল্যবিবাহ বন্ধে নিজেরাও উদ্যোগী হচ্ছে।
বারহাট্টা সিকেপে পাইলট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অমলেন্দু সরকার বলেন, “ইউএনও ফরিদা ইয়াসমিন সত্যিকার অর্থেই প্রশংসা পাওয়া যোগ্য। তিনি বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে সোচ্চার। বিভিন্ন সময় আমাকে সঙ্গে নিয়ে অনেকগুলো বাল্যবিবাহ বন্ধ করেছেন। আমার বিদ্যালয়ের পাঁচটি মেয়ের বাল্যবিবাহ বন্ধ করেছেন তিনি।”
উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মাঈনউল হক বলেন, “শুধু বাল্যবিবাহ বন্ধই নয় ফরিদা ইয়ামিন ওই মেয়েদেরকে পড়ালেখা করে বড় হতে প্রেরণা যুগিয়ে যাচ্ছেন।”
রায়পুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আতিকুর রহমান বলেন, “গত দেড় বছরে আমার ইউনিয়নে প্রায় ১১টির মতো বাল্যবিবাহ বন্ধ করেছেন ইউএনও ফরিদা ইয়ামিন। একটি বিয়ে তিনি রাত প্রায় ১২টার সময় আমাকে নিয়ে বন্ধ করেছেন। এই মেয়েটি এখন ইউনিয়নের একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে মানবিক শাখায় পড়ছে। ইউএনও প্রসঙ্গে ওই চেয়ারম্যানের মূল্যায়ন, “এমন শতভাগ সৎ কর্মকর্তা আমি আর দেখিনি। তিনি মাটির মানুষ। সবাইকে মূল্যায়ন করেন। একজন নির্লোভ ও কাজপাগল মানুষ। একটুও বাড়িয়ে বলছি না। সত্যি কথা বলছি, খোঁজ নিয়ে জেনে নিন।”
নারী প্রগতির কর্মকর্তা সুরজিত ভৌমিক বলেন, “রাত ১২টা বা একটা নেই, উনার (ইউএনও) কানে বাল্যবিবাহের খবর পৌঁছলে সঙ্গে সঙ্গে মেয়ের বাড়িতে হাজির হয়েছেন। দূরে থাকলেও পুলিশ ও আমাদেরকে পাঠিয়ে বিয়ে বন্ধ করেন। তিনি বেশ কয়েকজন মেয়েকে লেখাপড়া করতে সাহায্য করছেন। তার মতো সব উপজেলায় ইউএনওরা এমন হলে বাল্যবিবাহ আর হবে না।’
বাল্যবিবাহ বন্ধ হয়ে এখন লেখাপড়া করা শরিফা আক্তার অনুভূতি প্রকাশ করে জানায়, “ইউএনও ম্যাডাম আমার জীবনকে বদলে দিয়েছেন। তিনি আমাকে নানাভাবে সহযোগিতা করছেন। আমি এখন স্বপ্ন দেখছি। আমি নিজেও তিনটি বাল্যবিবাহ বন্ধ করেছি।”
ফরিদাকে নিয়ে জেলা প্রশাসক মঈনউল ইসলামের মূল্যায়ন, “ফরিদা আমাদের গর্ব, তিনি ডায়নামিক। মানুষের ভরসার জায়গা ফরিদা। এ পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে কোন ধরনের নেতিবাচক কথা শুনিনি। সরকারের যে সেবা দেওয়ার কথা তা তিনি সাধারণ মানুষকে যথাযথভাবে পৌঁছে দিচ্ছেন। এতে আমাদের প্রশাসনের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হচ্ছে। ফরিদার বাল্যবিবাহ বন্ধের উদ্যোগের কারণে আজ বারহাট্টাকে বাল্যবিবাহমুক্ত ঘোষণা করা সম্ভব হয়েছে।”
ইউএনও ফরিদা ইয়াসমিন আগামী সপ্তাহে ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক হিসেবে যোগদান করা কথা রয়েছে। তার জন্ম জামালপুর সদর উপজেলার একটি গ্রামে। বাবা ফজলুল হক চৌধুরী ও মা খালেদা বেগমের ছয় সন্তানের মধ্যে সবার বড় তিনি। তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০০৪ সালে সরকার ও রাজনীতি বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।
Comments