কতখানি গ্রহণযোগ্য সাকিবের এই যুক্তি?
সাধারণত খুব জরুরী না হলে সংবাদ সম্মেলনে আসেন না সাকিব আল হাসান, গণমাধ্যমে হরহামেশা কথা বলতেও তার আগ্রহ থাকে কম। অধিনায়ক হিসেবে কোন টেস্টের মাঝখানে কথা বলতে এসেছেন, এমনটা বিরল। চট্টগ্রাম টেস্টের দ্বিতীয় দিনেই সবাইকে চমকে নাটকীয়ভাবে হাজির বাংলাদেশ অধিনায়ক। তার সংবাদ সম্মেলনও থাকল চমকে ভরা। জানালেন তিনি নিজেই আছেন চমকের মধ্যে। বলা ভালো হতভম্ব অবস্থায়। দলের খারাপ সময়ে অধিনায়ক হিসেবে দায় নিতে আসেন অনেকে, পরে বোঝা গেল সাকিব এসেছেন দায় চাপাতে।
অধিনায়কের ইঙ্গিতমতে আফগান বধে তারা চেয়েছিলেন একদম টার্নিং উইকেট, কিন্তু মাঠে নেমে দেখেন উইকেট পুরোই ফ্ল্যাট। যাতে সুবিধা পাচ্ছে বরং সফরকারীরা। একটু তলিয়ে দেখা যাক অধিনায়কের যুক্তি আসলে কতখানি গ্রহণযোগ্য?
প্রথম দিন টস জিতে আফগানিস্তান ব্যাট করতে যাওয়ার পরই বল হাতে পেয়েছিলেন তাইজুল ইসলাম। প্রথম সেশনের পুরোটা সময়জুড়েই চাপ তৈরি করেন তিনি। ওই সময় তুলে নেন ২ উইকেট, নিতে পারতেন আরও বেশি। তাকে সামলাতে শুরুর দিকে রান করাই বন্ধ করে দেয় আফগানিস্তান।
কিন্তু তাইজুল আক্রমণ থেকে সরতেই সেই চাপ আর রাখা যায়নি। দুই অফ স্পিনার শুরু থেকেই ছিলেন এলোমেলো। অধিনায়ক সাকিবও জায়গায় বল কোনভাবেই ফেলতে পারছিলেন না। প্রথম সেশনে ৩ উইকেট তুললেও দ্বিতীয় সেশনেই তাই দাঁড়িয়ে যান রহমত শাহ আর আসগর আফগান।
নতুন নতুন স্পেলে এসে এক প্রান্তে তাইজুল তাদেরও ধন্দে ফেলেছেন, কিন্তু অন্য প্রান্ত থেকে বাধন আলগা হয়েছে বারবার। এই দুজনের ১২০ রানের জুটিতেই ভিত পেয়ে যায় আফগানিস্তান।
স্টাম্প মাইক্রোফনে উইকেটকিপার মুশফিকুর রহিমকে বারবার জায়গায় বল ফেললেই উইকেটে থাকা অনেক সুবিধা পাওয়ার কথা বলতে শোনা যায়। প্রথম দুই সেশন বিবর্ণ থাকা নাঈম হাসান শেষ সেশনে জায়গায় বল ফেলে পান সাফল্যও। তার অফ স্পিনে আউট হন সেঞ্চুরিয়ান রহমত শাহ। নিচু হওয়া বলে বোল্ড হন মোহাম্মদ নবি। তবু দিনশেষে মাত্র ৫ উইকেট হারিয়ে ২৭১ রান করে আফগানিস্তান।
বাংলাদেশ অধিনায়ক জানালেন, প্রথম দিন ওদের মাত্র ৫ উইকেট নিতে দেখে রীতিমতো বিস্মিত হয়েছিলেন তারা। কারণ তারা যে আশা নিয়ে নেমেছিলেন উইকেটে ফিঙ্গার স্পিনারদের জন্য ছিল না তেমন টার্ন। তাই আফগানরা পেয়ে যায় জুতসই পূজি, ‘অবাক হয়েছিলাম যখন প্রথম দিন আমরা ৫ উইকেট পেয়েছিলাম। কারণ ফ্ল্যাট উইকেটে অনেকদিন পর আমরা খেলেছি বলে মনে হয়।’
দ্বিতীয় দিন প্রথম সেশনেও আফগানদের থিতু জুটি আলগা করেন তাইজুল। দুই সেট ব্যাটসম্যানকে আউট করেন তিনিই। টেল এন্ডের বাকি ৩ উইকেট নেন সাকিব আর মেহেদী হাসান মিরাজ। এদিনও বাকিদের প্রচুর আলগা বল করতে দেখা যায়। যার সুবিধা নিয়ে ফিফটি করে বসেন রশিদ খান।
কিন্তু অধিনায়ক দায় দিচ্ছেন উইকেটের, ‘আমরা সবাই অনেক বিস্মিত। কারণ আমরা এমন আশা করিনি। আমরা যেমন আশা করেছিলাম, তার পুরো বিপরীত ছিল (উইকেট)।’
সাকিব যে স্পিনারদের সুবিধা নেই বলে উইকেটের দায় দিলেন খানিকপর তারা সেখানে নেমে স্পিনেই থই পেলেন না খুঁজে। এক পর্যায়ে ১৪৬ রানে ৮ উইকেট হারিয়ে চরম বিপর্যয় পড়ে বাংলাদেশ। দিনশেষে মোসাদ্দেক হোসেন আর তাইজুলের প্রতিরোধে ওই ৮ উইকেটেই ১৯৪ রানে দিন শেষ হয়েছে। তবু সামনে অপেক্ষা করছে হারের শঙ্কা।
নিজেরা কেন পারেননি? এখানে অধিনায়কের যুক্তি, ‘রিস্ট স্পিনাররা সব সময় সাহায্য পাবে। কারণ রিষ্ট স্পিনারদের ভেতরও ওদের বৈচিত্র্য আছে। কাজেই ওদের একটু সুবিধা অবশ্যই থাকবে।’
কিন্তু বাংলাদেশের প্রথম দুই উইকেট কোন রিষ্ট স্পিনার ফেলেননি। পেসার ইয়ামিন আহমেদজাইর বেরিয়ে যাওয়া বলে খোঁচা মেরে আউট সাদমান ইসলাম। পরের উইকেট নিলেন মিরাজদের মতই একজন ফিঙ্গার স্পিনার –মোহাম্মদ নবি। দ্বিতীয় ওভারে বল হাতে নিয়েই নবি উইকেট থেকে আদায় করলেন টার্ন। তার দারুণ বলেই ফেরেন সৌম্য সরকার। মুমিনুল হক নবির বলেই উইকেট বিলিয়ে ফেরেন। ফিঙ্গার স্পিনার হলেও ভালো লেন্থে বল ফেলে ব্যাটসম্যানদের বারবার পরীক্ষায় ফেলে গেছেন নবি।
৮ উইকেটের বাকি পাঁচটিই অবশ্য নিয়েছেন রিষ্ট স্পিনাররা। বিশেষ করে রশিদ খানের গুগলি সামলানোর যেন উপায় পাচ্ছিলেন না ব্যাটসম্যানরা। ৪৭ রানে ৪ উইকেট ফেলে রশিদই সেরা। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে এই ফ্ল্যাট উইকেটেই যদি রশিদ এমন বোলিং করেন, সাকিবের ‘চাওয়ামতো ঘূর্ণি উইকেট’ থাকলে কি করতেন? তার বল থেকে কি আরও বিষধর ডেলিভারি বেরুতো না? ফ্ল্যাট উইকেটে রিষ্ট স্পিনারদের খেলতে না পারলে ঘূর্ণি উইকেটে কি করে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা তাদের সামলাতেন?
শেষ বিকেলে রিষ্ট স্পিনার সামলে ৪৮ রানের অবিচ্ছিন্ন জুটি গড়া মোসাদ্দেক-তাইজুলের উদাহরণ টেনে অবশ্য ব্যাটসম্যানদের দায় দেখছেন তিনি, 'হয়তো আমরা ভালোভাবে প্রয়োগ করতে পারিনি। তবে আনপ্লেয়েবল বলবো না। কারণ মোসাদ্দেক আর তাইজুল যেভাবে ব্যাটিং করলো এখানে পরিকল্পনা করাও সম্ভব এবং থাকাও সম্ভব ওরা প্রমাণ করেছে। হয়তো আমরা আরেকটু ভালো প্রয়োগ করলে করলে রানটা আরেকটু বড় হতো।'
উপমহাদেশের দল আর স্পিন শক্তিতে ভরপুর বলেই আফগানিস্তানের বিপক্ষে টার্নিং উইকেটে খেলা ঝুঁকিপূর্ণ। অথচ উইকেটে টার্ন কম থাকায় উলটো আফসোস ঝরছে বাংলাদেশের। বাংলাদেশ এই টেস্ট হারলে সবচেয়ে আলোচনায় আসতে পারে পেসারবিহীন একাদশ, ঘূর্ণি উইকেটে খেলা নিয়ে প্রশ্ন। কিন্তু সাকিব সেই প্রশ্ন আগেই উলটো ঘুরিয়ে নিজের পরিকল্পনা আর সামর্থ্যে গড়বড় করার ঢালই কি তৈরি করে রাখলেন?
Comments