বন্দিদশা থেকে ফিরে লোমহর্ষক নির্যাতনের বর্ণনা নারী আইনজীবীর
“ও প্রতিদিন আমাকে মারত। শিল-পাটার শিল দিয়ে আঘাত করত, যাতে কেউ মারধরের আওয়াজ না পায়। আমার সারা শরীর থেঁতলে গেছে। আঘাতের যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কিন্তু সেই সুযোগও পাইনি।” এক বখাটে যুবকের বন্দিদশা থেকে ফিরে এসে সোমবার রাতে এভাবেই লোমহর্ষক নির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছেন মানিকগঞ্জ জেলা জজকোর্টের আইনজীবী কামরুন্নাহার সেতু।
মুক্ত হয়ে মানিকগঞ্জে আসার পর অ্যাডভোকেট কামরুন্নাহর সেতু এই প্রতিবেদককে জানান, তার বাড়ি মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার জাগীর ইউনিয়নের ঢাকুলী গ্রামে। স্বামীর সাথে বিচ্ছেদের পর তিনি উচ্চমাধ্যমিক পড়ুয়া ছেলেকে নিয়ে বাবার বাড়িতে থাকেন। স্বামীর সাথে বিবাহ বিচ্ছেদের সুযোগে তার সাথে শাওন প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলে এবং বিয়ে করতে চায়। কিন্তু শুরুতেই তিনি তাকে বিয়ে করতে অস্বীকার করেন।
“গত ৯ সেপ্টেম্বর সে আমাকে নিয়ে আমার বোনের শ্বশুরবাড়ি মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার বানিয়াজুরী ইউনিয়নের করচাবাঁধা গ্রামে বেড়াতে যায়। সেখানে এক ব্যক্তিকে কাজী হিসেবে পরিচয় দিয়ে আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাবিন নামায় স্বাক্ষর নেয়। সেখান থেকে আমি আমার বাবার বাড়ি ফিরে আসি। আসার পথে সে বলে, এখন তুমি আমার বিয়ে করা বউ। আমার কথার বাইরে গেলে বিপদ আছে। ওকালতি বাদ দিতে হবে। আর বিয়ের কথা কাউকে বলতে নিষেধ করে। মান সম্মানের ভয়ে, আমি কাউকে কিছু বলিনি।”
নির্যাতনের মুখে জীবিত ফিরে আসার আশা পর্যন্ত ছেড়ে দিয়েছিলেন জানিয়ে তিনি বলেন, “প্রতারণার ফাঁদে ফেলে টাকা হাতিয়ে নেয়াই ওর কাজ। ও যে কত নারীর জীবন নষ্ট করেছে, কতো মানুষকে পথে বসিয়েছে- তা ও নিজেই বলতে পারবে না। ও প্রথমে নারীদের সাথে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলে। নানা প্রলোভনে ফেলে অন্তরঙ্গ অবস্থার ভিডিও ধারণ করে। নিয়ে নেয় মোবাইল ফোন ও অন্যান্য পরিচয়পত্র। তারপর তাকে জিম্মি করে অর্থ হাতিয়ে নেয়। না দিলেই শুরু হয় অমানবিক নির্যাতন।”
কামরুননাহার বলেন, এইসব অপরাধ ঢাকতে শাওন পুলিশসহ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তুলে। নিজেকে বিত্তশালী ও বড় মাপের ব্যবসায়ী পরিচয় দিয়ে মিশে যায় তাদের সঙ্গে। ব্যক্তিগত গাড়ি ও রাজধানীর মতিঝিলে নিজের অ্যাপার্টমেন্ট থাকার কথা বলে।”
খোঁজ নিয়ে জানা যায় এই ব্যক্তির বাড়ি মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার আজিমনগরে। নাম মো. শাওন মিয়া, বয়স আনুমানিক ৪০। তবে সে একেক সময় একেক নাম ও ঠিকানা ব্যবহার করে। তার ফেসবুক আইডি থেকে নেওয়া ছবি দিয়ে তার প্রকৃত নাম ঠিকানা শনাক্তের চেষ্টা চলছে।
বন্দিদশার শুরুর দিকের বর্ণনা দিতে গিয়ে কামরুননাহার বলেন, “গত ১৭ অক্টোবর মানিকগঞ্জ আদালত কথা বলার অজুহাতে সে আমাকে তার গাড়িতে উঠিয়ে নবীনগর কহিনুর গেটের তুনু হাজীর বাড়ির চতুর্থ তলার একটি কক্ষে নিয়ে যায়। সেখানে আমাকে সে স্ত্রী পরিচয়ে রাখে। অজানা-অচেনা জায়গায় একটি কক্ষে বন্দী থেকে আমি ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ি।”
সেখানে প্রথম দুদিন তার সঙ্গে শাওন ভালো ব্যবহার করে উল্লেখ করে তিনি বলেন, তৃতীয় দিন তার মানিকগঞ্জ ডাকঘরে থাকা কয়েকটি হিসাব থেকে তাকে টাকা উঠিয়ে দিতে বলে। তার কাছে অন্ত্র থাকার ভয় দেখিয়ে তিন বারে ১৬ লাখ টাকা তুলে দেই। এর দুদিন পর সে আরও টাকা চায়। আর টাকা নেই জানালে সে জমি লিখে দিতে বলে। এটা করতে অস্বীকার করায় শুরু হয় অমানবিক নির্যাতন।”
পরবর্তী ঘটনার বিবরণ দিয়ে তিনি জানান, তার কাছ থেকে মোবাইল ফোন, জাতীয় পরিচয়পত্র এবং ড্রাইভিং লাইসেন্স কেড়ে নেওয়া হয়। তারপর তাকে বিবস্ত্র করে নগ্ন ভিডিও ধারণ করে এবং তার শেখানো কথা বলিয়ে ভিডিও রেকর্ড করে। সেই ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেয়। সারাদিন তাকে ওই ঘরে আটকে রেখে মারধর করতে থাকে। ঘরের মধ্যে থাকা শিল-পাটার শিল দিয়ে শরীরের বিভিন্ন অংশে আঘাত করে। এতে তার মুখসহ বিভিন্ন অংশ থেঁতলে যায়।
সবশেষ গত ২ নভেম্বর রাতে তাকে জানে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। সেই রাতে তিনি তার ঘরের জানালা খুলে এক প্রতিবেশীকে সজাগ থাকার অনুরোধ জানান। রাত দুইটার দিকে মারধর শুরু হয়। জবাই করতে রান্না ঘর থেকে বটি আনতে গেলে সে চিৎকার শুরু করে। তার চিৎকারে প্রতিবেশীরা আসলে দরজা খুলে সে তাদের সেখান থেকে চলে যেতে বলে। সে বলে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বাইরের লোক কোন কথা থাকতে পারে না। তার শরীরে আঘাতের চিহ্ন এবং চিৎকারে বাড়ির মালিক এসে তাকে সেখান থেকে উদ্ধার করে তাকে পৃথক একটি কক্ষে রাখেন।
দুই পরিবারের লোক ছাড়া তাকে দেওয়া হবে না জানালে, সে বাড়ির মালিকসহ প্রতিবেশীকে অনুরোধ করে বলে সে নিজেরই সেতুকে তার বাবার বাড়িতে দিয়ে আসবে। এ কথায় বিশ্বাস করে তার কাছে সেতুকে তুলে দেয় তারা। কিন্তু সে সেতুকে মানিকগঞ্জে না দিয়ে এসে ঢাকার দিকে রওয়ানা দেয়। সে গাড়িতে বসে বিভিন্ন যায়গায় ফোন করে তাদের ধানমন্ডির ল্যাবএইড হাসপাতালে এসে থাকতে বলে। সে অস্ত্রের ভয় দেখায় এবং কথা না শুনলে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। সে সেতুকে ওই হাসপাতালে নিয়ে একজন চিকিৎসককে একটি কেবিন দিতে বলে। কেবিনে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করে। এটা বুঝতে পেরে চলে আসতে চাইলে তাকে সেখানে মারধর শুরু করে। এই ঘটনায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ পুলিশকে খবর দিলে সে সেখান থেকে পালিয়ে যায়। ভীত সন্ত্রস্ত ওই নারী হাইকোর্টে তার এক পরিচিত আইনজীবীকে ফোন দিয়ে এই ঘটনা বলে। পরে সেখান থেকে উদ্ধার করে তাকে নেওয়া হয় হাইকোর্টে।
ঢাকার উত্তরায় তার এক পরিচিত ব্যক্তির বাসায় রাত্রিযাপন শেষে সোমবার রাতে তিনি সেখান থেকে সরাসরি মানিকগঞ্জ থানায় এসে তিনি তার ১৫ দিনের বিভীষিকাময় ঘটনার বর্ণনা দেন।
কামরুন্নাহার সেতুর পিতা মো. সফিউদ্দিন বলেন, তার মেয়ে নিখোঁজ হওয়ার পর ওই যুবক তার কাছে ফোন করে তার মেয়েকে দিয়ে পাঁচ লাখ টাকা চায়। না দিলে তাকে হত্যা করার হুমকি দেয়। তিনি ৩ নভেম্বর মানিকগঞ্জ থানায় ওই যুবকের বিরুদ্ধে একটি অপহরণ মামলা করেন।
মানিকগঞ্জ সদর থানার অফিসার ইন-চার্জ (ওসি তদন্ত) মো. হানিফ সরকার বলেন, ওই নারী আইনজীবীকে তার বাবার করা অপহরণ মামলায় উদ্ধার দেখিয়ে তার জবানবন্দী রেকর্ডের জন্য মানিকগঞ্জ চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে পাঠানোর প্রস্তুতি চলছে। তিনি ইচ্ছে করলে আলাদা মামলাও করতে পারেন বলে জানান তিনি।
অভিযুক্ত মো. শাওন মিয়ার দুটি মোবাইল নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করলে তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
Comments