অন্ধকারে আলোর দিশারী

১ জুলাই, ২০১৬। বাংলাদেশের ইতিহাসে এক কালো অধ্যায়। সেদিন ঢাকার গুলশানে হোলি আর্টিজান বেকারিতে ঘটেছিলো এক নৃশংস হত্যাযজ্ঞ।
Faraaz Ayaaz Hossain
গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলায় নিহত ফারাজ আইয়াজ হোসেন। ছবি: সংগৃহীত

১ জুলাই, ২০১৬। বাংলাদেশের ইতিহাসে এক কালো অধ্যায়। সেদিন ঢাকার গুলশানে হোলি আর্টিজান বেকারিতে ঘটেছিলো এক নৃশংস হত্যাযজ্ঞ।

সেই রাতের নিকষ অন্ধকারে উজ্জ্বল আলো হয়ে আছেন ফারাজ আইয়াজ হোসেন। তার সাহসিকতা ও মানবিক গুণাবলি সারাবিশ্বের মানুষের জন্যে প্রেরণা যোগায়।

সিমিন হোসেন এবং ওয়াকার হোসেন দম্পতির ২০ বছরের  সন্তান ফারাজ ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টার ইমোরি ইউনিভার্সিটির মেধাবী ছাত্র। হোলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার সময় বন্ধুদের ঘাতক জঙ্গি-গোষ্ঠীর হাতে ছেড়ে নিজে বাঁচতে রাজি হননি ফারাজ। বন্ধুদের সঙ্গে নিজের জীবন উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন তিনি।

সেই দুর্ভাগ্যের রাতে ফারাজ তার বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আমেরিকান বন্ধু অবিন্তা কবির এবং ভারতীয় বন্ধু তারিশি জৈনকে নিয়ে গিয়েছিলেন হোলি আর্টিজান বেকারিতে।

ফারাজের স্মৃতির প্রতি উৎসর্গীকৃত ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, ২০১৫ সালে ইমোরি ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হন অবিন্তা। বিশ্ববিদ্যালয়ে সামার কোর্স শেষ করে অবিন্তা ঢাকায় এসেছিলেন। বার্কেলিতে অবস্থিত ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার ছাত্র জৈনও ঢাকায় এসেছিলেন গ্রীষ্মের ছুটিতে।

সেদিন রাত ৯টা বাজার একটু আগে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে একদল জঙ্গি ঢুকে পড়ে রেস্তোরাঁটিতে। সেখানে খেতে আসা সবাইকে জিম্মি করে তারা। পুলিশ সেখানে ঢুকতে চাইলে শুরু হয় তুমুল গোলাগুলি।

সন্ত্রাসীরা অমুসলিম ও বিদেশিদের হামলার লক্ষ্যে পরিণত করে।

সন্ত্রাসীরা যখন জানতে পারে যে ফারাজ একজন বাংলাদেশি মুসলমান তখন তারা তাকে ছেড়ে দেয়। তিনি তখন তার দুই বন্ধুকে তার সঙ্গে ছেড়ে দিতে বলেন। কিন্তু, সন্ত্রাসীরা ফারাজের দুই বন্ধুকে ছাড়তে রাজি না হলে ফারাজ শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তাদের সঙ্গে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এসব ঘটনা জানা যায় হামলা থেকে বেঁচে যাওয়া প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে।

১২ ঘণ্টার জিম্মি দশার পর সেনাবাহিনীর একটি বিশেষ দল সন্ত্রাসীদের পরাজিত করে ক্যাফেটিতে প্রবেশ করে। তারা সেখানে দেখতে পায় ফারাজ, তারিশি এবং অবিন্তাসহ ২০ জনের মৃতদেহ।

যুক্তরাষ্ট্রে পড়ার সময় ফারাজ সিদ্ধান্ত নেন দেশে ফিরে আসার। দেশ গঠনে নিজেকে নিয়োজিত করতে চান। মা ইসকায়েফ ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সিমিন হোসেন এবং নানা ট্রান্সকম গ্রুপের চেয়ারম্যান লতিফুর রহমান ও নানি শাহনাজ রহমানের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে চেয়েছিলেন ফারাজ।

কিন্তু, ফারাজের সেই স্বপ্ন অপূর্ণ থেকে গেলেও সাহসিকতা, বন্ধুত্ব ও মানবিকতার যে বিরল দৃষ্টান্ত তিনি রেখে গেছেন তা আজ বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। তিনি আজ মানবিকতার আলোকবর্তিকা।

ইতালির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় মিলান-ভিত্তিক সংগঠন ‘গার্ডেন অব দ্য রাইচাস ওয়ার্ল্ডওয়াইড’ ২০১৬ সালের জুলাইয়ে তিউনিসিয়ার রাজধানী তিউনিসে ইতালির দূতাবাসের সামনে ফারাজের নামে ‘স্মৃতি-স্মারক’ স্থাপন করে। ফারাজ হচ্ছেন সেই বাগানে একমাত্র অনারব মুসলিম যিনি বিশ্বব্যাপী চলমান সন্ত্রাসী হামলার শিকার ব্যক্তিদের একজন।

ভারতের হারমনি ফাউন্ডেশন ২০১৬ সালের নভেম্বরে ফারাজকে মরণোত্তর ‘মাদার তেরেসা মেমোরিয়াল ইন্টারন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড ফর সোশ্যাল জাস্টিস’ পুরস্কার প্রদান করে। এই সম্মানজনক পুরস্কার দেওয়া হয়েছিলো দালাই লামা, ড. মাহাথির মোহাম্মদ, ব্যারোনেস ক্যারোলিন কক্স এবং মালালা ইউসুফজাইয়ের মতো জগতখ্যাত ব্যক্তিদের।

সাহসিকতার স্বীকৃতি স্বরূপ যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক শিশু অধিকার সংগঠন ডিসট্রেসড চিলড্রেন অ্যান্ড ইনফেন্ট ইন্টারন্যাশনাল (ডিসিআই) ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে ফারাজকে ডিসিআই ২০১৭ হিউম্যানিটেরিয়ান অ্যাওয়ার্ড দেয়।

ফারাজের মানবিকতা ও মূল্যবোধকে সবার সামনে তুলে ধরতে পেপসিকো ইঙ্ক ২০১৬ সালে বার্ষিক ‘ফারাজ হোসেন কারেজ অ্যাওয়ার্ড’র প্রচলন করে। আগামী ২০ বছর এই পুরস্কারটি দেওয়া হবে।

২০১৬ সালে এক নিবন্ধে প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট কুলদীপ নায়ার লিখেন, “ভারতের সর্বত্রই বিপ্লবী ভগত সিংয়ের ভাস্কর্য রয়েছে। ফারাজকে স্মরণ করা উচিত পুরো উপমহাদেশে। আমি আশাবাদী, মা-বাবারা তাদের ছেলেদের নাম রাখবেন ফারাজের নাম স্মরণ করে। তার নামে হবে ভাস্কর্য। তা শুধু বাংলাদেশেই নয়, ভারতেও। সারা পৃথিবীতে।”

Comments

The Daily Star  | English

How Islami Bank was taken over ‘at gunpoint’

Islami Bank, the largest private bank by deposits in 2017, was a lucrative target for Sheikh Hasina’s cronies when an influential business group with her blessing occupied it by force – a “perfect robbery” in Bangladesh’s banking history.

8h ago