বৈধ অস্ত্রের অবৈধ বাজার

বেশ কয়েকটি আন্তঃদেশীয় চক্র বাংলাদেশ ও ভারত সীমান্তের দশটি স্থান দিয়ে ভারত থেকে আগ্নেয়াস্ত্র বাংলাদেশে আনছে। চোরাচালানের মাধ্যমে আসা এসব আগ্নেয়াস্ত্র সন্ত্রাসীদের কাছে বিক্রি করা হচ্ছে লাইসেন্সপ্রাপ্ত বেশ কিছু অস্ত্র ব্যবসায়ীর মাধ্যমে।
dealers_text-1.jpg
ছবি: স্টার গ্রাফিক্স

বেশ কয়েকটি আন্তঃদেশীয় চক্র বাংলাদেশ ও ভারত সীমান্তের দশটি স্থান দিয়ে ভারত থেকে আগ্নেয়াস্ত্র বাংলাদেশে আনছে। চোরাচালানের মাধ্যমে আসা এসব আগ্নেয়াস্ত্র সন্ত্রাসীদের কাছে বিক্রি করা হচ্ছে লাইসেন্সপ্রাপ্ত বেশ কিছু অস্ত্র ব্যবসায়ীর মাধ্যমে।

লাইসেন্স প্রাপ্ত অস্ত্র ব্যবসায়ীদের একটি অংশ এই চক্রগুলোর সঙ্গে জড়িত। বাংলাদেশ এবং ভারতে তাদের শতাধিক সদস্য রয়েছে।

তারা গত দুই বছরে কমপক্ষে ২০০ আগ্নেয়াস্ত্র এনেছে। এছাড়াও, আগ্নেয়াস্ত্রের বারকোড সরিয়ে গ্রে মার্কেটে (বৈধ পণ্য অবৈধভাবে বিক্রি) এমন কয়েক ডজন অস্ত্র বিক্রি করেছে যেগুলো বৈধভাবে আমদানি করা হয়েছিলো।

ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি) ২০১৮ সালের মার্চ থেকে অস্ত্র আইনে করা ১৪টি মামলার তদন্ত করতে গিয়ে এই তথ্য পেয়েছে। এই মামলাগুলো হয়েছে ৪৭ জনের নামে, যাদের মধ্যে নয়জন লাইসেন্সপ্রাপ্ত অস্ত্র ব্যবসায়ী।

সিটিটিসির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তারা এরিমধ্যে ১২টি মামলার তদন্ত শেষ করেছেন এবং ৪১ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেছেন। অন্য দুটি মামলার তদন্ত চলছে।

সর্বশেষ গত ১৪ অক্টোবর রাজধানীর পল্টন এলাকা থেকে আবদুল হামিদ ওরফে বাবুল (৫০) ও তার দুই সহযোগী জালাল উদ্দিন (৪০) এবং সাইফুল ইসলাম ওরফে বিটু (৪৮)-কে আটক করেছেন সিটিটিসির সদস্যরা।

সিটিটিসির স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপের অতিরিক্ত ডেপুটি কমিশনার (এডিসি) জাহাঙ্গীর আলম জানান, অস্ত্রের দোকান ‘ফয়েজ বক্স এন্ড আর্মস’ এর মালিক বাবুল কয়েক বছর ধরেই অবৈধভাবে অস্ত্র বিক্রি করে আসছিলেন।

রাজধানীর গুলিস্তানে অপরাধীদের হাতে তুলে দেওয়ার সময় তাদের কাছে থেকে একটি দোনলা বন্দুক, একটি একনলা বন্দুক এবং ৭৪টি গুলি উদ্ধার করা হয়েছিলো।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সিটিটিসির একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা সম্প্রতি দ্য ডেইলি স্টারকে জানিয়েছেন, বাবুলই একমাত্র লাইসেন্সপ্রাপ্ত অস্ত্র ব্যবসায়ী নয়, যে অবৈধভাবে অস্ত্র বিক্রির সঙ্গে জড়িত।

তিনি বলেন, “বেশিরভাগ অস্ত্র ব্যবসায়ী গ্রে মার্কেটে অস্ত্র ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত।”

এই কর্মকর্তা আরও বলেন, “আমরা গ্রেপ্তার হওয়া নয়জন লাইসেন্সপ্রাপ্ত অস্ত্র ব্যবসায়ীর কাছে রেজিস্টার চেয়েছি। সেখানে গত কয়েক বছরে অস্ত্র বিক্রির কোনো তথ্য পাইনি। অথচ তারা দোকান পরিচালনা করছে এবং বেতন দিয়ে কর্মচারীদের রেখেছে।”

পুলিশের এমন অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে লিগাল আর্মস ডিলার এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন বলেন, “এটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।”

গত ১৭ মাসে নয়জন বৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ী গ্রেপ্তার হওয়াকে তিনি ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ বলে অভিহিত করেছেন।

গত ২৯ অক্টোবর নাসির উদ্দিন বলেন, “আমরা অবৈধ ব্যবসায়ের সঙ্গে জড়িত কোনো অস্ত্র ব্যবসায়ীকে সহায়তা প্রদান করি না এবং দোষী সাব্যস্ত হলে তাদের সদস্যপদও বাতিল করি।”

এই অ্যাসোসিয়েশনের বর্তমান সদস্য সংখ্যা ৮৪।

ব্যবহৃত সীমান্ত

সীমান্তের যে ১০টি স্থানকে অস্ত্র চোরাচালানের রুট হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে, সেগুলো হলো- বেনাপোল, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, দিনাজপুরের হিলি, ঠাকুরগাঁও, সিলেট, আখাউড়া, কুষ্টিয়ায় ভেড়ামারা, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান ও রাঙ্গামাটি।

সিটিটিসির তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, সিন্ডিকেটের ভারতীয় সদস্যরা তাদের দেশের বিভিন্ন রাজ্য থেকে অস্ত্র নিয়ে আসে এবং সেগুলো তুলে দেয় বাংলাদেশি সদস্যদের কাছে।

তদন্তকারীরা আরও জানান, কখনও কখনও ভারতীয় সদস্যরা সীমান্ত অতিক্রম করে এবং কিছু ক্ষেত্রে ভারতের এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে অস্ত্র সরবরাহ করতে বাংলাদেশকে ব্যবহার করে।

অস্ত্রের ধরন ও দাম

তদন্তকারীরা দেখতে পেয়েছেন যে, গত দুই বছরে চোরাচালানকারীরা দু’শরও বেশি আগ্নেয়াস্ত্র বাংলাদেশে এনেছে এবং এর প্রধান গ্রাহক হচ্ছে ছিনতাইকারী, চাঁদাবাজ ও রাজনৈতিক সন্ত্রাসীরা।

তদন্তের স্বার্থে কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের কর্মকর্তাগণ বিস্তারিত তথ্য জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন।

সিন্ডিকেটগুলো ভারত থেকে বেশিরভাগ আনে ৭.৬৫ এবং ৯ এমএম পিস্তল এবং .৩২ রিভলভার। তারা একে ২২ এবং একনলা বন্দুকও আনে। তবে এগুলোর চাহিদা বেশি নেই বলে উঠে এসেছে পুলিশ তদন্তে।

ভারতে একটি ৭.৬৫ পিস্তলের দাম ২০ হাজার টাকা হলেও বাংলাদেশে তা বিক্রি হয় ৪০-৮০ হাজার টাকায়।

ভারতে .৩২ রিভলভারের দাম ২০ হাজার টাকা এবং ৯ এমএম পিস্তলের ৪০ হাজার টাকা। এগুলো এখানে ৭০ থেকে ৯০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়।

গ্রেপ্তারকৃত সিন্ডিকেটের এক সদস্যদের বরাত দিয়ে তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশে একটি একে ২২ বন্দুকের দাম প্রায় সাড়ে সাত লাখ টাকা এবং ভারতে এর দাম প্রায় সাড়ে ৪ লাখ টাকা।

আইনগতভাবে আমদানি করা হলে এই আগ্নেয়াস্ত্রগুলির খরচ পরবে কমপক্ষে তিন লাখ টাকা।

আমদানিকৃত আগ্নেয়াস্ত্র কালোবাজারে বিক্রি করতে একজন অনুমোদিত ডিলার তার রেজিস্টারে দেখিয়েছেন যে, সেগুলো অন্য অনুমোদিত ডিলারের কাছে বিক্রি করেছেন।

কিন্তু মূলত সেগুলোর বারকোড সরিয়ে কালোবাজারে বিক্রি করা হয়েছে বলে জানান সিটিটিসির তদন্তকারীরা।

তাদের পদ্ধতি

তদন্তকারীদের মতে, চক্রগুলো আগ্নেয়াস্ত্র কেনা-বেচার জন্য কিছু বিশেষ শব্দ ব্যবহার করে। গাছ, গরু, গাড়ি, হাতি, ৬ একর জমি, ৯ একর জমি এবং বন্য গাছ আগ্নেয়াস্ত্রের জন্য তাদের বহুল ব্যবহৃত কিছু শব্দ।

তারা বুলেটের জন্য চারা, বাছুর, লিপস্টিক এবং বীজ শব্দ ব্যবহার করে।

চক্রগুলো বাংলাদেশের ভেতরে অস্ত্র পরিবহনের জন্য মূলত নারী এবং পথ-শিশুদের ব্যবহার করে। একজন নারী এধরনের একটি পরিবহনের জন্য তিন হাজার টাকা এবং পথ-শিশুরা ১০০ থেকে এক হাজার টাকা পায়।

তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ এড়ানোর জন্য অস্ত্র পরিবহন করা হয় মিষ্টি বা বিস্কুটের প্যাকেট এবং চাল বা শাক-সবজির ব্যাগে।

গত ৪ ডিসেম্বর যোগাযোগ করা হলে, এডিসি জাহাঙ্গীর বলেছিলেন যে, তারা অস্ত্রের অবৈধ বিক্রি বন্ধ করতে এবং এসব সিন্ডিকেট সদস্যদের গ্রেপ্তারে যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন। এখনও দুটি মামলার তদন্ত বাকি রয়েছে এবং তারা শীঘ্রই চার্জশিট দাখিল করতে কাজ করছেন।

সিটিটিসির কর্মকর্তারা আরও জানিয়েছেন যে, তারা অস্ত্র আইনের ১৮৭৮ ধারার ৩০ (বি) অনুযায়ী প্রতিটি অস্ত্র মামলার চার্জশিট ৬০ কার্যদিবসের মধ্যেই জমা দেন।

অস্ত্র আইনের ১৮৭৮ ধারার ১৯ (ক) এর অধীনে ৪১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছে সিটিটিসি। এই ধারায় দোষী সাব্যস্ত হলে কমপক্ষে সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও সর্বোচ্চ মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে।

সিটিটিসির সদস্যরা চারজনকে আটক করেছেন, যার মধ্যে লাইসেন্সপ্রাপ্ত একজন রয়েছেন। রংপুরের সরকার আর্মসের মালিক আনোয়ার হোসেন বাবুকে গ্রেপ্তার করা হয় গত বছর ২৯ মার্চ এবং চার্জশীট দাখিল করা হয় ওই বছরের ১০ জুলাই। আদালতের সূত্রে জানা গেছে, বিচার কার্যক্রম শুরু হয়েছে চলতি বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি। তবে, বাবু এখন জামিনে রয়েছেন। 

অন্য ১১টি অস্ত্র মামলার বিচার এখনও শুরু হয়নি।

আদালত সূত্র জানায়, চার্জশিটে নাম থাকা আরও আটজন আটক অস্ত্র ব্যবসায়ীও জামিন পেয়েছেন।

Comments

The Daily Star  | English

Abu sayed’s death in police firing: Cops’ FIR runs counter to known facts

Video footage shows police shooting at Begum Rokeya University student Abu Sayed, who posed no physical threat to the law enforcers, during the quota reform protest near the campus on July 16. He died soon afterwards.

10h ago