চোরাকারবারিদের নিয়ন্ত্রণে বেনাপোল কমিউটার
বেনাপোল কমিউটার ট্রেনের বৈধ টিকেট আছে, এর অর্থ এই নয় যে- আপনি আসনে বসতে পারবেন। আপনাকে আসনে বসার জন্য অতিরিক্ত অর্থ দিতে হবে দালালদের। অন্যথায় দাঁড়িয়েই যেতে হবে।
আসন পেতে আপনাকে এই দালাল চক্রের প্রতিনিধিদের কাছে থেকে একটি স্লিপ সংগ্রহ করতে হবে। ট্রেনে ওঠার আগে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা দিলে তবেই পাবেন এই স্লিপ। অথচ খুলনা থেকে বেনাপোলের মধ্যে তিন ঘণ্টার এই যাত্রার ভাড়া মাত্র ৪৫ টাকা।
শফিকুল আলম নামে এক যাত্রী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, “আসনগুলো যারা দখল করে রাখে, তারা চোরাকারবারি এবং তাদের বিরুদ্ধে কেউ কোনো কথা বলার সাহস করে না। আসনে বসতে হলে তাদেরকে অর্থ দিতে হবে, না হলে দাঁড়িয়েই যেতে হবে।”
ট্রেনটি যশোর হয়ে খুলনা ও বেনাপোলের মধ্যে প্রতিদিন চারবার চলাচল করে। যাত্রী ও স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন, ট্রেনটির মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নাকের ডগায় ইয়াবা ও ফেনসিডিলসহ অবৈধ পণ্য পরিবহন করা হয়। বলতে গেলে চোরাকারবারিরাই এই ট্রেন নিয়ন্ত্রণ করে।
চোরাকারবারিদের জন্য কাজ করা কিছু নারী আসন দখল করে রাখেন। এগুলো তাদের আয়ের অতিরিক্ত উৎস বলে অভিযোগ করেছেন এই ট্রেনের নিয়মিত যাত্রী এবং স্থানীয়রা।
দেশের ব্যস্ততম স্থলবন্দর বেনাপোল। প্রতিদিন অনেক লোক এই বন্দর ব্যবহার করে ভারতে আসা-যাওয়া করেন এবং প্রচুর পণ্য পরিবহন করা হয়।
বাস্তব অভিজ্ঞতা
এমন সব অভিযোগ সত্য কী না, তা যাচাই করতে বেনাপোল থেকে আমাদের প্রতিবেদক এই কমিউটারে যাত্রা করে ১৫ অক্টোবর।
সকাল ৯টা ১০ মিনিটে ট্রেনটি স্টেশনে আসে। খুলনার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাওয়া ট্রেনটির এটিই প্রথম স্টেশন। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে, ছয়টি বগিতেই আসনগুলো প্রায় পরিপূর্ণ।
৯টা ৩৫ মিনিটে ট্রেনটি ছেড়ে যাওয়ার আগে আমাদের প্রতিবেদক ট্রেনের একটি বগিতে ওঠেন। সেখানে বেশিরভাগ আসনই নারীদের দখলে ছিলো।
এই প্রতিবেদক লক্ষ্য করলেন যে, একজন নারী একজন পুরুষ যাত্রীকে আসনে ছেড়ে দিচ্ছেন বসার জন্য। জানতে চাইলে খুলনার কেপিসিএলের কর্মী মারুফ হাসান জানান, এই আসনের জন্য তাকে দেড়শ টাকা দিতে হয়েছে।
এই ট্রেনের নিয়মিত যাত্রী মারুফ বলেন, “আমি ট্রেনে ওঠার আগে টাকা দিয়ে যে ছোট্ট কমলা কাগজ সংগ্রহ করেছি, তা এই নারীর হাতে দিয়েছি।”
মারুফ আরও জানান, এই স্লিপে ব্যক্তি সংখ্যাও লেখা থাকে।
প্রায় ১৫ মিনিট পর ট্রেনটি নাভারন স্টেশনে পৌঁছে। ট্রেনটির পরবর্তী গন্তব্য স্টেশন দূরে থাকলেও, এখানে তা দাঁড়িয়ে যায়।
এখান থেকে আট-দশ জন নারী এবং একজন লোক পিঠে ভারী বস্তা নিয়ে বগিতে উঠলেন। তাদের মধ্যে একজন নারী এই সংবাদদাতার পাশে বসেছিলেন, যিনি অন্য এক নারীকে ৫০ টাকা দিয়ে আসন নিয়েছেন বলে জানান।
তিনি তার বস্তাতে কী নিয়ে যাচ্ছেন জানতে চাইলে, একজন নারী হতাশা নিয়ে বলেন, “এখন নিরাপত্তা খুব কড়া। আমরা এমনিতে দু-তিন বোতল ফেনসিডিল নিয়ে আসি। তবে আজ তা নেই। এখন আমাদের কাছে কালোবাজার থেকে নেওয়া কয়েকটা হরলিক্সের বোতল আছে।”
ফেনসিডিলের দাম সম্পর্কে জানতে চাইলে একজন মহিলা বলেন, “যদি এখনই নেন তাহলে আটশ টাকা লাগবে। কিন্তু ট্রেন থেকে নামার পরে নিলে এক হাজার ২০০ টাকা। কারণ স্টেশনে রেলওয়ে এবং স্থানীয় পুলিশকে টাকা দিতে হবে।”
নাজমুল ইসলাম নামে এক যাত্রী নাভারন থেকে ট্রেনে উঠেছিলেন। তিনি জানান, এখান থেকে যশোর পর্যন্ত এক ঘণ্টার যাত্রায় বেশিরভাগ সময় তাকে পুরো পথটাই দাঁড়িয়ে যেতে হয়।
যশোরে আমদানি-রপ্তানির ব্যবসায়ী নাজমুল বলেন, “তারা (চোরাকারবারি) ট্রেনের চালক, পুলিশ এবং টিকিট চেকারদের ঘুষ দেয়।”
সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনীর চেকিং এড়াতে নির্ধারিত স্টেশন ছাড়াও চোরাকারবারিরা বিভিন্ন জায়গায় ট্রেন থামায় বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
বেশ কয়েকজন যাত্রীর বক্তব্যও তার সঙ্গে মিলে যায়।
ট্রেনটির আরেকজন নিয়মিত যাত্রী হাবিবুর রহমান বলেন, “বেনাপোল থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে আমড়াখালীতে একটি স্থায়ী বিজিবি চৌকি আছে। চোরাকারবারিরা অবৈধ মালামাল নামানোর জন্য এর আগেই ট্রেন থামায়।”
বেনাপোল বাজারের এক ব্যবসায়ী বলেন, “চোরাকারবারিরা জানালা দিয়ে তাদের জিনিসপত্র ফেলে দেয় এবং তাদের সুবিধামতো আবার ট্রেনে তুলে নেয়। প্রতিটি লাগেজের জন্য টাকা পায় বলে রেলওয়ে পুলিশ পাচারকারীদের সহযোগিতা করে।”
যাত্রীরা জানান, সিন্ডিকেটের সদস্যরা নিচে অপেক্ষা করে ট্রেন থামানোর সিগন্যাল দেয়। কখনও কখনও ট্রেনে থাকা সদস্যরা চেইন টানে। তবে সবসময় চেইন কাজ করে না।
ট্রেনটি আগে দিনে দুবার এই রুটে চলাচল করতো। তবে যাত্রীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় কর্তৃপক্ষ প্রতিদিন আরও দুবার ট্রেনটি পরিচালনা করে।
বেশ কয়েকজন যাত্রী জানিয়েছেন, বাসের চেয়ে তারা এই ট্রেনেই বেনাপোল থেকে খুলনা রুটে চলাচল করতে বেশি পছন্দ করেন। কারণ, রাস্তা ভালো না আর ট্রেনে সময়মতো পৌঁছানো যায়।
ট্রেনটি চলার সময় পুলিশ ইউনিফর্মে থাকা এক ব্যক্তি বগিতে আসেন এবং বস্তা সঙ্গে থাকা নারীদের কাছ থেকে ২০ টাকা করে আদায় করেন। এ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “নিজের কাজ করুন।”
তার ইউনিফর্মে নামফলক ছিলো না।
এই সংবাদদাতার সঙ্গে আলাপকালে নারীরা বলেছিলেন যে, তারা সিট কভার, টয়লেট এবং ট্রেনের সিলিংয়ের ভেতরে মালামাল লুকিয়ে নিয়ে যান।
আমাদের সূত্র জানায়, ভারতের দৌলতপুর, গাটিপাড়া, তেরোঘর, সাদিপুর, সুতিপুর, পুটখালী, গোগা, ভুলোট, কাইবা, রুদ্রপুর, ধন্নখোলা, ঘিবা, কাশীপুর, এবং শালকোনা থেকে পাচারকারীরা তাদের চালান নিয়ে আসে।
বিজিবি এবং রেলওয়ের ভাষ্য
১৩ নভেম্বর এ বিষয়ে জানতে চাইলে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) বেনাপোল চেকপোস্ট প্রধান সুবেদার আবদুল ওহাব দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, “আমরা প্রতিদিন ট্রেনটি তল্লাশি করি। কখনও চোরাচালানের জিনিসপত্র পেলে আটক করি এবং অনেক সময় পাই না। এমনকি আমরা নিরাপত্তা তল্লাশির জন্য পরের স্টেশন নাভারন পর্যন্ত যাই।”
চোরাকারবারিদের সঙ্গে পুলিশের লেনদেনের বিষয়টি সবাই জানলেও, রেলওয়ে পুলিশের সহকারী সুপারিটেন্ডেন্ট ফিরোজ আহমেদ জানান, পাচারকারীদের কাছ থেকে পুলিশ সদস্যদের ঘুষ নেওয়ার কোনো তথ্য তাদের কাছে নেই।
খুলনা ও যশোর রেলপথের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ফিরোজ আহমেদ বলেন, “কারও বিরুদ্ধে যদি নির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া যায়, আমরা কঠোর ব্যবস্থা নেবো।”
এই সংবাদদাতা ট্রেনের চালকের সঙ্গেও যোগাযোগ করেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে চালক বলেন, “আমরা নিয়মিত স্টপেজ ছাড়া অন্য কোথাও ট্রেন থামাই না। তবে কখনও কখনও চোরাকারবারিরা ট্রেন থামাতে বগিতে থাকা কাপলিং হোসের সাহায্য নেয়। এগুলো ট্রেনের গতি কমায়।”
চোরাকারবারি ও তার কর্মীদের মধ্যে কোনো যোগাযোগ নেই জানিয়ে বেনাপোল রেলওয়ে স্টেশনের স্টেশনমাস্টার মো. সাইদুজ্জামান বলেন, “যদি এ ধরনের কর্মকাণ্ডে জড়িত কাওকে পাওয়া যায়, তবে তাকে শাস্তি দেওয়া হবে।”
অফিসিয়াল তথ্য অনুসারে, অক্টোবর মাসে বিজিবি এই ট্রেন থেকে প্রায় ১১ লাখ ২৫ হাজার টাকার ফেনসিডিলসহ পাচারকৃত পণ্য আটক করেছে। গত বছরের ২ জুলাই শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগ এই ট্রেন থেকে এক টন আতশবাজি উদ্ধার করেছিলো, যা ভারত থেকে পাচার করে আনা হয়েছিলো।
Comments