প্রকাশ্যে মেঘনা দখল

বাংলাদেশের ধমনী যে গুটিকয় নদী, তার মধ্যে অন্যতম মেঘনা। মেঘনা পরম মমতায় এই ব-দ্বীপ অববাহিকায় জীবন ও জীবিকার রসদ জুগিয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে। কিন্তু নিষ্ঠুর দখলদারদের হাতে পড়ে মেঘনা নিজেই আজ হারাতে বসেছে অস্তিত্ব।
meghna.jpg
মেঘনার তীর ভরাটের কাজ চলছে, পাশেই মাছ ধরার চেষ্টা করছেন এক ব্যক্তি। ছবি: রাশেদ সুমন/স্টার

বাংলাদেশের ধমনী যে গুটিকয় নদী, তার মধ্যে অন্যতম মেঘনা। মেঘনা পরম মমতায় এই ব-দ্বীপ অববাহিকায় জীবন ও জীবিকার রসদ জুগিয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে। কিন্তু নিষ্ঠুর দখলদারদের হাতে পড়ে মেঘনা নিজেই আজ হারাতে বসেছে অস্তিত্ব।

বিত্তশালী ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী দখলদাররা মেঘনা নদী ও এর তীর ভরাট করে প্রবাহ, নাব্যতা, প্লাবন ভূমি ও সামগ্রিকভাবে নদীর ভারসাম্য ধ্বংস করছে।

কিন্তু অবস্থা দেখে মনে হয় নদী রক্ষা করা যাদের দায়িত্ব তারা যেন কিছুই দেখছেন না।

মেঘনা নদীর এই দখল দেশের উচ্চ আদালতের একাধিক রায় ও আদেশের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। নদী রক্ষার দায়িত্বে থাকা সংস্থাগুলোর কর্তাব্যক্তিরাও যেন দখল প্রক্রিয়ার অংশ হয়ে উঠছেন।

সম্প্রতি মেঘনার গজারিয়া অংশে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় সেখানে চলছে বালু ভরাটের মহোৎসব। প্রায় আধা-ডজন ড্রেজার প্রকাশ্য দিবালোকে মেঘনার তীর ও প্লাবন ভূমি ভরাট করে উঁচু জমি তৈরি করছে।

গজারিয়া উপজেলার চর বেতাগী মৌজায় সোনারগাঁও উপজেলার সীমানায় ইসলামপুরে মেঘনা নদীর সঙ্গে মেনীখালি চ্যানেলের মোহনায় জমির দাবিদাররা ভরাটের কাজ করছে।

মুন্সিগঞ্জ জেলা প্রশাসন ও বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডাব্লুটিএ) সহায়তাতেই চলছে এই নদী দখল ও ভরাটের কাজ। অথচ, আইনের আরোপিত দায়িত্ব এবং উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী তাদেরই নদীটি রক্ষা করার কথা ছিল।

কারা ওই জমির দাবিদার তা জানতে চাইলে ঘটনাস্থলে থাকা কয়েকজন ড্রেজার শ্রমিক বলেন, তারা এ বিষয়ে কিছু জানেন না। তারা বলেন, একজন ঠিকাদার তাদের নদী ভরাট করার জন্য নিয়োগ দিয়েছে। কিন্তু ঠিকাদারের নাম প্রকাশ করেনি।

স্থানীয় একজন মৎস্যজীবী মো. আবু সাদেক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “বিআইডব্লিউটিএ এবং স্থানীয় প্রশাসনের মতো আধা ডজন নদী রক্ষাকারী সংস্থা থাকলেও উল্টো তারা দখলদারদেরই সহায়তা করছেন। তা না হলে এমন ঘটনা ঘটতে পারত না।”

বিআইডব্লিউটিএর যুগ্ম পরিচালক ও নারায়ণগঞ্জ নদী বন্দর কর্মকর্তা শেখ মাসুদ কামালের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ বিষয়ে স্ববিরোধী জবাব দিতে থাকেন।

তিনি প্রথমে জানান যে, মেঘনা ও এর তীরভূমি ভরাট করে এর প্রকৃতি পরিবর্তন করা হচ্ছে তা তার জানা নেই।

এই সংবাদদাতা সম্প্রতি নদীটি পরিদর্শন করেছেন এবং নিজে নদী ভরাটের কাজ চলছে তা দেখেছেন বলে জানালে শেখ মাসুদ কামাল বলেন, “আমি তদন্ত করার জন্য সেখানে একটি দল পাঠাচ্ছি… তবে সেখানে কী হচ্ছে তা আপনাকে ঠিক কখন জানাতে পারব তা বলতে পারছি না।”

প্রথমে নদী ভরাটের বিষয়টি অস্বীকার করলেও, তাকে কয়েকবার প্রশ্ন করা হলে পরবর্তীতে তিনি জানান, “একটি বেসরকারি পেট্রলিয়াম কোম্পানির জন্য আমরা কিছুদিনের জন্য স্বল্প পরিসরে ড্রেজার ব্যবহার করে তাদের বালু ভরাট করার অনুমতি দিয়েছি।”

স্থানীয় অধিবাসীরা জানিয়েছেন, নদী ভরাটের কাজটি প্রায় এক মাসেরও বেশি সময় ধরে চলছে।

নদীর তীরভূমি ব্যবহারের জন্য ওই পেট্রোলিয়াম প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স প্রদান করেছে কি না তা জানতে চাইলে শেখ মাসুদ কামাল বলেন, “এই জায়গাটি আমার বন্দর সীমানার অন্তর্ভুক্ত না।”

ঘটনাটি তার বন্দর সীমানার মধ্যেই ঘটছে এবং মেঘনা নদীর বন্দর সীমানা সোনারগাঁয়ের আনন্দবাজার পর্যন্ত বিস্তৃত যা নারায়ণগঞ্জ বন্দর থেকেই নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এই তথ্য জানালে তিনি বিস্ময় প্রকাশ করেন।

তিনি বলেন, “আপনি বরং আমার সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে দেখা করেন। আপনাকে আমরা সহযোগিতা করব।”

“সহযোগিতা” বলতে ঠিক তিনি কী বোঝাতে চেয়েছেন তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, “নদী দখলের কোনও ঘটনা ঘটছে কি না…।”

বন্দর আইন ও বিধিমালা অনুযায়ী বিআইডব্লিউটিএ’র নদী বন্দর কর্মকর্তা নৌযান চ্যানেল এবং নদীর তীর ও প্লাবন ভূমি অবারিত রাখা এবং বন্দর কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার উপযোগী রাখার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত।

স্পষ্টতই এই ক্ষেত্রে আইনের অনুসরণ করা হয়নি।

প্রধান নদীগুলিতে নিয়মিত দখল দেখলেই বোঝা যায় বিআইডব্লিউটিএ, উপজেলা প্রশাসন, পুলিশ, জেলা প্রশাসন, পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং পরিবেশ অধিদপ্তর সকলেই সর্বোচ্চ আদালতের রায় উপেক্ষা করে চলছে।

চলতি বছরের জুলাই মাসের শুরুর দিকে নদী দখল নিয়ে উচ্চ আদালতের সর্বশেষ পূর্ণাঙ্গ রায়ে বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের বেঞ্চ তাদের পর্যবেক্ষণে বলেন যে, একটি নদী হত্যা কার্যত সকলের সম্মিলিত আত্মহত্যা এবং বর্তমান ও ভবিষ্যৎ উভয় প্রজন্মকেই হত্যা করার সামিল।

আদালত তুরাগ নদী রক্ষার বিষয়ে পর্যবেক্ষণ দিতে গিয়ে নদীসমূহকে ‘লিগাল পারসন’ বা ‘জীবন্ত সত্ত্বা’ হিসাবে মর্যাদা দেন। একই সঙ্গে নদী দখলের ঘটনাকে ফৌজদারি অপরাধ হিসাবে চিহ্নিত করেন। আদালত আরও ঘোষণা করেন যে, সরকার- রাষ্ট্র ও জনগণের পক্ষে অবশ্যই সকল নদী, পাহাড়, সমুদ্র সৈকত, বন, খাল, বিল এবং জলাভূমি রক্ষায় ট্রাস্টি হিসাবে ভূমিকা পালন করবে।

মেঘনায় চলমান বালু ভরাটের বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে মুন্সীগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. মনিরুজ্জামান তালুকদার জানান, নদী দখল সম্পর্কে তিনি কিছু জানেন না।

তিনি বলেন, “তবে এ বিষয়ে আমি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেব।”

এই সংবাদদাতার হাতে আসা কিছু নথি থেকে দেখা যায় মুন্সীগঞ্জের সদ্য সাবেক জেলা প্রশাসক মেঘনা নদীর পাড়ে ১২ একর তীরভূমি ও প্লাবন ভূমি ওই বেসরকারি পেট্রোলিয়াম পরিশোধন প্রতিষ্ঠানকে ইজারা দিয়েছেন। যাতে ভূমি মন্ত্রণালয়ও সম্মতি দিয়েছে। ইজারা দেওয়া মেঘনার এই স্থানেই ভরাটের কাজ চলছে।

প্রাপ্ত নথি অনুযায়ী ভরাটের কাজ চলা পুরো ১২ একরই খাস জমি। যার মধ্যে প্রায় ৬ দশমিক ৬ একর তীরভূমি স্থানীয় প্রায় ৫০ জন কৃষকের কাছে ইজারা দেওয়া হয়েছিল এবং অবশিষ্ট ৫ দশমিক ৫ একর তীরভূমি পতিত ছিল।

মুন্সিগঞ্জ জেলা প্রশাসন প্রথমে ইজারা দেওয়া তীরভূমি অধিগ্রহণ করে। এর সঙ্গে পতিত তীরভূমি যোগ করে মোট ১২ একর জমি ওই পেট্রোলিয়াম প্রতিষ্ঠানের কাছে দীর্ঘ মেয়াদে ইজারা দেয়।

দ্য ডেইলি স্টারে এ বছরের ফেব্রুয়ারি ও মে মাসে মেঘনা দখল নিয়ে কয়েকবার প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার পর জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন একটি সরেজমিন অনুসন্ধান করে। সেই অনুসন্ধান অনুযায়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্র, সিমেন্ট কারখানা, জাহাজ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান, কাগজ কল এবং একটি বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চল সহ ১৩টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের তালিকা তৈরি করে, যারা মেঘনা দখল করে রেখেছে।

কমিশন বিআইডব্লিউটিএ-কে দখলদারদের উচ্ছেদ করতে বলে। যার ফলশ্রুতিতে বিআইডব্লিউটিএ একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে। ওই কমিটির কাজ ছিল মেঘনা নদীর কতটা অংশ কোন প্রতিষ্ঠান দখল করেছে তা নির্ধারণ করা।

এই কমিটি অক্টোবর মাসের শেষের দিকে বিআইডব্লিউটিএ’র পরিচালক শফিকুল হকের কাছে প্রতিবেদন জমা দেয়।

নভেম্বরের শুরুর দিকে এই প্রতিবেদক শফিকুল হককে প্রতিবেদনটির অনুলিপি দিতে অনুরোধ করেন এটা জানতে যে কোন প্রতিষ্ঠান নদীর কত অংশ দখল করেছে।

কিন্তু তিনি তা দিতে অসম্মতি জানান।

প্রতিবেদনটি একটি পাবলিক ডকুমেন্ট বলে উল্লেখ করলে তিনি বলেন, “আমি এটা দিতে পারছি না, কারণ এতে নদী দখলকারীদের সম্পর্কে অনেক কিছুই লেখা রয়েছে। আমি কীভাবে একজন সাংবাদিককে এর অনুলিপি দিতে পারি?”

নদী রক্ষার পর্যাপ্ত আইন: প্রয়োগ করে না সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলো

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান হাওলাদার বলেন, “নদীর তীর ও প্লাবন ভূমি ইজারা দেওয়া এবং নদীর গতিপথ পরিবর্তন ও বাধাগ্রস্ত করা, নদী, পানি এবং জলাভূমি সংরক্ষণ আইন অনুসারে শাস্তি যোগ্য অপরাধ। আমরা এমন যে কোনও কাজের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নির্দেশে মেঘনার খাস জমি ও তীরভূমি দখল বিষয়ে তদন্ত চলছে।”

তিনি মনে করেন, নদী রক্ষাকারী সংস্থাগুলোর নিষ্ক্রিয়তা এবং প্রভাবশালী দখলদারদের সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততার কারণেই এই অপরাধ চলছে।

তিনি আরও বলেন, “নদী রক্ষাকারী সংস্থাগুলো আইন কার্যকর করে না। পুলিশ নদী দখলকারীদের গ্রেপ্তার করতে এবং জরিমানা করার জন্য জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে হাজির করতে ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধির ১৩৩, ১৩৫, ১৩৭ এবং ১৩৯ ধারা অনুযায়ী ক্ষমতাপ্রাপ্ত। দণ্ডবিধির ২৭৭ এবং ২৭৮ ধারায় এর জন্য শাস্তির বিধান আছে।”

তিনি বলেন, “নদী সংরক্ষণের জন্য একাধিক আইন রয়েছে, সুতরাং দেশের নদী বাঁচাতে হাইকোর্টের রায়ের জন্য অপেক্ষা করার প্রয়োজন হওয়ার কথা না।”

Comments

The Daily Star  | English

How much do the poor pay for rice? At least Tk 50 a kg

Rice price in Bangladesh is rising and the rate of coarse grain has crossed Tk 50 a kilogramme nearly after a year

5h ago